এক শহর, এগারো চিঠি!
নামঃ ইতি, তোমারই ঢাকা – Sincerely Yours, Dhaka (2019)
ধরণঃ এন্থলজি ড্রামা
গল্প ও চিত্রনাট্যঃ নুহাশ হুমায়ুন, রফিকুল ইসলাম পল্টু, রাহাত রহমান, তানভীর চৌধুরী, রবিউল ইসলাম রবি, সরদার সানিয়াত হোসেন, গোলাম কিবরিয়া ফারুকী, মীর মোকাররম হোসেন, তানভীর আহসান, মনিরুল ইসলাম রুবেল, তানিম নূর এবং কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়।
পরিচালনাঃ নুহাশ হুমায়ূন, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, রাহাত রহমান, রবিউল ইসলাম রবি, গোলাম কিবরিয়া ফারুকী, মীর মোকাররম হোসেন, তানভীর আহসান, মাহমুদুল ইসলাম, তানিম নূর, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং সালেহ সোবহান অনীম।
প্রযোজনা ও পরিবেশনাঃ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি.
অভিনয়ঃ মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, ফজলুর রহমান বাবু, ইরফান সাজ্জাদ, নাজিবা বাশার, অর্চিতা স্পর্শিয়া, ইয়াশ রোহান, এ্যালেন শুভ্র, মুশফিক আর. ফারহান, শ্যামল মাওলা, সোহানা সাবা, সরদার সানিয়াত হোসেন, শাহতাজ মনিরা হাশেম, রঙ্গন রিদ্দো, ত্রপা মজুমদার, শাহনাজ সুমী, মনোজ কুমার প্রামাণিক, দোয়েল ম্যাশ, ইন্তেখাব দিনার, শতাব্দী ওয়াদুদ, ইরেশ যাকের, গাউসুল আলম শাওন, লুৎফর রহমান জর্জ, মোস্তফা মনওয়ার, ইলোরা গওহর, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রওনক হাসান প্রমুখ।
শুভমুক্তিঃ ১৫ই নভেম্বর, ২০১৯
দেশঃ বাংলাদেশ
ভাষাঃ বাংলা
?নামকরণঃ
এই সিনেমায় থাকা এগারোটি গল্প মূলত ঢাকা শহরে বাস করা এগারো ধরনের মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করছে। শহরের বুকে তাদের প্রত্যেকের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার যে যন্ত্রণা সেটা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সিনেমা দেখার সময় মনে হচ্ছিল, এরা যেনো সবাই ঢাকার হয়ে সমগ্র দেশের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, তাদের জীবনযাপনের ধরণটা যেনো কেউ দেখে। নামকরণ হিসেবে তাই “ইতি, তোমারই ঢাকা” আমার কাছে যথার্থই মনে হয়েছে।
?কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপঃ
এন্থলজি ফিল্ম প্রকৃতপক্ষে কীরকম সেটা নিয়ে অনেকের মনে অনেক কনফিউশন থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ এর আগে গত ছয় দশকে আমাদের দেশে কোনো এন্থলজি সিনেমা হয় নি, যেখানে আমাদের প্রতিবেশী কোলকাতাতে সেই ষাটের দশকেই “তিনকন্যা” নামে একটি এন্থলজি সিনেমা তৈরী হয়েছে। পুরো বিশ্বব্যাপৗ এন্থলজি জনরাটি যেখানে একটি অতি পরিচিত জনরা, সেখানে কেনো আমাদের দেশের নির্মাতারা এজনরায় কাজ করার চেষ্টা আগে করেনি সেটা বেশ চিন্তাভাবনার বিষয়।
