‘তুফান’ কোথাও দাপুটে, কোথাও আবার জমেনি
[স্পয়লার অ্যালার্ট: আলোচনার সুবিধার্থে গল্পের কিছু অংশ উল্লেখ করা হয়েছে]
তুফান; পর্দার সামনে— শাকিব খান, মাসুমা রহমান নাবিলা, মিমি চক্রবর্তী, মিশা সওদাগার, ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরী, গাজী রাকায়েত ও অন্যান্য, পর্দার অন্তরালে— রায়হান রাফী
মুঠোফোনের পর্দায় তুফানের ঝাপটা
খুব সম্ভবত একটা মোশন পোস্টার দিয়েই তুফানের পূর্বাভাস; তারপর শাকিব খানের লুক। তবে তুফান যে ভালোই ঘনীভূত হচ্ছে তা বোঝা যায় ৭ মে মুক্তি পাওয়া টিজে। সাধুভাষার সংলাপ, শ্রুতিমধুর টাইটেল ট্র্যাক, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল আর কালার টোনের পার্থক্যের মাধ্যমে সিনেমার চরিত্রগুলোর পাওয়ার গ্যাপকে তুলে ধরা, চঞ্চল চৌধুরীর মাধ্যমে টেনশন রিলিজ করা আর এরপর শেষ সিনে শাকিবের এগ্রেসন দেখিয়ে আরো হাই টেম্পোতে টিজারকে নিয়ে যাওয়া। সাড়া ছিল আশানুরূপ। কিন্তু এরপর ‘লাগে উরাধুরা’ গানটা রিলিজ হতেই প্রত্যাশার বেলুন একটু যেন চুপসে গেল। ট্রেলারেও খুব ব্যতিক্রমী বা চোখ ধাঁধানো কিছু পাইনি। ঠিক যেন টিজারে চঞ্চল চৌধুরীর টেনশন রিলিজের মতো। পর্দায় কি শাকিবের এগ্রেশনের মতো চূড়ান্ত বিষ্ফোরণ ঘটালো তুফান?? তারই সন্ধানে…
তুফানী আভাস (প্লট)
তুফান মানুষ নয়, পশুও নয়, তুফান যা হতে চেয়েছিল তাই হয়েছে, রাক্ষস
তুফানের প্লটটা রাক্ষস হয়ে ওঠার গল্প; সিনেমার সাথে বাস্তবের অস্তিত্বের সংঘাতের গল্প; ফ্রাঙ্কেস্টাইনের প্রভু হতে চাওয়ার গল্প। এই গল্পে প্রেম আছে, হিংসা আছে, প্রতিশোধস্পৃহা আছে, বেঈমানী আছে, আছে বুদ্ধির খেলা। মোট কথায় দর্শক যা পর্দায় দেখতে চান তাই পাবেন। প্লট এগিয়ে নিতে রায়হান রাফী মুভির চিরায়ত ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারকে অনুসরণ করেছেন। ইন্টারভেলের আগ পর্যন্ত ক্যারেক্টার সেটআপ করেছেন। অন্তত তিনটে প্রধান চরিত্রের ডিটেইলিং করা হয়েছে এসময়। ইন্টারভেলের পরে ফাস্ট স্টেজ ক্লাইম্যাক্সের স্বরূপটা দেখিয়েছেন, মিড পয়েন্ট টুইস্ট হয়ে ডিজেস্টার পর্যন্ত প্লটকে টেনেছেন। তবে গল্প চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স আর রিসল্যুশন রেখে দিয়েছেন পরের কিস্তির জন্য।
যেখানে তুফানের দাপট ছিল অতি প্রবল
তুফানকে পর্দায় পরিচালক ভিন্নভাবে পরিচিত করিয়েছেন। তুফানের চেহারা না দেখিয়ে তার হাতের সিংহ চিহ্নিত আংটি, কথা বলার ধরনে, বডি জেসচারে, ভারী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আবছা মূর্তিতে তুফানের কর্তৃত্ব বুঝিয়েছেন। সিনেমাতে রাফী আরো একবার বিশেষ বাহবা পাবেন অ্যাকশন দৃশ্যে ওয়ান টেক শটের মতো গিমিক ব্যবহারের জন্য। বাংলা সিনেমায় অ্যাকশন দৃশ্যে হয়তো প্রথমই। প্রায় মিনিট পাঁচেক চলা এই কন্টিনিউস শটটা আমার কাছে এই মুভির শ্রেষ্ঠ সংযোজন।
যেখানে তুফানের দাপট ছিল প্রবল
তুফানের বিজিএম আর টাইটেল ট্রাক ছিল শ্রুতিমধুর। অন্তত দুইবার ইনটেন্স মোমেন্টে বিজিএম আর ফেড শটের সুন্দর যুগলবন্দী চোখে পড়েছে। তুফানের সর্বব্যাপিতা ভালোভাবে ফুটানোর জন্য প্যারালাল এডিটিং ব্যবহার করেছেন পরিচালক। তুফানের ব্যাকস্টোরি ডেভেলপের জন্য গাজী রাকায়েতের বয়ানে্র সাথে কিছু এল-কাটের ব্যবহার ছিল। কালার গ্রেডিং দৃষ্টিসুখকর এবং ধারাবাহিক। প্রায় সময় মূল ফোকাসকে একটু কন্ট্রাস্টিং করে আশপাশ থেকে পৃথক করে রাখার প্রবণতা লক্ষণীয়। এবার আসি পাত্র-পাত্রীদের নিয়ে। প্রথমেই শাকিব খান। ট্রেলারেই সবাই দেখেছেন দুটো আলাদা রূপে তাঁর দেখা মিলেছে। দুটো চরিত্রের ধারেভারে একদম ১৮০°। দুটো চরিত্রকে সামলানোর কাজ উৎরে গেছেন শাকিব খান। বিশেষত তুফানের ভূমিকায় শাকিবের গলার টোন, অ্যাটিচিউড, অ্যাগ্রেসন সবই পিকচার পারফেক্ট। আরেকটা চরিত্রটিতে মাঝেমধ্যে একটু পুরানো শাকিব উঁকি দিলেও এ নিয়ে খুব বেশি অভিযোগের কারণ নাই। শাকিব পেরেছেন, নিজেকে ভাঙতে পেরেছেন। নাবিলা বরাবরই আমার প্রিয়। নরম-সরম, মিষ্টি মেয়ের চরিত্র নিয়ে পর্দায় এসেছেন এবং যা দরকার তাই ইনপুট দিয়েছেন। তবে পর্দায় তাঁর স্পেস ও গুরুত্ব ছিল কম। চঞ্চল চৌধুরীর পর্দায় উপস্থিতি আর চরিত্রের ডিটেইলিং দুটাই আরো একটু বেশি চেয়েছিলাম। তবে পর্দায় ওনার উপস্থিতি মানেই আলাদা জাদু, সে যতক্ষণের জন্যই হোক। একই সাথে বুদ্ধির ছটা আর কমিক রিলিফ দুটোরই জোগান দিয়েছেন চঞ্চল। আর শেষ দৃশ্যে তো… সবশেষে গাজী রাকায়েতের কথা তো না বললেই নয়। পুরো গল্পের কমিউনিকেটর যে উনিই। তার গলার কারুকাজে সিনেমা অনেকটা চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে।
যেখানে জাগেনি তুফানের ঢেউ
প্রথমেই বলি মিমি চক্রবর্তীকে নিয়ে। চরিত্রটা গুরুত্ব অনুযায়ী ডেভেলপ করা হয়নি। যে অংশগুলোতে নায়িকার গ্ল্যামারটা কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সেখানে মিমি ভালোই করেছেন, এছাড়া বাকি অংশে তাঁর আরো ভালো কিছু করার জায়গা ছিল। নব্বই দশকের প্লটের সংলাপে নব্বইয়ের দশকের ছাপ ছিল না। তুফানে নাবিলার দুটো সংলাপে শটের কন্টিউনিটির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তুফানেই কিছু দৃশ্যে কন্টিউনিটির ঝামেলা ছিল। একটা সিনে জনসভার মঞ্চে তুফান খুন করছে, মঞ্চের পেছনে একজন নির্বিকারভাবে হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন। আরেকটা সিনে সাদামাটা এক সিনেমা হলে লাল আলোতে এক্সিট লেখা সাইনবোর্ড জ্বলছিল অথচ সময়কাল ১৯৯০। সেট ডিজাইন কোনভাবেই ঢাকার কথা মনে করাচ্ছিল না, মহল্লার সেটের ডিজাইনটাতেও কিছুটা খামতি চোখে পড়েছে। সিনেমাতে ফলি সাউন্ডের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। মাথায় হাতুড়ি পেটানোর সাউন্ডটা মোটেও মাননসই হয়নি। দুটো সিনে অতিনাটকীয়তা আনতে গিয়ে হাস্যকর ঠেকেছে। একটা হলো অদৃশ্য ভিলেনের সাথে মারপিট আরেকটা হলো বাঘমার্কা সিনটা। তুফানের গল্প চলনসই, এরচে বেশি না। আর যারা রাফীর সিনেমার প্লট ভালোভাবে ফলো করেন তারা সবক’টা টুইস্টে চমকিত নাও হতে পারেন।
তুফান থামার আগে
দর্শকেরা তুফান পছন্দ করবেন। কারণ এই সিনেমায় আছে নিখাদ বিনোদনের উপাদান যা বেশিরভাগ দর্শকরাই চান। টেকনিক্যাল কারুকাজেরও অবশ্য কমতি নেই। ডিটেইলিং যথাযথ; অযথা ভাঁড়ামো পরিত্যক্ত, মেলোড্রামা মুক্তপক্ষ বিহঙ্গম!!! আর একটা পয়েন্ট অনেকেই বলছিলেন তুফান ক্যারেক্টারের সাথে ইমোশনালি কানেক্টেড হওয়ার কথা। আমার মনে হয়েছে রায়হান রাফী সচেতনভাবেই তা করেননি।