বাংলাদেশের সরকারি টাকায় হল সংস্কারে সুবিধা ‘হিন্দি সিনেমার’?
করোনার প্রণোদনা হিসেবে সরকার প্রায় ১০০০ কোটি টাকা দিচ্ছে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তরফে আসা এই ঋণ সুবিধা চলতি বছর সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বড় খবর ছিল। একই সঙ্গে আলোচনায় হিন্দি সিনেমা মুক্তির ‘সিদ্ধান্তের’ বিষয়টি।
দুটি বিষয় মিলিয়ে ভাবা ভুল নয় যে, হল সংস্কার হলে সেই সুবিধাটা হচ্ছে হিন্দি সিনেমায়। অর্থাৎ, দেশীয় টাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন হবে অন্য দেশের সিনেমার স্বার্থে। পুরো চিত্র মাথায় রেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় দীর্ঘ লেখা পোস্ট করেছেন নির্মাতা হিমেল আশরাফ।
বিএমডিবি পাঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি তুলে ধরা হলো—
“অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে অবশেষে বাংলাদেশে হিন্দি সিনেমা মুক্তি পেতে যাচ্ছে।
নব্বই দশকের শেষের দিকে অশ্লীলতা, গালাগালি, নকল সিনেমার কারণে সিনেমা হলগুলো তখন পরিণত হয় পর্ণ প্রদর্শনের জায়গা হিসেবে। সিনেমার মধ্যে সরাসরি পর্ণ চালিয়ে দেয়া হতো। চলচ্চিত্রের মানুষ, বিএফডিসির কর্তৃপক্ষ, সেন্সর কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে এসব প্রদর্শিত হতো। কিছু মানুষের কাছে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিক্রি হয়ে ধ্বংস করে দেয় বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। তখন মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়। সিনেমা হল চলে যায় নেশাখোর, দালাল, অশিক্ষিত, কুরুচিশীল দর্শকদের দখলে। অথচ বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের একমাত্র বিনোদন মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। এখনো বাংলাদেশে ভালো থিম পার্ক নাই, মফস্বলে ভালো পার্ক নাই, গ্রামে ভালো রেস্টুরেন্ট নাই, শহরে বার বা নাইট ক্লাব নাই, মানে মানুষ তার পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে একটু ভালো সময় কাটানোর জন্য যাবেটা কই? উন্নত সিনেমা হল এবং রুচিশীল সিনেমা হতে পারতো এই দেশের সবার সবচেয়ে বড় বিনোদনের জায়গা তার বড় প্রমাণ বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স। পরিবেশ ভালো বলে ভালো সিনেমা এলে এখনো মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটে সিনেপ্লেক্সে।
যেহেতু ভালো দর্শক চলে গিয়েছিল তাই সিনেমার ভালো প্রযোজক পরিচালকগুলোও চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল, ইন্ডাস্ট্রি ছিল নষ্টদের দখলে। এখন না আছে নষ্টরা না আছে মেধাবীরা আছে শুধু মুখে মুখে হাতি ঘোড়া মারা একদল নেতা যারা শুধু এ ওরে নিষিদ্ধ করে, বয়কট করে আর পিকনিক করে মাঝে মাঝে মহরতও করে।
এই মৃত বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সুদিন আবার নিজে নিজে ফিরিয়ে আনা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়। হিন্দি সিনেমা আসলে যেটা হবে, প্রথমে দলগুলোর আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এই ভাঙাচোরা পর্দায় উচ্চ প্রযুক্তির হিন্দি সিনেমা চলবে না। তাহলে প্রথমেই হলে হাত দিতে হবে। সিনেমা হলের জন্য সরকার ইতিমধ্যে ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সো হিন্দি সিনেমা চালাতে হলে সিনেমা হলের প্রচার যন্ত্র, পর্দা, আসন, বাথরুম, টিকিটিং সিস্টেম, পরিবেশ সব পরিবর্তন করতেই হবে। তাহলে আমরা পেয়ে গেলাম আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল। তাতে প্রচার হলো বলিউডের আধুনিক সিনেমা। ভালো পরিবেশ পেলে শাহরুখ, আমির, সালমান বা অক্ষয়কে দেখতে আবার মধ্যবিত্তরা সবাই সিনেমা হলে আসবে। পরিবার, বন্ধু, প্রিয়জনকে নিয়ে এক বেলার বিনোদন হবে দল বেধে একটা ভালো সিনেমা দেখা।
এখন হিন্দি সিনেমা আসায় আমরা পেলাম তাইলে ভালো সিনেমা হল আর ভালো শিক্ষিত নিয়মিত দর্শক। এরপর আমাদের বাংলাদেশের সিনেমার ইন্ডাস্ট্রির লোকদের আসল কাজ শুরু। মাল্টিসিনেপ্লেক্সে একাধিক পর্দা থাকে। সেখানে দিনে ২০টা শো হলে সবতো হিন্দি সিনেমা হবে না। সেখানে ৫ টা শো’ও যদি আমরা ভালো গল্পের ভালো মানের বাংলা সিনেমা দিতে পারি তাইলেই কিন্তু আস্তে আস্তে আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির চেহারাও বদলাতে থাকবে। সরকার যদি বিদেশি সিনেমার জন্য ২৫/৫০% বেশি কর বসায় আর ঠিক করে দেন যে মোট শো’য়ের অন্তত ৩০ ভাগ বাংলা সিনেমা চালাতেই হবে তাইলেই আমরা আমাদের জায়গা তৈরি করে নিতে পারবো।
হিন্দি সিনেমা ছাড়া এই ভগ্নদশা থেকে আসলেই আমরা বের হতে পারবো না আবার হিন্দি সিনেমা যেন আমাদের গিলে খেয়েও না ফেলে সেটাও মাথায় রাখতে হবে। কলকাতা যদি হিন্দি সিনেমার সাথে টিকে থাকতে পারে, আমরাও পারবো। ভালো গল্প ভালো নির্মাণ হলে বাংলাদেশের দর্শক অবশ্যই বাংলাদেশের সিনেমাই দেখবে এইটা সত্যিই আমি বিশ্বাস করি। আর ভালো গল্প আর ভালো নির্মাণের জন্য যতটা না বাজেট লাগে তার চেয়ে বেশি লাগে মেধা।
আমি নিশ্চিত, মেধাবী দর্শক পেলে এই সময়ের অযোগ্য লোকদের ভিড়ে মেধাবী কারিগররাও ঠিকই একদিন হাল ধরবে বাংলা সিনেমার, সেইদিন বেশি দূরে না। মনে রাখতে হবে ভালো সিনেমা শুধু ভালো নির্মাতা ভালো কলাকুশলীর ওপর নির্ভর করে না, ভালো দর্শকের ওপরও নির্ভর করে।
আর হিন্দি সিনেমায় আমাদের সমাজ সংস্কৃত নষ্ট হবার কথা বলবেন? ভাই কোন বাংলাদেশি সিনেমা দর্শক এখন কোন হিন্দি সিনেমাটা না দেখে আছে? ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় দেখলে উচ্ছন্নে যা যাবার ওটুকুই যাবে।”