বাংলা সিনেমার পোস্টারের ইতিহাস
সিনেমার যাত্রাকালে এত প্রচারমাধ্যম ছিল না। বেতার আর পত্রিকার বিজ্ঞাপন ছিল সিনেমা প্রচারণার বড় মাধ্যম। সিনেমার পথচলার প্রথম পাঁচ দশক পত্রিকা আর বেতারই বা কয়জন মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল? অথচ সিনেমা পৌঁছে গিয়েছিল শহরের উচ্চবিত্ত থেকে প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়া পর্যন্ত। কীভাবে? উত্তর একটাই, সিনেমার পোস্টার দিয়ে। চলচ্চিত্র যাত্রার ইতিহাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে চলচ্চিত্রের পোস্টারের ইতিহাস। পোস্টার চলচ্চিত্র বিকাশে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সিনেমার চরিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রঙ-তুলির ছোঁয়ায় আবর্তিত হয়েছে আরেকটি সিনেমারূপে, যা শহরের অলিগলি ছুঁয়ে পৌঁছে গেছে নিভৃত পল্লীর কোনো নরসুন্দরের দোকানে।
পোস্টার এমনই শক্তিশালী গণমাধ্যম, যা গ্রামের কিশোর কিংবা কৃষককে টেনে এনেছে উপজেলা সদরের সিনেমা হল পর্যন্ত। পোস্টারের আবেদনে সাড়া দিয়ে গ্রামের মানুষ সিনেমা দেখার জন্য ১০-২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছে তুমুল উত্তেজনায়। সদ্যমাধ্যমিকে পা রাখা কিশোর নানা কসরতে টাকা বাঁচিয়ে বন্ধুদের নিয়ে ছুটেছে জেলা শহরের দিকে। এক শহরে একাধিক হলে একাধিক সিনেমা চললে দর্শক কোন সিনেমাটা দেখবে, সে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো পোস্টার দেখে। ৯০ দশকের গোড়ার দিকে দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে গ্রামে একটি দ্রুতগামী রিকশা এসেছে। রিকশার দুই পাশে সিনেমার পোস্টার বাঁধানো। রিকশাযাত্রীর কোলের ওপর ক্যাসেট প্লেয়ার। হাতে মাউথপিস। মাইকে গ্রামবাসীর উদ্দেশে দরাজ গলায় ঘোষণা করছেন, ‘আসিতেছে আসিতেছে…।’ গ্রামের কিশোররা সেই রিকশার পেছনে ছুটতে ছুটতে চলে যেত অন্য গ্রামে। রিকশার গতির সঙ্গে শরীরের গতি মিলিয়ে তাকিয়ে থাকত পোস্টারের দিকে, রঙ-তুলিতে জীবন পাওয়া প্রিয় নায়ক-নায়িকার দিকে। এভাবেই সিনেমা আর পোস্টার, পোস্টার আর সিনেমা, একে-অন্যকে নিয়ে গেছে দেশের ৬৮ হাজার গ্রামে।
এ অঞ্চলে সিনেমার পোস্টারের ইতিহাস যেমন পুরনো, তেমনি চলচ্চিত্র যাত্রার মতোই নানা ঘটনাবহুল। এখন যে পোস্টার আমরা দেখি তা এসেছে বিভিন্ন পরিবর্তন ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে। আজ যা পোস্টার তা একসময় ছিল নিখাদ ব্যানার পেইন্টিং। বিশ্বে প্রথম চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন দুই ভাই। ওগ্যুস্ত ম্যারি লুই নিকোলা ল্যুমিয়ের ও লুই জ্যঁ ল্যুমিয়ের নামের ওই দুই ভাইকে একত্রে ‘ল্যুমিয়ের ব্রাদার্স’ ডাকা হয়। ১৮৯৫ সালে প্যারিসের গ্রান্ড ক্যাফেতে ল্যুমিয়ের ব্রাদার্স প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। তার মাত্র সাত মাস পরই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে সিনেমা। উপমহাদেশে সিনেমা আসে ওই দুই ভাইয়ের হাত ধরেই। তারা ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই মুম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এরপর ব্রিটিশ ভারতে দ্রুত চলচ্চিত্রের বিস্তার হতে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনামলে সিনেমা প্রচারের জন্য বেছে নেয়া হয় ওয়াল পেইন্টিং। সিনেমা হলের দেয়ালে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি ও চলচ্চিত্রের নাম আঁকা হতো, যা চলচ্চিত্রের পোস্টারের আদি রূপ বলা যায়। এ ধরনের দেয়ালচিত্রসহ চলচ্চিত্রের প্রচারকাজ করতেন পুরান ঢাকার কমার্শিয়াল শিল্পীরা। ঢাকায় ১৯৪০-৫০ দশকে দেয়ালচিত্রের জন্য বিখ্যাত ছিলেন পীতলরাম সুর নামের এক শিল্পী। তিনি প্রতিকৃতি অঙ্কনে পারদর্শী ছিলেন। কাউকে একবার দেখলে তার মতো করেই এঁকে দিতেন। পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাট এলাকায় মায়া সিনেমা হলের কাছাকাছি আর্ট হাউজ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর চলচ্চিত্র প্রচারণার একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে ব্যানার পেইন্টিং। হলে যে সিনেমা চলত, বাইরে তার বিশাল আকারের হাতে আঁকা ব্যানার পেইন্টিং লাগানো হতো। ৯০ দশকের গোড়ার দিকেও হলের সামনে ঝলমলে ব্যানার ও পোস্টার চোখে পড়ত। কাপড়ের বিশাল ক্যানভাসে উজ্জ্বল সব রঙে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অতিরঞ্জিত পোর্ট্রেটভিত্তিক এ ব্যানার পেইন্টিং দেশের শিল্পমাধ্যমে নতুন এক ধারার সূচনা করেছিল। দেশভাগের পর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করে।
দেশভাগের সময় বিপুলসংখ্যক অবাঙালি মুসলিম কলকাতা ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তাদের অনেকেই কলকাতা, মুম্বাই ও মাদ্রাজে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং কিংবা এ ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে এসেও তাদের জীবন-জীবিকার উৎস হয়ে দাঁড়ায় চলচ্চিত্রের প্রচারণায় দেয়ালচিত্র ও ব্যানার পেইন্টিং। ঢাকাই সিনেমায় ব্যানার পেইন্টিংয়ের অন্যতম পথিকৃৎ মুনলাইট সিনেমা হলের মালিক মোহাম্মদ সেলিম। তিনি এসেছিলেন কলকাতা থেকে। মোহাম্মদ সেলিমের কাছে কাজ শিখে অনেকে বিখ্যাত পোস্টার আর্টিস্ট হয়েছিলেন। তার মধ্যে গুলফাম ও আনোয়ারের নাম উল্লেখযোগ্য। ঢাকার বাইরেও এ শিল্পের বিকাশ ঘটে। সৈয়দপুরের দাদা আর্টের আবদুল ওহাব ছিলেন বিখ্যাত। তার পূর্বপুরুষ মাদ্রাজের বড় কাটরা অঞ্চলে বসবাস করতেন। ওহাব বংশপরম্পরায় এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হন।
ভারত থেকে আসা অভিবাসী অবাঙালি মুসলমানদের হাত ধরে এ দেশে ব্যানার পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত হলেও এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় স্বশিক্ষিত পেইন্টারদের অনেকে। ঢাকাই সিনেমায় ব্যানার পেইন্টিংয়ের প্রভাব পড়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীদের মধ্যেও। এজেড পাশা, সুশীল ব্যানার্জী, সুভাষ দত্ত, যতীন্দ্র কুমার সেন, সুতান সরকার, দাউদ ওস্তাদ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পঞ্চাশের দশকে ভাস্কর নিতুন কুন্ডু, চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের মতো প্রতিথযশা শিল্পীরাও সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া চিত্রকলার অনেক শিক্ষার্থী যুক্ত হন এ পেশায়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীরা বেশিদিন যুক্ত থাকেননি। ফলে তাদের অঙ্কনরীতি বা কৌশল খাতটাকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। যার দরুন সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং ঢাকার চিত্রকলায় অন্যতম একটা জনপ্রিয় ও স্বতন্ত্র শিল্প শাখার জন্ম দেয়। ঢাকাই চলচ্চিত্রের ব্যানার পেইন্টিং শিল্পীদের শিল্পভাবনা, রঙের বিন্যাস ও ব্যবহার ছিল অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বিশাল ক্যানভাস, অতি উজ্জ্বল গোলাপি হলুদ-নীল-লাল রঙের ব্যবহার, মানবদেহের অতিমাত্রিক উপস্থাপন ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে তা নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৫৭ সালে ঢাকার তেজগাঁওয়ে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা তথা এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে এখানে চলচ্চিত্র শিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাপক হারে শুরু হয়। ঠিক এ সময়ে চলচ্চিত্রের প্রচারে পোস্টারের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সেই পোস্টারই নানা কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে আজকের আধুনিক পোস্টারে রূপ লাভ করে। চলচ্চিত্র যেহেতু আধুনিক ও নান্দনিক শিল্পমাধ্যম। তাই শিল্পকলার সংস্পর্শে এসে চলচ্চিত্রের পোস্টারও নান্দনিক রূপে হাজির হতে শুরু করে। বাংলা ভাষায় নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। মুখ ও মুখোশের পোস্টারই বাংলা ভাষায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পোস্টার। যদিও এ বিষয়ে দ্বিমত আছে। সিনেমাসংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলেন, মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের কোনো পোস্টারই তৈরি করা হয়নি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য এবং গানের বইয়ের কভার করার জন্য স্কেচ করা হয়েছিল। এখন ইন্টারনেটে মুখ ও মুখোশের যে পোস্টার পাওয়া যায় তা মূলত মোস্তফা আজিজের স্কেচ ও ডিজাইন। এটি সিনেমার বইয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা মুক্তি পায়। এ চলচ্চিত্রের দ্বারা প্রচার মাধ্যম হিসেবে পোস্টারের যাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পোস্টারের ইতিহাস সন্ধানে শুরুতেই নাম আসে সুভাষ দত্তের। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে পরিচিত। অথচ তিনি ছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে পোস্টার শিল্পের সূচনাকারীদের একজন। প্রথম দিককার প্রায় সব চলচ্চিত্রের পোস্টারেই সুভাষ দত্তের ছোঁয়া থাকত। এ লাইনে তিনি বৈদেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত বলা যায়। শিল্পী হওয়ার সহজাত গুণে গুণান্বিত সুভাষ দত্ত প্রথম জীবনে দিনাজপুরের লিলি টকিজে কাজ করতেন। সেখানে প্রদর্শিত কলকাতা-মুম্বাইয়ের বিভিন্ন চলচ্চিত্রের পোস্টার ও শো-কার্ডের কাজ করতেন। এ বিষয়ে আরো ভালো জানার জন্য ১৯৫১ সালে মুম্বাই চলে যান। পামার্ট নামে একটা ফিল্ম পাবলিসিটি ফার্মে কাজ নেন। ওই ফার্মে মারাঠিরা কাজ করতেন। তারা জলরঙ, স্প্রে, পেইন্টিং, পেনসিল-চারকোল দিয়ে পোস্টার আঁকতেন। ব্যানার, শো-কার্ড, বুকলেট, পেপার পাবলিসিটির কাজ করতেন। দেখে দেখে সব কাজ শিখে নেন সুভাষ দত্ত। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় চলে আসেন। চাকরি নেন এভারগ্রিন পাবলিসিটিতে। তার মাসিক বেতন ছিল ১১০ টাকা। ১৯৫৫ সালে আরো তিনজন অবাঙালির সঙ্গে মিলে কামার্ট নামে একটা পাবলিসিটি হাউজ খোলেন। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের প্রচারের দায়িত্ব পান সুভাষ দত্ত। মুখ ও মুখোশ ছাড়াও জাগো হুয়া সভেরা, এ দেশ তোমার আমার, মাটির পাহাড়, আকাশ আর মাটি, রাজধানীর বুকে, রুপালি সৈকতে, নাজমাসহ তার নিজের পরিচালিত সব সিনেমার পোস্টার আঁকেন।
