
ঈদ হতে পারে টিভি নাটকের টিকে থাকার অবলম্বন
ঢাকার টেলিভিশন অনুষ্ঠানের যে গড়ন, তা মূলত কয়েক দশক আগে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বিশেষায়িত চ্যানেল বাদ দিলে ক্ষেত্রবিশেষে বিটিভির ‘স্বর্ণযুগের’ তুলনায় অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য কমেছে। এর মাঝে ‘জনপ্রিয়তা’র নিরিখে এখনো শীর্ষ আইটেম নাটক। আর ঈদ বা কোনো উৎসব মানে নাটকের বর্ধিত ফলন।

বাংলাদেশের টিভি নাটক নিয়ে আরেকটি আলোচনা আছে, যা খানিকটা উল্লেখ করে নিই। সারা দুনিয়ায় টিভিতে মুভি বা ফিল্ম বলে একটা ধারা থাকলেও ‘নাটক’ বলে আলাদা কিছু নেই। ‘ড্রামা’ বলে একটা ঘরানা আছে মুভিতে, যেমন কিছু মুভি অ্যাকশন ঘরানার হয়। এখন দেশের অনেকেই টিভি নাটককে ‘ফিল্ম’ বলতে চাইলেও এর এমন চেহারা দাঁড়িয়েছে যে দর্শক নাটককে ‘সিনেমাটিক’ বা ‘বড়পর্দা’র সঙ্গে তুলনীয় বস্তু আকারে মানতে রাজি নন। সে হিসেবে বাংলা টেলিভিশনের ‘নাটক’ একটি ইউনিক কনটেন্ট।
প্রসঙ্গ যেহেতু ঈদ; বিটিভির সোনালি দিনগুলোয় ঈদ অনুষ্ঠান বলতে ছিল হাতে গোনা কিছু কনটেন্ট। তখন সাত-আটদিনের আয়োজনও ছিল না। সিনেমা বাদ দিলে প্রধান আকর্ষণ ছিল ঈদের বিশেষ নাটক ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দ মেলা’। আরো কিছু আয়োজন থাকলেও হাল আমলে ঈদের মূল আয়োজন হয়ে গেছে নাটক। প্রতি ঈদে গড়ে পাঁচ শতাধিক নাটক প্রচার হয় টিভি চ্যানেলগুলোয়। সে হিসেবে শত শত কোটি টাকা আয়ের প্রায় পুরোটাই আসে নাটক থেকে।
বিটিভির আমলে চ্যানেলটি দেশের গড় দর্শকের রুচি ও সাংস্কৃতিক গড়ন নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে নাটকের দায়িত্ব ও ধরন ছিল একটা মানের। তবে ঈদ যেহেতু আনন্দ ও সৌহার্দের বার্তা নিয়ে আসে, ঈদ নাটকগুলো হাস্যরস ও সামাজিক বার্তা নির্ভর হতো। প্রথম কবে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ঈদের নাটক’ প্রচার শুরু হয়েছিল, তার হদিস করতে পারি না। তবে সবচেয়ে মশহুর উদাহরণ আমজাদ হোসেনের লেখা ও অভিনীত জব্বর আলী সিরিজ। সিঙ্গেল এপিসোডের এ নাটক ঈদে প্রচার হতো। যার প্রথম এপিসোড প্রচার হয় ১৯৭৭ সালে। ওই সময় এখনকার আদলে ‘পরিচালক’ বলে কিছু ছিল না। সবকিছু সামলাতেন ‘প্রযোজক’। তেমন প্রযোজকদের মধ্যে যার নাম এখনো আমরা শুনি তিনি নওয়াজীশ আলী খান।
বিটিভিতে কয়েক দশকজুড়ে ঈদে রাত ৮টার সংবাদের পর একটি নাটক প্রচার হয়ে এলেও ব্যতিক্রম শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। ওই সময় ‘প্যাকেজ’ নাম দিয়ে নির্মাণ করা হয় বিটিভি-বহির্ভূত স্বাধীন প্রডাকশন হাউজের নাটক, যা বাংলাদেশের টেলিভিশন প্রডাকশনের বাণিজ্যকে রাতারাতি বদলে দেয়। এর আগে বিটিভিতে সপ্তাহে একটি খণ্ড নাটক ও পাক্ষিকভিত্তিক দুটি ধারাবাহিক নাটক প্রচার হতো। প্যাকেজ আসার পর খণ্ড ও ধারাবাহিক নাটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্যাটেলাইট যুগের আগে এটি ছিল বিটিভির সর্বশেষ জ্বলে ওঠা।
প্যাকেজের কল্যাণে নব্বইয়ের দশকে এসে ঈদ অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। ততদিনে টেলিভিশন প্রযুক্তি আরো সহজলভ্য হয়ে উঠছে সারা দেশে। এ কারণে একদল অভিনয়শিল্পী রাতারাতি ন্যাশনাল আইকন হয়ে ওঠেন।
