
বড় বাজেটের সক্ষমতা দেখা গেল বরবাদে
প্রিয়তমা থেকে শুরু, এরপর রাজকুমার, তুফান, দরদ এবং সর্বশেষ বরবাদ ; ভক্তদের কাছে সুপারস্টার থেকে সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় অভিনেতা শাকিব খানের রুপান্তরের যাত্রাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। একসময় শাকিব খানের নামে নাক সিঁটকানো মানুষরাও এখন মাল্টিপ্লেক্সে ভিড় করছেন শাকিবের ছবি দেখতে। এই যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা শাকিব তৈরি করতে পেরেছেন তারই ফলাফল বরবাদ ছবির হিউজ বাজেট। প্রযোজকরাও তাই সহজেই শাকিবের উপর ভরসা করে বড় লগ্নি করছেন। প্রিয়তমা কম বাজেটের হলেও উঠে এসেছে মোটা অংকের টাকা। রাজকুমার বড় বাজেটের ছবি, প্রিয়তমার মতো ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও দর্শক সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসার সাগরে ভেসেছেন শাকিব। তুফানে তো শাকিব অনন্য, রায়হান রাফির মাস্টার মেকিং সাথে ব্যক্তি শাকিবের ক্যারিশমা, তুফান বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্য একদম খাঁটি হীরে হয়ে উঠেছিলো। দরদে বেশ কিছুটা হতাশার জায়গা থাকলেও শাকিব ছিলেন অনবদ্য। পরপর চারটি ছবিতে চারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র ; প্রিয়তমার সাধারণ ছেলে সুমন, রাজকুমারে প্রান্তিক এলাকার শামসুল, তুফানে ভয়ানক গ্যাংস্টার এবং দরদে একজন সাইকো; প্রতিটি চরিত্রে শাকিব নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন ক্রমাগত। যাই হোক ধান বানতে শিবের গীত অনেক গাওয়া হলো এবার আসি এবারের ঈদের সাড়া জাগানো ছবি বরবাদ নিয়ে। বরবাদ বেশ বড় আয়োজনের ছবি, পুরো গল্পটাকে পরিচালক মেহেদী হাসান হৃদয় লার্জার দ্যান লাইফ প্লটে গেঁথেছেন। গল্পের চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি।
কেমন লাগলো বরবাদ?

চিত্রনাট্য: বরবাদ ছবির চিত্রনাট্য সহজ ও সাধারণ, সাধারণ গল্পকে পরিচালক নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়ে চমৎকার ভাবে প্রেজেন্ট করেছেন। বড়লোক বাবার বখে যাওয়া ছেলে আরিয়ান মির্জা, বাবার অতিরিক্ত আদর প্রশ্রয়ে একের পর এক অপরাধ জগতে পা বাড়ায় সে। ড্রাগ, নারীলিপ্সা, খুনখারাবি সবকিছু মিলিয়ে তার জগৎ। আরিয়ানের এই পাশবিক জগতে হঠাৎ পা পড়ে নিতুর; এরপর কি ঘটে আরিয়ানের জীবনে? নিতুই বা কে? যীশুর আগমন ঘটে কিভাবে? কে আসল ভিলেন? সব প্রশ্নের উত্তর পেতে দেখতে হবে বরবাদ। বরবাদের চিত্রনাট্য সাধারণ হলেও সময়ের সাথে সাথে গল্প এগিয়েছে দ্রুত; তুফানে যেমনটা শান্তর ক্যারেক্টার বিল্ডআপে একটু বেশি সময় লেগেছিলো যেটা কখনো কখনো একঘেঁয়ে লাগছিলো, বরবাদে সেটা নেই। এখানে প্রথমেই ক্লাসরুমের দৃশ্য থেকে শুরু করে ইন্টারভালের আগের ক্লাইম্যাক্স পর্যন্ত পুরো সময়েই গল্প সুন্দরভাবে এগিয়েছে। বিরতির পরও গল্প হেলে পড়ে নি, বরং ভালোভাবেই এগিয়েছে। তবে আমার একান্ত মতামত হলো শেষ এন্ডিংটা দরকার ছিলো না, ফাইট সিনের পরই এন্ডিংটা হলে সেটা আরও বেশি ভালো হতো বলে আমার মনে হয়।
