Select Page

‘এই ধরনের অভিযান নারীবিদ্বেষী আচরণকেই কেবল উসকে দিবে’

‘এই ধরনের অভিযান নারীবিদ্বেষী আচরণকেই কেবল উসকে দিবে’

নায়িকা পরী মনিকে আটক নিয়ে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অরুচিকর ‘নারী বিদ্বেষ’ ছেয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এমনকি আইনশৃংখলাবাহিনী ও সংবাদমাধ্যম এ অভিনেত্রীকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে তা নিয়েও সমালোচনা কম নয়।

‘জালালের গল্প’-খ্যাত নির্মাতা ও প্রযোজক আবু শাহেদ ইমন বিষয়টির নানান দিকে আলোকপাত করেছেন। এ নিয়ে ফেসবুকে তিনি দীর্ঘ পোস্ট দেন। বিএমডিবি পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো—

মূলত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষের বা ভক্তদের সাহায্য চেয়ে আগস্টের ৪ তারিখ বিকেল ৪টায় গ্রেফতার হবার পূর্বে চিত্রনায়িকা পরীমনির ৩১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের লাইভটি সম্প্রচার হবার পর দেখেছেন ৩৩.৯ মিলিয়ন লোক মানে ৩ কোটি ৯০ লক্ষ লোক (৩৯০০০০০০০)। (এই স্ট্যাটাস লিখার সময় অনুযায়ী ৭২ ঘণ্টারও কম সময়ে)। সাত লক্ষ ছয় হাজার (৭,০৬,০০০) লোক মন্তব্য করেছেন এই লাইভে।  ১৭ লক্ষ (১৭,০০,০০০) লোক বিভিন্ন রিয়েক্ট করেছেন। প্রায় ৯ লক্ষ লোক এটাকে ফানি ভেবেছেন, প্রায় ৭ লক্ষ লোক লাইক  চিহ্ন দিয়েছেন, প্রায় ৬৮ হাজার লোক ভালোবাসি চিহ্ন দিয়েছেন, কষ্ট পাওয়ার সাইন দিয়েছেন ৩৯ হাজার লোক, ২২ হাজার বলেছেন ওয়াও, ১৯ হাজার লোক রাগ করেছেন বিষয়টি নিয়ে এবং মাত্র ৮ হাজার লোক বিষয়টি নিয়ে কেয়ার চিহ্ন দিয়েছেন। পরীমনির ভেরিফাইড পেজে লাইক দিয়েছেন প্রায় ৯৪ লক্ষ লোক। উনার ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩৫ লক্ষ লোক।

আবু শাহেদ ইমন

সাত লক্ষ ছয় হাজার  কমেন্টের মধ্যে ৯০%  লোক পরীমনির লাইভ চলা অবস্থায় উনাকে নসিহত করেছেন, কিংবা ওই মুহূর্তে এইরকম একটি ট্রমা উনার প্রাপ্য বলে মূলত মতামত দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে কমেন্টকারীর প্রায় ৯৯ শতাংশই  পুরুষ। ১-২% বা সংখ্যার বিবেচনায় অনেক কম নারী কমেন্টকারীরা উনাকে বারবার পোশাক বদলে আর ভদ্র সভ্য ও শালীন পোশাকে আসার উপদেশ দিয়েছেন। লাইভ চলাকালেই পরীমনি পোশাক বদলে গ্রেফতারের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। উনার বাসার সামনে কঠোরতম লকডাউনের স্বাস্থ্য বিধি নিষেধ উপেক্ষা করেও শত শত সাংবাদিক ও লোক জড়ো হয়েছেন এবং উনাকে নিয়ে আদালতে যাওয়ার সময়ও মিডিয়া নজর রেখেছেন প্রতি মুহূর্তে।

আজকে একজন পুরুষ অপরাধী গ্রেফতার হলে তার বিষয়ে মানুষের ঢালাও মন্তব্যে এত এত নৈতিকতার শিক্ষা কি দেয়া হত? পরীমনিকে আইনের আওতায় আনার মধ্যদিয়ে ব্যক্তি পরীমনিকে না হয় শুধরে দিবে রাষ্ট্র, কিন্তু অন্যের গ্রেফতার প্রক্রিয়ার সময়ে প্রায় ৪ কোটি লোক আমরা এই যে প্রাক-গ্রেফতার ভিডিও দেখেও এটাকে খুব স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছি কিংবা ঢালাওভাবে মতামত প্রদান করে লাইভ চলা অবস্থায় উনার যৌনাঙ্গকে উল্লেখ করে সেখানে বিভিন্ন বস্তু ভরে দেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছি তাদের ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা কি পদক্ষেপ নিবেন? কেউ অন্যায় করলে তাকে আইনের আওতায় অবশ্যই আনতে হবে… কিন্তু এই আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়ায় সমাজে তার কি ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে তা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। সেই সাথে অন্যায়কে অন্যায় না বলার অভ্যেস আমাদেরকে নিজেদের অজান্তেই অন্যায়কারীর পক্ষে দাঁড় করিয়ে দিবে।

একজন সাধারণ নাগরিক যখন অপরাধী হবেন তাকে আইনের হাতে সোপর্দের প্রক্রিয়ায় তাকে এই যে কোটি কোটি লোকের সামনে রাষ্ট্র এক্সপোজ করে দিচ্ছে, মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে ব্যক্তির অধিকার এতে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং এইটা করার অধিকার কিন্তু রাষ্ট্রকে সাংবিধানিক ভাবে দেয়া হয়নি। আমাদের সংবিধানে বলা আছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মর্যাদা ও সম্মান আছে। নাগরিকের সেই সম্মান ও মর্যাদা রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। একটি সুস্থ সমাজে কারো অন্যায় ধরা পড়লে আমাদের উচিত অন্যায়ের উৎস অনুসন্ধান করা, অন্যায় কেন হল এইটা নিয়ে মন খারাপ করা, এই ধরনের অন্যায় ভবিষ্যতে কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে তার প্রতিষেধক বের করা। কিন্তু, তা না করে যখন সেটিকে একটি জাতীয় উচ্ছ্বাসের বিষয় বানিয়ে ফেলি আমরা কিংবা ঘটনাটি আর অনেক নাগরিকের অসংবেদনশীল আচরণকে উসকে দেয়… সেটি কিন্তু ভবিষ্যতে এই ধরনের অন্যায় আগের চাইতে আর শক্তিশালী ভাবে ফিরে আসার সম্ভাবনাই বাড়ায় কেবল। পরীমনি বা গত কিছুদিন ধরে সম্ভাব্য নারী অপরাধীদের বিষয়ে চলমান অভিযানে মিডিয়া, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও অসংবেদনশীল জীবদের মন্তব্যে অন্যায় কমে যাবার কোন সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে আর দেখা যাচ্ছেনা। বরং, আমার কাছে গত কিছুদিন ধরে চলা এই ধরনের অভিযান গুলো সমাজে খুবই মিসোজিনিস্ট  বা নারীবিদ্বেষী আচরণকেই কেবল উসকে দিবে বলে মনে হচ্ছে।


মন্তব্য করুন