যদি সহজ ভাষায় বলি, এন্থলজি ফিল্ম বা অমনিবাস ফিল্ম বলতে আমি বুঝি কয়েকটা ছোটগল্পকে পরপর জুড়ে দিয়ে একটি পূর্ণ্যদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়ে ফেলা। এখন এক্ষেত্রে এমন কিছু ছোটগল্প জুড়ে দেওয়া হয় যেগুলো মূল ভিক্তি একইরকম থাকে; যেমনঃ কোনো পরিচিত জায়গা বা শহর, কিংবা কোনো অঞ্চলের ভুতপ্রেত, কোনো বস্তু কিংবা কোনো এক মানুষ ইত্যাদি। সাধারণত এন্থলজি সিনেমায় একাধিক গল্পে ভিন্ন ভিন্ন অভিনেতা ও পরিচালক থাকেন, তবে যদি এক পরিচালক ও একই অভিনেতা একাধিক গল্পের যথাক্রমে পরিচালনা ও অভিনয় করেন তবে সেটাও এন্থলজি সিনেমা বলা যেতে পারে। সবমিলিয়ে এন্থলজি সিনেমার প্রধান শর্ত হলো, এখানে একাধিক গল্প থাকবে যেগুলো একত্র করে একটি প্যাকেজ তৈরী করা হয়।
“ইতি, তোমারই ঢাকা” তৈরির পেছনে মূল ভাবনা “জালালের গল্প” খ্যাত পরিচালক আবু শাহেদ ইমন এর, তার উদ্বেগেই মূলত এগারোজন সম্ভাবনাময় তরুণ পরিচালক একত্র হতে পেরেছেন। “ইতি, তোমারই ঢাকা” দেখার পর ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, এছবিটি ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আমেরিকান এন্থলজি ফিল্ম “নিউ ইয়র্ক, আই লভ ইউ” থেকে বেশ খানিকটা অনুপ্রাণিত। দুইটি সিনেমার গঠনগত দিক থেকে বেশ খানিকটা মিল পাওয়া যায়। যদিও ওখানে রোম্যান্সের ওপর কিছুটা জোর দেওয়া হয়েছে, আর এখানে জোর দেওয়া হয়েছে মানুষের কষ্ট বা ইমোশনের ওপর।
যেহেতু এখানে মোট এগারোটি গল্প আছে তাই এগুলো কেমন ছিল তা নিচে ২-১ লাইনে লেখার চেষ্টা করলামঃ
১. ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট
গল্পঃ নুহাশ হুমায়ূন
“ইতি, তোমারই ঢাকা” এর প্রথম গল্প ছিল এটি। এখানে বড়পর্দায় অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কাজ করা একজন অভিনেতার লাইফস্ট্রাগল দেখিয়ে গল্পটি শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে গল্পটি স্থানান্তরিত হয় এক দর্জির দিকে, যিনি অভাব এবং নিজ পেশার প্রতি সমাজের কটুদৃষ্টির কারণে ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে এই দুটি মানুষ কীভাবে একে অন্যের উপকার করতে পারেন সেটাই দেখা যায়। গল্পের দিক থেকে “ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট” কে আমার মনে হয়েছে বাকি এগারো ছবির তুলনায় অন্যতম সেরা। যথেষ্ট কমেডি ও হিউমারাসের সাথে এটি উপস্থাপন করায় শুরুতেই এমন একটি গল্প দর্শককে নড়েচড়ে বসতে এবং সিনেমার সাথে নিজেকে জুড়ে নিতে সাহায্য করে।
২. চিয়ার্স
গল্পঃ রফিকুল ইসলাম পল্টু
সদ্য ব্রেকআপ হওয়া এক মেয়ে ও তার বান্ধবী ব্যাপক মনঃকষ্টে ভুগতে থাকা অবস্থায় ঠিক করে তারা মদ্যপান করবে, এর আগে তারা শুনেছে এতে নাকি মনের কষ্ট দূর হয়। এখন ঢাকা শহরে এমনিতেই মদ্যপান করা একধরনের অপরাধের শামিল, তারওপর একজন নারী যদি মদ্যপান করে তবে তাকে কতটা বাঁকাচোখে দেখা হয় সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না… তো দুই বান্ধবী মিলে কীভাবে সেই কঠিন কাজটা করে সেটাই দেখতে পাওয়া যায়। মূলত এশহরে নারীদের কেমন চোখে দেখা হয় সেটাই এগল্পের দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এগল্পে অর্চিতা স্পর্শিয়ার দেওয়া একটি সংলাপে জনপ্রিয় সিনেমা আয়নাবাজির রেফারেন্স টেনে হিউমারের সৃষ্টি করা হয়েছে, বেশ উপভোগ করেছি। সবমিলিয়ে এগল্পটি আমার কাছে মোটামুটি ভালো লেগেছে।