প্রডাকশন বাড়তে থাকায় এবং পেশা হিসেবে অভিনয়কে নেয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় এ সময় অভিনয়শিল্পীদের চাহিদা বাড়ে। ওই সময় আগের দশকের তারকাদের মধ্যে হুমায়ূন ফরীদি, সুবর্ণা মুস্তাফা বা আফজাল হোসেন তাদের শেষ সময়টুকু পার করছেন। দুই সময়ের অন্তর্বর্তীকাল সামাল দিয়েছেন বিপাশা হায়াত, তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, আজিজুল হাকিমরা। এরপর নিয়মিতভাবে প্রতি দশকে একঝাঁক তারকার আবির্ভাব ঘটেছে।

শুধু নতুন অভিনেতাই নয়, চাহিদা অনুসারে নতুন নতুন লেখক ও পরিচালকের কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠে টেলিভিশন। ফেরদৌস হাসান, মোহন খান বা প্রণব ভট্টরা তখন জনপ্রিয় মুখ। ঈদবাজারের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শীর্ষ তারকা হওয়ার প্রতিযোগিতা জমে ওঠে মূলত এ সিজনে। সেরা নির্মাতাদের বিজ্ঞাপনও দেখা যেত টিভিতে।
নব্বইয়ের সেই দিনগুলোয় প্যাকেজের কল্যাণে আরো সহজলভ্য হয়ে যান হুমায়ূন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলনের মতো লেখকরা। এর আগে জনপ্রিয় খণ্ড নাটক বা সিরিজ লেখকের ভূমিকায় থাকলেও সরাসরি পরিচালনার সুযোগ পান তারা। হুমায়ূন আমৃত্যুই থেকেছেন ঈদ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। অন্যদিকে ‘ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান’ নামে একটি কনটেন্ট এখনো জবরদস্তির সঙ্গে টিকিয়ে রাখা হানিফ সংকেত ঈদ উপলক্ষে নাটক বানিয়ে যাচ্ছেন।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে টেরেস্ট্রিয়াল চ্যানেল একুশে টেলিভিশন বাংলাদেশের ছোটপর্দা সংস্কৃতিতে নতুন জোয়ার আনে। অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় আসে নতুনত্ব, পাশাপাশি নাটকে আসে ‘আউট অব দ্য বক্স’ চিন্তা। একুশে টিভি আইনগত কিছু জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় কয়েক বছরের মাথায়। এরই মধ্যে আবির্ভাব ঘটে পূর্ণাঙ্গ স্যাটেলাইট চ্যানেল এটিএন বাংলা ও চ্যানেল আইয়ের। তাদের মাধ্যমে ঈদ আয়োজন আরো ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। তবে অনুষ্ঠান নির্মাণের দিক থেকে বিটিভির একটি বর্ধিত সংস্করণের বেশি কিছু হতে পারেনি তারা। এর একটি কারণ হতে পারে, পরবর্তীকালের বেসরকারি চ্যানেলগুলোর কর্তাব্যক্তি হয়ে এসেছেন বিটিভির প্রাক্তনরা। ইতিবাচক দিক হিসেবে বলা যায়, বিটিভির দীর্ঘ ঐতিহ্য নতুন চ্যানেলগুলোকে একটা আকার দিতে সাহায্য করেছে।
সব মিলিয়ে সামগ্রিক টিভি নাটকের জনপ্রিয় অংশগুলো মূলত ঈদ বা (গত কয়েক বছরে) ভ্যালেন্টাইনের মতো উৎসবকে কেন্দ্র করে। দর্শকদের শীর্ষ বাছাইও আসে এখান থেকে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে নির্মাণের ধারা। বিটিভির আমলে নাটক যেমন দর্শকদের প্রভাবিত করার মতো শৈল্পিক বিষয় ছিল, হাল আমলে সেটি নির্ভর করে ট্রেন্ডের ওপর। এর আবার নানা ধারা আছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঈদ নাটকে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে রোমান্টিক ও গ্রামীণনির্ভর নাটকের প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই। কমেডি নাটকের আরেকটি ধারা হলো একাধিক পর্বের নাটক ও ফ্র্যাঞ্চাইজি। ফ্র্যাঞ্চাইজির মধ্যে আরমান ভাই, সিকান্দার বক্স বা হালের যমজ সিরিজ উল্লেখযোগ্য। তবে চলতি ঈদের আলোচনা থেকে জানা যায়, সিকুয়াল বা একাধিক পর্বের নাটকও হালে জমছে না। মূলত চরিত্রের জনপ্রিয়তার কারণে এসব নাটকের পর্ব বেড়েছিল। কিন্তু সারবস্তু হিসেবে উল্লেখযোগ্য সংযোজন না থাকায় দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

