‘খাঁচা’ কেন প্রচারণা ছাড়াই মুক্তি পায়?
এ প্রশ্ন শুধু শুক্রবার মুক্তি পাওয়া আকরাম খান পরিচালিত ‘খাঁচা’ নিয়ে নয়, ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সব সিনেমার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানটি সাধারণত কম বাজেটের সিনেমা নির্মাণ করে, নিজস্ব চ্যানেলে প্রিমিয়ার করেই টাকা তুলে আনে। কিন্তু টিভিতে সিনেমা দেখে দর্শক সন্তুষ্ট হয়েছে— এমন আলাপ শোনা যায়নি কখনো।
ইমপ্রেসের বেশির ভাগ সিনেমাই মুক্তির আগে দর্শক আগ্রহ জাগায় না। কারণ এর নির্মাণ নিয়ে তারা আগাম কোনো তথ্য পান না। মানও ততটা সুবিধার নয়। বছরে ‘খাঁচা’ বা ‘অজ্ঞাতনামা’র মতো দুই-তিনটি সিনেমা আলোড়ন তোলে। নির্মাণ, নির্মাতা, গল্প বা তারকার গুণে। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রচারণা ও হলের অভাব দর্শক পর্যন্ত পৌঁছে না। তবে হ্যাঁ, মনের মানুষ বা শঙ্খচিলের মতো যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে ইমপ্রেসের প্রচারণার অভাব হয় না।
নানা কারণে অনেক সিনেমাকে দর্শক ‘নাটক’ হিসেবে অভিহিত করে। এতে ইমপ্রেসের দায় রয়েছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি হলে প্রদর্শনের চেয়ে সিনেমাকে টেলিভিশন কন্টেন্ট আকারে গুরুত্ব দেই। ফলে সিনেমার পরিবেশে সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হন দর্শক। বুঝতে পারেন না ভিন্ন ধারার নির্মাণে সিনেমাটিক ইফেক্ট কেমন হয়ে থাকে।
আগের বছর ‘অজ্ঞাতনামা’র পাইরেটেড কপি ইউটিউবে প্রকাশের পর রীতিমত ঝড় উঠে অনলাইনে। অন্যদিকে একাধিক দর্শকজয়ী সিনেমাটি হুট করেই মুক্তি দেওয়া হয় কয়েকটি হলে। একই ঘটনা ঘটেছে ‘খাঁচা’র ক্ষেত্রে। মাত্র দুইদিন আগে জানানো হয় ২২ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাবে সরকারি অনুদানের ‘খাঁচা’। অথচ এটি ছিল বছরের অন্যতম প্রতীক্ষিত সিনেমা। হল পেয়েছে মাত্র ৭টা। তার মধ্যে ঢাকায় একমাত্র বসুন্ধরা সিনেমা হলের সিনেপ্লেক্সে দেখা যাচ্ছে। সেখানে মাত্র দুটি শো পেয়েছে দিনপ্রতি। অন্যদিকে একই সপ্তাহে সিনেপ্লেক্সসহ ঢাকার বড় বড় হলগুলোতে প্রদর্শিত হচ্ছে ভারতীয় সিনেমা ‘পোস্ট’। প্রশ্ন উঠতেই পারে— ঢাকার বাইরে এ সিনেমা কারা দেখবে? তাছাড়া অন্য ধারার সিনেমাগুলো ঢাকাই আলোড়ন তুললেই অন্য জেলা শহরগুলোতে তার ঢেউ লাগে।
সব মিলিয়ে প্রশ্ন জেগেছে বাংলাদেশের ম্রিয়মান সিনেমার বাজারে আলোকিত মুভিগুলো নিয়ে ইমপ্রেসের এমন কৌশলের পেছনে কী কারণ রয়েছে? একে স্রেফ ‘প্রতারণা’ও বলা যায় সিনেমা ও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাথে। যার কারণে সুনির্মাতারা দর্শক পর্যন্ত পেতে পারছেন না, দর্শক রুচিরও পরিবর্তন ঘটছে না।
এদিকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সিনেমা হলে মুক্তি না পাওয়ায় অনেকে ‘খাঁচা’র বদলে দেখছেন ভারতীয় ‘পোস্ত’। অনেক দর্শক জানিয়েছেন সিনেপ্লেক্সে ‘খাঁচা’র টিকিট না পেয়ে তারা ‘পোস্ত’ দেখেছেন।
এবার পড়ে নিন এ সিনেমা নিয়ে শিক্ষক ও গবেষক ফাহমিদুল হকের ফেসবুক স্ট্যাটাস—
“ঋত্বিকের নানান চলচ্চিত্র থেকে আজকের ‘রাজকাহিনী’ — কলকাতায় দেশভাগ নিয়ে যথেষ্ট চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিশ্চয়ই আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও মহান ঘটনা, কিন্তু ১৯৪৭ দেশবিভাগও আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনোযোগ পুরোটাই নিয়ে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৪৭ প্রাপ্য মনোযোগ পায়নি। ফলে ১৯৭১ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, কিন্তু ১৯৪৭ নিয়ে কাহিনীচিত্র নির্মিত হয়েছে মাত্র দু’টি। তাও আবার দ্বিতীয়টি মুক্তি পাচ্ছে আগামীকাল। তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’র (১৯৯৯) পর আকরাম খানের ‘খাঁচা’ মুক্তি পাচ্ছে আগামীকাল।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ছবিটি কেমন হয়েছে, তা না দেখেই বলা যায় এই মুক্তির তাৎপর্য অনেক। অথচ এই ছবি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। দুঃখজনক। দেশবিভাগের গল্প, এছাড়াও ক্যাম্পেইন উপযোগী আরও অনেক কিছু ছিল এই ছবিতে — হাসান আজিজুল হকের কাহিনী, ‘ঘাসফুল’ চলচ্চিত্রের পরিচালকের দ্বিতীয় ছবি, অভিনয়ে আছেন জয়া ও আজাদ আবুল কালাম — এগুলোকে ক্যাম্পেইনের উপাদান বানানো যেত।
কিন্তু প্রযোজক ইমপ্রেস টেলিফিল্ম কিছুই করলো না। আমার বিবেচনায় প্রযোজক হিসেবে ইমপ্রেস খুবই বাজে। বহুদিন ধরে তারা প্রচুর ছবি প্রযোজনা করেছেন, তাদের কাছে গেলে কেউ খালি হাতে ফেরেও না। কিন্তু ছবির বিপণন নিয়ে কোনো শক্ত অবকাঠামো এখনও দাঁড় করায় নি। ফেসবুক নিউজফিডে কখনোই ইমপ্রেসের কোনো ছবির তথ্য আসে না। শহরে তেমন পোস্টারও চোখে পড়লো না। তারা সব ছবিকেই টেলিভিশনের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের মধ্যে সীমিত রাখে, দুয়েকটা হলে প্রতীকী মুক্তি দেয়, দুয়েকটা ফেস্টিভালে পাঠায় কি পাঠায় না, তারপর তারা ছবিকে স্ট্যাপল করে করে ফেলে রাখে। সব ছবিই তাদের কাছে সমান।এই ছবিটিকে নিয়ে পৃথক একটি ক্যাম্পেইন স্ট্র্যাটেজি তারা গ্রহণ করতে পারতো।
আসুন আমরা ‘খাঁচা’ দেখি, আকরাম খানকে উৎসাহিত করি। আমি ছবি না দেখেই বলতে পারি, আকরাম খান খারাপ ছবি বানাননি। তিনি খারাপ ছবি বানাতে পারেন না।”