৩. জীবনের GUN
গল্পঃ রাহাত রহমান
নামকরণটাই বড্ড ইউনিক, এখানে GUN মানে হলো বন্দুক। বন্দুক হাতে এলেই যে ভালো শ্যুটার হওয়া যায় বিষয়টি তেমন না। ট্রিগারে চাপ দেওয়ার জন্য বুকে সাহস থাকা লাগে, গায়ে জোর থাকা লাগে। বাকি সব গল্পের তুলনায় এটি গভীরতার দিক থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও এর উপস্থাপনা দারুণ। খুব উপভোগ করেছি।
৪. মাগফিরাত
গল্পঃ তানভীর চৌধুরী ও রবিউল ইসলাম রবি
এক সাধারণ ড্রাইভারের মানসিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে এইশহরের বাস্তবতার নানারকম দ্বন্দ্ব দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাকি দশ গল্প থেকে এই গল্পটি একটু অন্যরকম সৃজনশীল চিন্তাভাবনার ছাপ রেখে যায়, যদিও গল্পটি এভাবে মাঝে বসানোটা আমার পছন্দ হয়নি। আমার মতে এগল্পটি ছবির একদম শুরুতে কিংবা দ্বিতৗয়ার্ধের শুরুতে কিংবা একদম শেষে বসানো উচিত ছিল। পরপর তিনটি গতিশীল চিত্রনাট্যের পর “মাগফিরাত” এর মতো গভীর চিন্তাভাবনার গল্প সামনে আসায় এর সাথে কানেক্ট করতে বেশ সমস্যা হয়েছে।
৫. সাউন্ডস গুড
গল্পঃ সরদার সানিয়াত হোসেন ও গোলাম কিবরিয়া ফারুকী
নাটক বা সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় পর্দার পেছনে ভ্রুম বা মাইক সামলান এমন একজন কলাকুশলীর পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে গল্পটি দেখানো হয়, যার কাছে অভি শক্তিশালী একটি মাইক্রোফোন থাকে যার মাধ্যমে তিনি রুমের বাইরে বসে ভেতরের কথাবার্তা শুনে ফেলতে পারেন। আইডিয়াটি শুনতে ইউনিক মনে হলেও আদতে যা দেখানো হয়েছে তা ভালো লাগেনি। এটি এই সিনেমার অন্যতম দূর্বল উপস্থাপনের গল্প বলা চলে।
৬. অবিশ্বাসের ঢাকা
গল্পঃ মীর মোকাররম হোসেন
দ্বিতৗয়ার্ধের শুরু হয় এই গল্প দিয়ে। এগল্পটি খুবই শক্তিশালী একটি বার্তা দেয়, এশহরে কারো বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে অবশ্যই নিজের দিকটা আগে চিন্তাভাবনা করে নিতে হয়, অন্যথায় অন্যকে টেনে তুলতে গিয়ে নিজে গর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ঢাকা শহরে এরকম ঘটনা অহরহ হয়, তাই খুব সহজেই এর সাথে কানেক্ট করতে পেরেছি। খুবই ভালো লেগেছে এই গল্পটি।
৭. আকাশের পোষা পাখিরা
গল্পঃ তানভীর আহসান
শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মা ও মেয়ের গল্প। মায়ের ছেলে কোনো এক কারণে জেলহাজতে আটক, সেইসাথে মেয়ে অন্য এক ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে এখন ব্লাকমেইলের শিকার হচ্ছেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও নিজ ছেলেমেয়েদের সামলাতে এক মা কে কতটা কষ্ট করতে হয় সেটা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গল্পটি বেশ হৃদয়স্পর্শী করে উপস্থাপন করায় এগল্পটির সাথে সহজেই নিজেদের জুড়ে নেওয়া যায়। এগল্পের শেষ টা অসম্পূর্ণ রাখা হয়েছে।
৮. ঢাকা মেট্রো
গল্পঃ মাহমুদুল ইসলাম