সাম্প্রতিক কয়েক বছরে আরেকটি অভিযোগ এসেছে, তা হলো একই ধরনের গল্প নিয়ে নাটক। কোনো ঈদে পারিবারিক গল্প হরেদরে নির্মিত হলে বা কোনো ঈদে পরকীয়া পাচ্ছে প্রাধান্য। এছাড়া একেকজন তারকা ২০-৩০টি নাটকে মুখ দেখানোয় দর্শক বিরক্ত। আবার নাটককেন্দ্রিক সিন্ডিকেট, বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও চ্যানেলের বিজনেস টিমের হস্তক্ষেপের কারণে বৈচিত্র্যহীনতার অভিযোগ রয়েছে। তার ওপর আছে বিজ্ঞাপনের চাপ। এমন পরিস্থিতিতে দর্শক নাটক দেখার আরেকটা উপায় খুঁজে পেয়েছেন সাম্প্রতিক বছরে। এখন টিভির চেয়ে টিআরপি-নির্ভর করে ইউটিউব ভিউয়ের ওপর। ইউটিউব ভিউকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আবার মানের কারণে সমালোচনায় পড়ছেন বেশির ভাগ নির্মাতা। এর আবার অন্য একটি চমৎকারিত্ব হলো ইউটিউবের রমরমা অবস্থার কারণে দেশের বাইরেও ঢাকাই নাটকের দর্শক তৈরি হচ্ছে। সে অবশ্য অন্য আলাপ। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হালের ট্রেন্ড, ওটিটির অরিজিনাল কনটেন্ট। নাটকের বর্ধিত অংশ নিয়ে বাংলাদেশে সম্প্রতি কিছু হইচই হয়েছে বটে, তবে এখনো আশাবাদী হওয়ার মতো বেশি কনটেন্ট আসেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো অভিনয়শিল্পীর টেলিভিশনের অনুপস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে হালে। আবার একই সঙ্গে ঈদ উপলক্ষে প্লাটফর্মগুলো নিজেদের অরিজিনাল সিরিজ বা কনটেন্ট নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হচ্ছে।
ঈদের নাটক নিয়ে আরেকটি অভিযোগ কালেভদ্রে শোনা যায়, যা আবার সংবাদমাধ্যমের ‘ঈদ সংখ্যা’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঈদের অনুষ্ঠানে ঈদ থাকে না। আমজাদ হোসেনের জব্বর আলী সিরিজ বা পরবর্তী কালের নাল পিরান বা গত কয়েক দশকে হাতে গোনা কয়েকটি নাটকে ঈদ বিষয় হয়েছে। সেদিকে অভিযোগটা এমন যে জনসংস্কৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার যে চল নাটকে বিরাজমান, তার ভালো উদাহরণ ঈদের নাটক।
ঈদকেন্দ্রিক নির্মাণ নিয়ে আজকাল হতাশার সীমা নেই। কেউ কেউ নস্টালজিয়ায় ভোগেন। শিল্পমান বা নতুন ভাবনা দেয়ার চেষ্টা দেখা যায় না। এ কারণে বর্তমান প্রজন্মও একঘেয়েমিতে বিরক্ত। কোটি কোটি ভিউ হওয়া নাটকের মন্তব্যের ঘরে গেলে হতাশাজনক বার্তা চোখে পড়ে। অথচ ঈদ বা যেকোনো সময় বিবেচনায় অন্য কোনো কনটেন্টের চাহিদা বা জনপ্রিয়তা গত কয়েক দশকেও তৈরি হয়নি। কিন্তু এটা ঠিক যে মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত এ অবস্থার পেছনে নাটক ইন্ডাস্ট্রির অনেক ভূমিকা আছে। সেক্ষেত্রে জনরুচি, শিল্পমান, নিরীক্ষার লড়াইয়ে নির্মাতারা মনোযোগ দিলে জমে থাকা বা ধেয়ে আসা চাপগুলো কমবে। নইলে ফিকে হয়ে আসা নাটকের কদর আরো কমবে। সেই চ্যালেঞ্জ হাতে নেয়ার জন্য ভালো একটি উপলক্ষ ঈদ।
*লেখাটি বণিক বার্তায় প্রকাশিত