
নিজেদের সিনেমায় ‘পরিমার্জন’ নিয়ে চুপ, শাকিব ভক্তদের ঘাড়ে ভর করে প্রতিবাদ
শাকিব খান অভিনীত ও মেহেদি হাসান হৃদয় পরিচালিত ‘বরবাদ’ সিনেমার কিছু দৃশ্য নিয়ে আপত্তি ছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের। নির্মাতারা সেই আপত্তি মেনেই দ্রুত সংশোধন সাপেক্ষে সিনেমাটি জমা দেন। কিন্তু শাকিব ভক্তদের একাংশ ‘আনকাট সনদের’ দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম রাখেন, যা কিনা মানববন্ধন পর্যন্ত গড়ায়। তবে শেষ পর্যন্ত সংশোধিত সংস্করণটি ‘ইউ’ সনদ নিয়ে সার্টিফিকেশন বোর্ড পার হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভায়োলেন্সের কারণে বিনা কর্তনে ছাড়পত্র না দেয়ায় শাকিব ভক্তদের পাশাপাশি অনেকেই একই সুরে কথা বলেছেন। সেখানে ঈদের সিনেমার তারকাদের মধ্যে আফরান নিশো, সিয়াম আহমেদ, শবনম বুবলি ও তমা মির্জা রয়েছেন। যদিও ‘বরবাদ’ সিনেমার নায়ক আগাগোড়া বিষয়টি নিয়ে নীরবতা পালন করেছেন।
এ ঈদে ‘বরবাদ’ ছাড়াও আরো পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। এর মধ্যে ‘চক্কর ৩০২’ ও ‘অন্তরাত্মা’ বাদ দিলে বাকি সিনেমাগুলো অল্প পরিমাণ হলেও পরিমার্জনের পরামর্শ পেয়েছে সার্টিফিকেশন বোর্ড থেকে। সেইসব পরিমার্জন খবর হয়নি। নির্মাতারা চুপিসারে সংশোধিত সিনেমা জমা দিয়ে সনদ সংগ্রহ করেছেন। অন্যদিকে ‘বরবাদ’-এর ক্ষেত্রেই প্রক্রিয়া ঘটলেও শাকিব ভক্ত ও চলচ্চিত্রভিত্তিক গ্রুপগুলোর অনেকেই লুফে নেন।
সার্টিফিকেশন বোর্ড সূত্রে জানা যাচ্ছে এম রাহিম পরিচালিত ‘জংলি’ সিনেমায় ছোট কিছু কারেকশনের মৌখিক পরামর্শ দেয়া। যা পরদিনই নির্মাতা সংশোধন করে জমা দেন। তবে নিজের সিনেমার বেলায় সিয়াম আহমেদ কিছু না বলেও ‘বরবাদ’ প্রসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন, ‘একজন অভিনেতা হিসেবে আমি জানি একেকটা সিনেমার পেছনে কতো মানুষের স্বপ্ন লুকোনো থাকে। আমাদের মৃতপ্রায় ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা চেষ্টা করছি যে যার জায়গা থেকে কন্ট্রিবিউট করার। কিন্তু এসবের মাঝে যদি সিনেমা আটকে দেয়ার গুঞ্জন কানে আসে তাহলে খুব হতাশ লাগে, তীব্র রাগ হয়। একটা সিনেমা আটকে দেয়া মানে কতগুলো স্বপ্নকে দাফন করে দেয়া!’
এরপর সিয়াম বলেন, “‘বরবাদ” আমি, আমরা সিনেমাহলে দেখতে চাই। এই ঈদে দর্শক জংলি, বরবাদ, দাগি, চক্কর, জ্বীন-৩ দেখতে সিনেমাহলে ভিড় করুক। সিদ্ধান্ত নিতে যারা বসে আছেন তাদের কাছে আমার একটাই দাবী- হয় সব সিনেমা মুক্তি দিন, নাহলে কোনটাই দেয়ার দরকার নেই। চলচ্চিত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিন।’
একই সিনেমার নায়িকা শবনম বুবলি লেখেন, ‘একটি সিনেমা তৈরির পেছনে অনেক স্বপ্ন থাকে, থাকে প্রযোজক, নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীদের অক্লান্ত পরিশ্রম। সেই সপ্ন পূরণ হয় এবং সবার পরিশ্রম সার্থক হয় যখন বড় পর্দায় একটু একটু করে বহুদিন ধরে একরাশ আশা নিয়ে তৈরি করা সিনেমা টা সবাই দেখতে পায়! আমরা ঈদের সিনেমা জংলি যেমন দর্শকদের দেখাতে চাই তেমনি বরবাদ, দাগি, জিন, চক্কর সহ ঈদের মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সব সিনেমা চাই দর্শক দেখতে পাক। আশা করছি “বরবাদ” সিনেমা নিয়ে সকল জটিলতার সুন্দর সমাধান হবে এবং যেভাবে বরবাদ টিম তাদের সিনেমাটি সবাইকে দেখাতে চেয়েছে সেভাবেই দেখতে পাবো।’
প্রায় দুই বছর আগে ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘প্রিয়তমা’র মুখোমুখি অবস্থানে কিছু মন্তব্যের কারণে বিতর্কিত হন আফরান নিশো। তবে শিহাব শাহীন পরিচালিত ‘দাগি’ মুক্তির আগে আনকাট ‘বরবাদ’-এর পক্ষ নেন তিনি, সোশ্যাল মিডিয়া স্টোরিতে লেখেন, ‘মেঘে দেখে কেউ করিসনে ভয়, মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে.. বাধা হবে যত তীব্র, সংকল্প ততই দৃঢ় হোক… সকল বাধা পেরিয়ে, “বরবাদ” আসুক সামনে, আশা রাখি মন মননে.. শুভ কামনায় আমি দাগি… “বরবাদ”কে বন্দি না করে… মুক্তি দিন।’ যদিও তার সিনেমায় সংশোধন ছিল। এ সিনেমার নায়িকা তমা মির্জা ‘বরবাদ’ নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে লেখা, ‘কী যে বলেন বুঝি না, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা যে পরিমাণ ভায়োলেন্স দেখি প্রতিদিন, এর থেকে বেশি একটা মুভিতে কি আর দেখাবে? আমরা চাই “বরবাদ” সিনেমা হলে আসুক।’
এদিকে ‘দাগি’র প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির শীর্ষ কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাতা ও প্রযোজকদের ভোগান্তির শেষ নেই। অনেক বছর ধরে যে যন্ত্রণা সবাই সহ্য করছিলেন এখনও যদি তা চলমান থাকে বা কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি হয় তাহলে হতাশার শেষ নাই।
সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশন বোর্ড করা হলো। যদি এখনও সিনেমার কারেকশন আসতেই থাকে, তাহলে কী লাভ হলো? সিনেমাটি যে বয়সের জন্য প্রযোজ্য সে বয়সের জন্য নির্ধারণ না করে কারেকশন বা কাট–ছাট করার মানে কী? এটা লাস্ট কয়েকটি ফিল্মের ক্ষেত্রেই হয়েছে এবং হয়েই চলেছে। সার্টিফিকেশন নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন বা অনুমোদন বিষয়ক জটিলতা থাকলে আগে সেটা ঠিক করেন। এভাবে প্রতিটি সিনেমার কোয়ালিটি জাজমেন্ট করার মোড়ল হয়ে বসার জন্য কি এই বোর্ড? শিল্পের মান নির্ধারণের এখতিয়ার কি এই বোর্ডের আছে?
প্রতিটি সিনেমার সার্টিফিকেশন প্রসেসে আগের চেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে, কারণ আগে প্রযোজককে কোনো বিষয়ে জানানোর জন্য চিঠি দিতে হলে বোর্ড নিজেই দিতে পারত। কিন্তু এখন প্রতিটি চিঠির ড্রাফ্ট প্রথমে মন্ত্রণালয়ে যায়, অনেকগুলো টেবিল ঘুরে ঘুরে তারপর ফেরত আসে সার্টিফিকেশন বোর্ডে। আরও কিছু টেবিল ঘুরে চিঠি পান প্রযোজক। সিনেমা প্রিভিউ হওয়ার পরও অনেক সময় সেই চিঠি প্রযোজকের হাত পর্যন্ত আসতে মাস খানেক সময় লেগে যায়। সেই চিঠির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে জমা দেয়ার পর আবার বোর্ড প্রিভিউ হয়। আবারও কোনো কিছু জানানোর প্রয়োজন হলে মন্ত্রণালয় আর বোর্ডে চিঠির চক্কর চলতে থাকবে অসীম লুপে। এত বড় একটা বোর্ড অথরিটি একটা চিঠি ইস্যু করতে পারে না? এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শেষ কোথায়?
এফডিসির অনিয়মতান্ত্রিক এনওসি নামক ভোগান্তি, ইন্টারন্যানাল ফিল্ম কোলাবোরেশনে নানান জটিলতা, যৌথ প্রযোজনার জটিল–কুটিল হিসেব নিকেশ, সার্টিফিকেশন বোর্ডের মোড়লগিরি ও সময়ক্ষেপণের যন্ত্রণা থেকে নির্মাতা–প্রযোজকরা বের হতে না পারলে সিনেমার এক চুলও পরিবর্তন হবে না। সিনেমার উন্নতি তো দূরের কথা, আরও মুখ থুবরে পড়বে।’
মন্তব্যের ঘরে একজন ‘নকল সিনেমা’ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে রনি লেখেন, “নির্দিষ্ট কোন সিনেমার জন্য আমার এই লেখা না। গত কয়েক মাসে মৌলিক গল্পের সিনেমাতেও শিল্পমানের খবরদারী সার্টিফিকেশন বোর্ড করেছে এবং চিঠির জন্য বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের ফুটবল খেলা দেখেছি। আর নকল ধরার দায়িত্ব কপিরাইট অফিস নাকি সার্টিফিকেশন বোর্ডের সেটার বিষয়ে আমার জ্ঞান কম। জানাতে পারো। তবে আমাদের সিনেমায় যে ধরনের জাজমেন্টের চিঠিতে দেয়া হয়েছিল তার বেশিরভাগই শিল্পের খবরদারী। আপিল করতে পারতাম তাতে সিনেমা আটকে যেত। রিলিজের জন্য লগ্নি বাঁচাতে অনেক প্রযোজকই শিল্পের খবরদারী মেনে নিতে হচ্ছে। এটা রিয়েলিটি।’
এর অর্থ হলো চরকি প্রযোজিত কোনো সিনেমা ‘সংশোধন’ সাপেক্ষে ছাড়পত্র পেলেও ওই সময় তার বিষয়টি মুখ খোলেননি। উল্লেখ্যযোগ্য যে, গত বছরের শেষ দিকে চরকির ব্যানারে দুটি সিনেমা হলে মুক্তি পায় ‘প্রিয় মালতী’ ও ‘৩৬-২৪-৩৬’। তবে কোন সিনেমা নিয়ে রেদওয়ান রনি কথা বলেছেন তা মন্তব্য থেকে স্পষ্ট নয়।