এক মধ্যবিত্ত যুবকের স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি, সেইসাথে তার গাড়িটাও চুরি হয়ে গেছে। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যখন তার প্রচুর টাকার প্রয়োজন, তখন তার সাথে পরিচয় হয় এক চোরাকারবারির। এখন তিনি কীভাবে সেই গাড়িটি উদ্ধার করেন সেই গল্পই এখানে দেখা যায়। গল্পের শেষটা একটু ওভার দ্য টপ গেলেও সম্বমিলিয়ে আমি উপভোগ করেছি।
৯. এম ফর মানি/মার্ডার
গল্পঃ তানিম নূর
নাম শুনলে যদিও আলফ্রেড হিচককের জনপ্রিয় ছবি “ডায়াল এম ফর মার্ডার” এর কথা মনে পড়ে, আদতে গল্প দুটির মধ্যে তেমন মিল নেই। ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া উচুশ্রেণির এবং নিচুশ্রেণির দুই কর্মকর্তার মধ্যকার মানসিক সংঘর্ষ দেখানো হয়েছে এই গল্পে। এই গল্পে থ্রিল এবং সাসপেন্স দুটোই যথেষ্ট আছে, যা অন্য দশ গল্প থেকে এটিকে আলাদা করেছে। অনেক উপভোগ করেছি।
১০. জিন্নাহ ইজ ডেড
গল্পঃ কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়
এটা মোটামুটি সবাই জানেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করায় ঢাকা শহরের মিরপুর, মোহাম্মাদপুর সহ নানা জায়গায় ভারতীয় মুসলিম বিহারীরা এখনো বসবাস করছে। এগল্পটি তাদের নিয়েই। তাদেরকে বর্তমান সমাজে কতটা নিচুস্তরের ভাবা হয় সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। এর আগে আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে বিহারীদের নিয়ে কোনো কাজ হয়নি, সেহিসেবে এটি খুবই সাহসী নির্মাণ। বিশেষকরে যারা মিরপুর কিংবা মোহাম্মাদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের আশেপাশে থাকেন তারা বুঝতে পারবেন ওখানে গিয়ে শ্যুট করা কতটা কষ্টসাধ্য একটি কাজ। ভালো লেগেছে।
১১. যুথী
গল্পঃ মনিরুল ইসলাম রুবেল
এছবির শেষ গল্প, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এছবি খুবই শক্তিশালী বার্তা দেয়। গল্পের মাঝে টুইস্ট আছে, শক্তিশালী সংলাপ আছে। প্রথম গল্প “ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট” এর পাশাপাশি “যুথী” কেও মনে হয় এই ছবির অন্যতম সেরা গল্প।
সংলাপের দিক থেকে “ইতি, তোমারই ঢাকা” অত্যন্ত শক্তিশালী। “ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট” এ মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের বলা “সিনেমার পর্দায় দেখা হবে”, “চিয়ার্স” এ নওফেলের দেওয়া “হেব্বি কড়া!”, “ঢাকা মেট্রো” তে শতাব্দী ওয়াদুদের দেওয়া “আপনের চারপাশে তো দেখতেছি শনি লাইগা রইছে”, “এম ফর মানি/মার্ডার” এ গাউসুল আলম শাওনের দেওয়া “আমারে ফাঁসানো এতো সহজ না, এই মাঠে অনেকদিন ধরে খেলতেছি” এবং ইরেশ যাকেরের দেওয়া “আবিদুর রহমান জানতো না, এস্কেপ রুট আমারও সবসময় খোলা থাকে”, “জিন্নাহ ইজ ডেড” এ লুৎফর রহমান জর্জের দেওয়া “কিসকো কাটকে রাখেগা বে?”, “যুথী” তে নুসরাত ইমরোজ তিশার দেওয়া “এর পরেরবার নিয়ে আসলে ভাড়াটা তুমি দিও, গাড়ির সাথে আমারটাও” মনে রাখার মতো কিছু সংলাপ।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭৫।
.
?পরিচালনাঃ
“ইতি, তোমারই ঢাকা” এর মধ্যদিয়ে মোট এগারো জন পরিচালকের বড়পর্দায় অভিষেক হলো। এদের সবাই দারুণ ট্যালেন্টেড এবং ভীষণ সম্ভাবনাময়। তবে যদি তুলনা করি তবে এদের মধ্যে আমার নুহাশ হুমায়ূন, তানভীর আহসান, তানিম নূর, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং সালেহ সোবহান অনীমের পরিচালনা সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে। তবে বাকি যারা ছিলেন তারাও মন্দ না, একবারে দূর্বল পরিচালনা তেমন কারো চোখে পড়েনি।
.
?অভিনয়ঃ
“ইতি, তোমারই ঢাকা” তে প্রায় অর্ধশতাধিক অভিনেতা ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, বাংলা ছবির ইতিহাসে এর আগে কখনো এক সিনেমায় এতো দক্ষ অভিনেতাদের একত্রে পাওয়া যায়নি। এতো এতো অভিনেতাদের ভীড়ে যথেষ্ট দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে বেশকিছু অভিনেতা/অভিনেত্রী তাদের অভিনয়ের ছাপ ফেলে যেতে পারেননি। উদাহরণ হিসেবে ইয়াশ রোহান, সোহানা সাবা, ইলোরা গওহর প্রমুখের নাম নেওয়া যায়; এরা এতোটাই কম স্ক্রিণটাইম পেয়েছেন যে সিনেমায় তাদের খুজেঁ বের করা বেশ কষ্টকর। আবার অনেকে এতো এতো গুণী মানুষদের মাঝেও নিজের জাত চিনিয়েছেন।
এদের মধ্যে সবথেকে বেশি চমকে গিয়েছি “জীবনের GUN” এর অভিনয় করা এ্যালেন শুভ্রের অভিনয় দেখে। ওনার স্ক্রিণপ্রেজেন্স এতোটা সুন্দর, এর আগে কেন জানি কখনোই তেমন একটা চোখে পড়েনি। মুগ্ধ হয়েছি “ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট” এ অভিনয় করা মোস্তাফিজুর নূর ইমরানকে দেখে, তাকে এর আগে “আলফা” নামক ছবিতে তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্র রূপদান করতে দেখেছিলাম। “ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট” এ তার সহশিল্পী ছিলেন ভার্সেটাইল অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু, তাকে নিয়ে তো আর তেমন কিছু বলার বাকি নেই। এর মধ্যে থেকেও মোস্তাফিজুর নূর ইমরান তার স্বকীয়তা আলাদাভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
মুগ্ধ হয়েছি “আকাশের পোষা পাখিরা” গল্পের মায়ের চরিত্র রূপদান করা ত্রপা মজুমদারের অভিনয় দেখে। তার দেওয়া ডায়লগ ডেলিভারি খুবই মনোমুগ্ধকর! বাংলা ভাষাটা যেনো এরকম সুন্দরভাবে বলার জন্যেই তৈরী হয়েছে, তার মুখে শোনা সংলাপগুলি শুনলে তেমনটাই লাগে।
“ঢাকা মেট্রো”, “এম ফর মানি/মার্ডার” ও “জিন্নাহ ইজ ডেড” এই তিন গল্পে দুজন করে অভিনেতা পরস্পরের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। প্রথম গল্পে ইন্তেখাব দিনার ও শতাব্দী ওয়াদুদ, দ্বিতীয় গল্পে গাউসুল আলম শাওন ও ইরেশ যাকের, তৃতীয় গল্পে লুৎফর রহনান জর্জ ও মোস্তফা মনওয়ার… এই ছয় জন দারুণ অভিনয় দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে ইন্তেখাব দিনারের শেষ সিনে দেখানো রহস্যময় হাসি অনেকদিন চোখে লেগে থাকবে। সেইসাথে মোস্তফা মনওয়ারের মতো আরো একজন অভিনেতা পেলাম যারা শক্তিশালী সহ-অভিনেতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে পারেন। তাকে সবশেষ দেখেছিলাম “লাইভ ফ্রম ঢাকা” তে প্রধান চরিত্র রূপদান করতে।
“মাগফিরাত” এ শ্যামল মাওলা, “অবিশ্বাসের ঢাকা” তে মনোজ কুমার এবং “যুথী” তে নুসরাত ইমরোজ তিশা ও রওনক হাসান ন্যাচারাল অভিনয় দেখিয়েছেন। এই চরিত্রগুলি এরকম ন্যাচারাল অভিনয় দাবি করে।
অর্চিতা স্পর্শিয়া ও মুশফিক আর.ফারহানকে এরকম অভিনয় করতে এর আগেও দেখেছি, তাই আমার কাছে বিশেষকিছু লাগেনি। একইরকম লেগেছে শাহনাজ সুমির অভিনয়, যাকে আমরা গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত আপকামিং ছবি “পাপ পুন্য” তে প্রধান চরিত্রে দেখতে পাবো। এর থেকে শাহতাজ মনিরা হাশেম কে বরং ভিন্নকিছু চেষ্টা করতে দেখলাম, তিনি তার প্রচলিত বোকাসোকা ঢংঙ্গি অবতার থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন, অভিনয় তেমন একটা তৃপ্তি দেয়নি তবে তার এই চেষ্টা বেশ স্বস্তিদায়ক লাগলো।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৮০।
?কারিগরিঃ
কারিগরি দিকটি আমার কাছে ভালো-খারাপ মিলিয়ে মোটামুটি লেগেছে। মোর্শেদ বিপুল, তানভীর হোসেন শোভন, বরকত হোসেন পলাশ, তুহিন তমিজুল, ফরহাদ হাসান জিকো, খায়ের খন্দকার, ইশতিয়াক হোসেন সহ আরো অনেকে ছিলেন এসিনেমার ক্যামেরার দায়িত্বে। “জীবনের GUN” এ দেখানো স্লো মোশন ক্যামেরাওয়ার্ক বেশ ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে “সাউন্ডস গুড” এ দেখানো জানালার ফাঁক গলে দেখানো সিক্যুয়েন্স, এছাড়াও “আকাশের পোষা পাখিরা” গল্পে দেখানো ওয়ান টেক শটও বেশ চমকপ্রদ লেগেছে।
“জীবনের GUN” এর নানা রঙের কালারবিন্যাস দেখতে খুবই সুন্দর লেগেছে, এছাড়া “এম ফর মানি/মার্ডার” এর সাদাকালো চিত্রায়ন আলাদা বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি করেছে। কারিগরি দিকের মধ্যে সবথেকে দূর্বল দিক লেগেছে এসিনেমায় থাকা সবগুলো গান ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। সিনেমাটোগ্রাফি কিংবা এডিটিং যতটা মুগ্ধতা ছড়ায় এছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে সেই মুগ্ধতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া যেহেতু সবগুলো গল্পই ঢাকা শহরকেন্দ্রিক, সেক্ষেত্রে ঢাকা শহর দেখতে কেমন এমন কিছু লং শট রাখা উচিত ছিল বলে মনে করি। যতটুকু ঢাকার পরিবেশ দেখানো হয়েছে তা যথেষ্ট নয়।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।
.