অভিনয়: অভিনয়ে শাকিব খান অদম্য, অনবদ্য। এই শক্তিমান অভিনেতাকে কেন এভাবে সস্তা মানহীন ছবিতে অভিনয় করিয়ে হাসির পাত্র বানানো হলো এই আফসোস আমার মতো অনেকেরই। বরবাদ প্রায় পুরোটাই শাকিবময়, শাকিব যখনই পর্দায় এসেছে প্রতিবারই দর্শক হাততালি দিয়েছে, উপভোগ করেছে। এমন একটা ভয়ংকর চরিত্রে শাকিব যেন চরিত্রের মাঝেই ঢুকে গিয়েছিলেন। শাকিবের বিশ্বস্ত সঙ্গী জিল্লু ( স্যাম ভট্টাচার্য) তো এখন সবখানেই জনপ্রিয় নাম। ছবির জিল্লু মাল দে সংলাপ এখন সবার মুখে মুখে। আমার মনে পড়ে না শেষ কবে বাংলা ছবির কেন সংলাপ এভাবে সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো। মিশা সওদাগর তার ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা চরিত্রে অভিনয় করেছেন, পুত্রস্নেহে অন্ধ পিতার চরিত্রে তার অভিনয়ও অনেকের মনে আফসোস জাগিয়েছে কেন এই অভিনেতার অভিনয় সত্তার অপব্যবহার করা হলো এতকাল! তবে মন ছুঁয়ে গেছে নায়িকা ইধিকা পালের অভিনয়। প্রিয়তমা, খাদানের পর বরবাদ; ইধিকার ফিল্মোগ্রাফিতে পরপর তিনটি ধামাকা ছবি যুক্ত হলো। বরবাদে তার নিতু চরিত্রটা রহস্যে ঘেরা। প্রতিটা দৃশ্যে ইধিকা মন দিয়ে অভিনয় করেছেন। প্রতিটা ডায়লগ ডেলিভারিতে তার এক্সপ্রেশন নিতু চরিত্রটাকে আলাদা করে জায়গা করে দিয়েছে দর্শকের কাছে। দুষ্টু কোকিলের মানস সচদেব পুরো ছবিতে দর্শকের হাসির খোরাক যুগিয়েছেন। তবে আফসোসের জায়গা যীশু সেনগুপ্ত! এত গুণী একজন অভিনেতার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারেন নি পরিচালক, বরবাদ ছবিতে যীশু সময়ও পেয়েছেন অল্প।
গান: তুফানের মতো এতটা জনপ্রিয় বরবাদের গানগুলো হয় নি। ‘চাঁদ মামা’ গানটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে বটে কিন্তু সিনেমাহলে দর্শকের উচ্ছ্বাস করার মতো হয় নি যেটা দুষ্ট কোকিল বেশ ভালোভাবেই পেরেছিলো। শেষ ফাইট সিনের সাথে ‘নিঃশ্বাস’ গানটা জমে ক্ষীর হয়ে গেছে, দর্শকের গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। সমেশ্বর অলীর লেখা ও সুরে নোবেলের ‘মহামায়া’ গানটা অনবদ্য হয়েছে, জানি না কেন এটা রিলিজ দিলো না। প্রিতমের আরেকটি গান ‘দ্বিধা’ শ্রুতিমধুর লেগেছে কিন্তু হতাশ করেছে ইমরান কোনালের ‘মায়াবী’। গানটা আমার কাছে আরোপিত লেগেছে, মনে হয়েছে এই গানটা না থাকলেই হতো এবং কস্টিউমে ‘জালিমা’ গানের সাথে হুবহু মিলের কারণে বেশ সমালোচনার শিকার হয়েছে গানটি।
একশন, ভায়োলেন্স এবং অন্যান্য: বরবাদ ছবির সবচেয়ে অনন্য দিক হলো এর একশন সিকোয়েন্স এবং ভায়োলেন্স। আধুনিক বাংলা ছবিতে এমন মানসম্পন্ন একশন ভায়োলেন্স কখনোই দেখা যায় নি। একদম প্রথম দৃশ্য থেকেই এই ছবির ভায়োলেন্স অনেককেই ভয় পাইয়েছে। যদিও অনেকগুলো অংশ ব্লার করে দেওয়া হয়েছে তাও দর্শক দেখে মজা ও ভয় পাবেন। তুফানে যেমন একশনের অভাব বোধ করেছলাম, সব যেন সুদে আসলে পেয়েছি বরবাদে। শাকিব খানের ২য় লুকটা বেশ বাস্তব লেগেছে এবং ঐ বিধ্বস্ত অবস্থায় প্রচন্ড ভয়ংকর লেগেছে তাকে।

সবমিলিয়ে বরবাদ বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটা মাইলফলক, একটা স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে থেকে যাবে সবসময়। এত বড় ক্যানভাসের ছবি আগে কখনো দেখা যায় নি। পরিচালক মেহেদী হাসান হৃদয় নিজের প্রথম ছবিতেই যে ক্যারিশমা দেখিয়েছেন, ভবিষ্যতে হয়তো রায়হান রাফির একজন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী আমরা পেতে যাচ্ছি। বাজেট পেয়েও সেটা কাজে লাগানোর সক্ষমতা সব পরিচালকের থাকে না, হৃদয় যেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। সবশেষে এটাই বলবো, বরবাদ একটা পয়সা উসুল ছবি, একশন ও মাস মুভি লাভারদের জন্য মাস্ট ওয়াচ। ইতোমধ্যেই দেশের সকল প্রেক্ষাগৃহে বরবাদ ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সকলের নিকট অনুরোধ ভালো বাংলা ছবি দেখুন, আলোচনা করুন এবং বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশে সাহায্য করুন, ধন্যবাদ।
Finally someone’s review is worthy of reading. Bhai bhalo likchen.
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাকে!