Select Page

সরল সমাধান বাদ দিলে হয়তো ‘মহানগর’ বা সাবরিনা’র পাশেই থাকত ‘জিম্মি’

সরল সমাধান বাদ দিলে হয়তো ‘মহানগর’ বা সাবরিনা’র পাশেই থাকত ‘জিম্মি’

[পশ্চিমবঙ্গের ওটিটি প্লাটফর্ম হইচইয়ের জন্য এর আগে বেশ কিছু আলোচিত সিরিজ তৈরি করেছিলেন আশফাক নিপুন। এবারের ঈদুল ফিতরে নতুন সিনেমার ডামাডোলে সাম্প্রতিক নির্মাণ ‘জিম্মি’ ততটা আলোচনায় আসেনি। তবে দর্শকরা সিরিজটির প্রশংসা করছেন। সম্প্রতি ‘জিম্মি’র রিভিউ প্রকাশ করেছে কলকাতার সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা। শিরোনাম “ঘটনার ঘনঘটা, সাবলীল অভিনয়, প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ, কেমন হল জয়া অভিনীত ‘জিম্মি?” লিখেছেন অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়। যেখানে আনন্দবাজার পত্রিকার স্বভাবসুলভ বিকৃতিপণায় আশফাক নিপুনকে লিখেছেন ‘আসফাক নিপুন’। পড়ুন সেই রিভিউ, তবে শিরোনামটি লেখা থেকে বিএমডিবির নির্বাচন করা।]

‘জিম্মি’ শব্দটির বাংলা অর্থ ‘পাপী’। আসফাক নিপুন পরিচালিত সাম্প্রতিক ওয়েব সিরিজের শিরোনামের সাবটাইটেল অন্তত তা-ই বলছে। এই শব্দের চলিত অন্য এক অর্থ হল ‘পণবন্দি’। ‘জিম্মি’র কাহিনি-কাঠামোর শিকড়ে ক্রিয়া করছে ‘লোভ’ নামক এক রিপুর তাড়না। এবং ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু’র যে প্রবাদ যে কোনও সংস্কৃতিতেই প্রচলিত, এ সিরিজ তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ‘পাপের বেতন মৃত্যু’-র অবধারিত পরিণতিকে খানিক তির্যক চোখে দেখেই সিরিজ়ের চিত্রনাট্য রচনা। আবার এ সিরিজের চরিত্রেরা যে যার নিজস্ব লোভের জালে বন্দিও বটে। গোত্রপরিচয়ে ‘থ্রিলার’ সিরিজটির অলঙ্কার হিসাবে তাই বার বার উঠে এসেছে কৌতুক। বা বলা ভাল, এক ঈষৎ তিক্ত-কষায় এবং অম্লমিশ্রিত স্বাদ, যা অতি প্রাচীন নীতিমালার কাহিনিকেও সাম্প্রতিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখেছে। সে দিক থেকে দেখলে, এর চরিত্র বাজারচলতি থ্রিলারের চেয়ে আলাদা।

সিরিজে রুনা লায়লা এক মধ্যবিত্ত গৃহবধূ। সে সরকারি বিদ্যুৎ পর্ষদে কেরানির চাকরি করে। তার স্বামী আজ়াদ এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী। কাহিনির সময়কাল বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পালাবদলের কাল। সেই পালাবদলের প্রেক্ষিতেই মধ্যবিত্ত জীবনের টুকরোটাকরা অভাব আর অভিযোগ নিয়েই দিন কাটে লায়লা আর আজাদের। লায়লার চাকরিতে তেমন ওঠা-নামা না থাকলেও আজাদ হঠাৎই কর্মহীন হয়ে পড়ে। তার সংস্থায় তালা ঝোলে এবং সে এই ঘটনা লায়লাকে জানাতে পারে না। ও দিকে লায়লার অফিসেও জনৈক কর্মীর আকস্মিক মৃত্যুর পরে রেকর্ড রুমের দায়িত্ব পায়। রেকর্ড রুমে ফাইলের স্তূপের পিছন থেকে লায়লা আবিষ্কার করে একটা সিল করা কার্ডবোর্ডের বাক্স। সিল ভেঙে সে দেখে বাক্সভর্তি হাজার টাকার নোট। প্রাথমিক বিমূঢ়তায় সে সেই টাকা আত্মসাৎ করার কথা ভাবেনি। বরং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে টাকার বিষয়ে জানাতেই চেয়েছিল। কিন্তু…

কিন্তু তার মধ্যবিত্ততার পিছুটান, তার বিভিন্ন ধরনের অভাব আর খিদে তাকে টাকাটা নিতে বাধ্য করে। যে গয়নার দোকানে এক জোড়া দুল গড়াতে দিয়ে সে পয়সার অভাবে তা ডেলিভারি নিতে পারে না, বরং বার বার সেই দোকানির কাছে অপমানিত হয়, তার সামনেই সে মেলে ধরে হাজার টাকার নোটের বান্ডিল। বাড়ি ফিরে সেই গয়না স্বামীর কাছে ইমিটেশন বলে চালায় এবং কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। বাকি টাকার বান্ডিল সে তার হারমোনিয়ামে লুকিয়ে রাখে। ও দিকে দেশে তখন শুরু হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। দানা বাঁধছে শাসকবিরোধী ক্ষোভ। এমতাবস্থায় স্বামী আজাদকে নিয়ে লায়লা কক্সবাজারের এক মহার্ঘ হোটেলে গিয়ে ওঠে। স্বামীকে জানায় সে ‘এমপ্লয়ি অফ দ্য ইয়ার’ হওয়ায় এই সফরের খরচ বহন করছে তার সংস্থা। সেই হোটেলেই লায়লার সঙ্গে দেখা হয় রানার। তার পুরনো প্রেমিক, যার সঙ্গে সে বাড়ি থেকে পালাতে চেয়েছিল। স্টেশনে লায়লাকে অপেক্ষমাণ রেখে রানা আসেনি। রানাকে দেখে কি লায়লার পুরনো প্রেম জেগে উঠল? না কি সে প্রতিশোধ নিতে চায় পুরনো অপমানের?

লায়লার অফিসে বেশ কিছু সহকর্মী ইতিমধ্যে টাকার বাক্সটা খুঁজতে শুরু করেছে। কারণ সে টাকার ভাগীদার তারা। প্রয়াত রেকর্ড রুম রক্ষকের মারফত বড় কোনও সংস্থাকে বিদ্যুতের বেআইনি কানেকশন দেওয়ার বিনিময়ে সে টাকা তাদের হাতে আসে। সে টাকা ফিরে পেতে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। এমনকি তারা দু’জন গুন্ডাও লাগায় টাকা উদ্ধারের কাজে। গুন্ডাদের উৎকট আতিশয্যে বিদ্যুৎ পর্ষদের এক কর্মী নিহত হয়। টাকার হদিস মেলে না। লায়লার বাড়িতে রেখে আসা বৃদ্ধা দাদির সহায়িকা তার প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য লায়লার শয়নকক্ষে ঢোকে। প্রেমিকটি আবার সেই দুই গুন্ডার এক জন। হঠাৎই লায়লার বাড়িতে হাজির হন তার গানের শিক্ষক, তিনি ছাত্রবিক্ষোভে গান গাইবেন বলে হারমোনিয়ামটি নিতে চান। সহায়িকা ও তার গুন্ডা প্রেমিক শিক্ষকের হাতে হারমোনিয়াম তুলে দেয়। শিক্ষক সেই হারমোনিয়াম নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে গান গাওয়ার তোড়জোড় করতেই পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে তৎপর হয়। পুলিশের তাড়া খেয়ে শিক্ষক সেই টাকা-ভরা হারমোনিয়ামটি আন্দোলনের জায়গায় ফেলে আপন প্রাণ বাঁচান। এলোপাথাড়ি ইট-পাটকেলের মাঝখানে জনহীন রাস্তায় পড়ে থাকে টাকা-ভরা হারমোনিয়াম।

এর পর কাহিনি আবার অন্য বৃত্তে প্রবেশ করে। লায়লার দফতরে পিয়নের হত্যকাণ্ডের তদন্ত করতে আসেন এক সরকারি আধিকারিক। সঙ্গে তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট। সে আবার লায়লার সেই পুরনো প্রেমিক রানা। এর পর আর বলা যাবে না। স্পয়লার দেওয়া নেহাতই অসঙ্গত। গোয়েন্দা, গুন্ডা, পুরোনো প্রেমিক, স্বামীর সন্দেহ, হারানো টাকা— সব মিলিয়ে নাটক উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে তোলে। দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে তাল রেখে এগোতে থাকে ঘটনাস্রোত।