?বিনোদন ও সামাজিক বার্তাঃ
“ইতি, তোমারই ঢাকা” একইসাথে একজন দর্শককে বিনোদিত করবে, সেইসাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামাজিক বার্তাও দিবে। আমাদের সমাজে নারীদের এখনো কোন চোখে দেখা হয় সেই বার্তা পাওয়া যায় “চিয়ার্স” ও “যুথী” তে, একজন মায়ের প্রকৃত রূপ দেখতে পাওয়া যায় “আকাশের পোষা পাখিতে”। এছাড়া “ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট”, “মাগফিরাত”, “সাউন্ডস গুড”, “এম ফর মানি/মার্ডার”, “অবিশ্বাসের ঢাকা”, “জিন্নাহ ইজ ডেড” যথাক্রমে এক এক্সট্রা শিল্পীর গল্প বলে, এক গরিবের গল্প বলে, এক ড্রাইভারের গল্প বলে, এক সাউন্ডম্যানের গল্প বলে, এক মধ্যবিত্ত পরোপকারীর গল্প বলে, কর্পোরেট জব করা এক কর্মচারীর গল্প বলে, সবশেষে কিছু বিহারী জনগোষ্ঠীর কথা বলে। এদের দিয়েই হয়তো পুরো ঢাকা শহরের চিত্র ফুটে ওঠেনি, কিন্তু অনেকখানি আন্দাজ পাওয়া যায় ঢাকা শহরের জীবনযাত্রা নিয়ে আমরা কতটা অসন্তুষ্ট।
নাম উল্লেখ করা গল্পগুলি যেমন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বার্তা বহন করে ঠিক তেমনি “জীবনের গান” এর মতো ক্রাইম ঘরানার গল্প যথেষ্ট এন্টারটেইন করে। একদম প্রথম দুটি গল্প “ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট” ও “চিয়ার্স” এ যথেষ্ট হিউমার ও কমেডি রয়েছে যা বিনোদিত করে। এছাড়া “জিন্নাহ ইজ ডেড” এর মতো সিরিয়াস গল্পের ভেতরে হিউমার রাখা হয়েছে যা দেখে মজা এসে যায়।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭৫।
.
?ব্যক্তিগতঃ
“ইতি, তোমারই ঢাকা” তে থাকা এগারোটি গল্পই যে সবাইকে সমানভাবে সন্তুষ্ট করবে, বিষয়টি তেমন না। এটি একদমই সম্ভব না, বাইরের দেশে যে এন্থলজি ফিল্মগুলো হয় সেখানে কখনোই শুনি নাই সব গল্প সবাই সমানভাবে নিয়েছে। সবমিলিয়ে “ইতি, তোমারই ঢাকা” ঢালিউডের প্রেক্ষাপটে খুবই ভালো একটি প্রচেষ্টা। একেবারে মাস্টওয়াচ কিছু হয়েছে তা বলবো না, তবে এন্থলজি জনরার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নির্মাতারা এছবি অনুসরণ করে এর থেকে ভালো কিছু দিতে পারবে।
.
রেটিংঃ ৭.৫/১০
.
?ছবিটি কেন দেখবেনঃ
এক টিকেটে এগারো ছবি দেখার সুযোগ সবসময় আসে না, একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন কেমন লাগে। যেহেতু প্রতিটি গল্পই ১০-১২ মিনিটের, তাই এছবি আপনাকে বিরক্তি লাগার সুযোগ দিচ্ছে না। খুব কম সময়েই একটি গল্প তার পরবর্তী গল্পে স্থানান্তরিত হচ্ছে। যারা ধুমধারাক্কা বাণিজ্যিক ছবির বাইরে গিয়ে একটু অন্য ঘরানার ছবি দেখতে পছন্দ করেন, তারা আশাকরি এছবিতে নতুনত্ব খুজেঁ পাবেন।