কী বলা যায় এমন ছবিকে? পশ্চিমের ‘কেপার মুভি’ ধারার সঙ্গে এর মিল অবশ্যই রয়েছে। একটি অন্যায়কে ঢাকতে ছবির মূল চরিত্র ক্রমাগত মিথ্যার জাল বোনে। মিথ্যার আবরণে নিজেকে আড়াল করতে চায় তার স্বামীও। টাকা হারানোর সঙ্গে লায়লার জীবনে এসে পড়ে গুন্ডাদের হুমকি, লোভী এবং ষড়যন্ত্রপ্রবণ সহকর্মীদের ক্ষুরধার সন্দেহ। এই বিপুল জটিলতার নাগপাশ থেকে লায়লা কী ভাবে মুক্তি পাবে বা আদৌ মুক্তি পাবে কি না— এই টানাপড়েন দর্শককে বাধ্য করে রাত জেগে সিরিজটি দেখতে। সিরিজটির ভরকেন্দ্র অবশ্যই লায়লা তথা জয়া আহসান। জয়া স্বভাবসিদ্ধ অভিনয় দক্ষতাতেই ফুটিয়ে তোলেন ছলনার জটিলমদির ছন্দকে। পরিচালক হিসেবে আসফাক নিপুনের সেরা কাজগুলির পঙ্‌ক্তিতে হয়তো ‘জিম্মি’কে ফেলা যাবে না। কারণ, ‘মহানগর’ বা ‘সাবরিনা’-র দমচাপা রহস্য এখানে নেই। তার বদলে রয়েছে ডার্ক হিউমার। গোটা সিরিজ জুড়ে কৌতুক ফল্গুস্রোতের মতো প্রবাহিত। সাবলীল চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং পার্শ্বচরিত্রের অভিনয়ও। একে পশ্চিমি ‘কেপার মুভি’র সঙ্গে এক পাতে বসানোই যায়। কারণ, এর মধ্যে ছড়িয়ে থাকে বাঙালিয়ানা আর অবশ্যই ‘ঢাকাইয়া’ রসবোধ। আর এখানেই এ সিরিজ়ের সাযুজ্য ‘কেপার’ ঘরানার সঙ্গে। উদ্ভট রসিকতা, বিটকেল কাণ্ডকারখানা নিয়েই এ সিরিজ। তবে এ-ও বলে রাখা ভাল, সিরিজ়ে চেনা গল্প, পরিণতিও অনুমেয়, এমন চিত্রনাট্যে নিপুণ কিছুটা হাতে তাস রেখেই খেলেছেন, যার অন্যতম কারণ দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষিত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আর লায়লার ‘কেপমারি’র কাহিনি কখনও সমান্তরাল, কখনও আবার পরস্পর সংযুক্তও। লক্ষণীয়, লায়লার কর্মক্ষেত্র। বিদ্যুৎ পর্ষদ এবং তার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কাহিনি পালাবদলের পরবর্তী বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত জটিলতা (যেখানে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে)-কে কি মনোগহিনে রেখেই উপস্থাপিত? পালাবদল সম্পর্কে কোনও মন্তব্য বা বিশ্লেষণ এ সিরিজ়ে নেই। এখানে পরিচালকের সংযম প্রশংসনীয়। রাজনীতি এখানে একাধারে প্রেক্ষিত এবং অনুঘটক। তবে ‘মহানগর’-এর পরিচালকের কাছ থেকে অন্তিমপর্বে কিছু ‘টুইস্ট’ আশা করা গিয়েছিল, যা এ সিরিজকে নিপুনের অন্য কাজের সমান্তরালে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ছবির অন্ত্যভাগ একান্ত ভাবেই অতিসরলীকৃত। সেখানে দর্শক হতাশ হতেই পারেন। তবে এ ছবিতে জয়ার অভিনয়ের পাশাপাশি আজাদের ভূমিকায় ইরেশ জাকের বা গুন্ডার ভূমিকায় এরফান মৃধা শিবলু দুর্দান্ত। অন্তিমের সরল সমাধানটুকু বাদ দিলে ‘জিম্মি’ হয়তো নিপুনের ‘মহানগর’ বা সাবরিনা’র পাশেই বসতে পারত।


Leave a reply