এছাড়া আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পী নিতুন কুন্ডুকে ঢাকায় নিয়ে আসেন সুভাষ দত্ত। তার জন্য এভারগ্রিন পাবলিসিটিতে চাকরি জোগাড় করে দেন। এভাবেই নিতুন কুন্ডু চলচ্চিত্রের ব্যানার ও পোস্টার আঁকার মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে পোস্টার আঁকায় মুন্সিয়ানা দেখে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন নিতুন কুন্ডুকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে নেন। চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের কর্মজীবনও শুরু হয়েছিল পোস্টার আঁকার মাধ্যমে।
আমাদের দেশে চলচ্চিত্র পোস্টার নির্মাণ ও ডিজাইনের ক্ষেত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্র পোস্টার ডিজাইনের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। ষাটের দশকে ঢাকায় পেইন্টিং নির্ভর কমার্শিয়াল আর্টিস্টদের তিনটি শ্রেণী গড়ে ওঠে। এক: যারা চলচ্চিত্র পোস্টার ডিজাইন করে, দুই: যারা চলচ্চিত্র ব্যানার পেইন্টিং আঁকে, তিন: যারা রিকশা বা ট্র্যাকে পেইন্টিং করে। একাডেমিক শিক্ষাহীন এ শিল্পীরা রিকশার পেছনের চিত্র থেকে শুরু করে সাইনবোর্ড ও চলচ্চিত্রের পোস্টার-ব্যানার আঁকতেন।
এ লেখার শুরুর দিকে যে গুলফামের নাম এসেছিল, সেই গুলফামের কাছে কাজ শেখেন গিরিন দাস। ৭০ ও ৮০ দশকে এই গিরিন দাস পোস্টার ডিজাইনে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন। গিরিন দাসের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে জোয়ার এলো, নয়নতারা, ময়নামতি, অমর প্রেম, বধূ বিদায়, সোনার তরী, আলতাবানু, বেদের মেয়ে জোসনা, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি।
৫০ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে দুই ধরনের পোস্টার তৈরি হতো। একটি সম্পূর্ণ হাতে আঁকা, অন্যটি স্টিল ফটোগ্রাফির ছবি দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে হাতের কাজ করা। এগুলোকে ফিল্মের ভাষায় রিটাচিং বলা হয়। স্টিল ক্যামেরা সহজলভ্য হওয়ায় হাতে আঁকা ছবির সংখ্যা কমতে থাকে। কারণ হাতে আঁকা পেনসিল স্কেচ বা রঙ-তুলির কাজ সহজ ছিল না। এজন্য ড্রইংয়ের যথাযথ ব্যবহার, ধৈর্য ও পরিশ্রম করতে হতো। ৬০ দশকে সম্পূর্ণ হাতে আঁকা পোস্টারের মধ্যে চান্দা, জোয়ার এল, বাঁশরি, বেদের মেয়ে জোসনা অন্যতম।
ষাট ও সত্তরের দশকে চলচ্চিত্র পোস্টারে রঙের ব্যবহারের ভিন্নতা দেখা দেয়। সাদা-কালো ছবি রঙিন করতে ট্রান্সপারেন্ট রঙ ব্যবহার করা হতো। এগুলোর মধ্যে পেলেকেনের বহুল ব্যবহার ছিল। এটা পাতার মতো দেখতে বিভিন্ন রঙ পাওয়া যেত। পরে তা পানিতে পাতলা করে ব্যবহার করা হতো। পোস্টারের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরিতে জলরঙ এবং অনেক ক্ষেত্রে পোস্টার কালার ব্যবহার করা হতো। প্রিন্টিংয়ের জন্য লাল, নীল, বেগুনি-জাতীয় উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করা হতো।
মুখ ও মুখোশের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ২০৮টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এ সময়ে চলচ্চিত্রের পোস্টার আঁকতেন সুভাষ দত্ত, নিতুন কুন্ডু, আজিজুর রহমান, আবদুল মালেক, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খানের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। এছাড়া কমার্শিয়াল আর্টিস্টদের মধ্যে মঈন, দুলারা, লাদলা, রফিক, গিরিন দাস, গুলফাম, আনোয়ার, মোজাম্মেল, এমদাদ, বিদেশ কুমার ধর, হরিদাস অন্যতম। তারা সিনেমার পোস্টার ডিজাইন, ব্যানার আঁকা, টাইটেল কার্ড ও ফটোসেট নির্মাণ ইত্যাদি কাজ করতেন।
ঢাকার চলচ্চিত্র পোস্টার শিল্পের আরেক দিকপাল বিদেশ কুমার ধর। তিনি বিকেডি পাবলিসিটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পোস্টার ডিজাইন করছেন। বাবার থেকে পেনসিল স্কেচ শেখার পর বিদেশ কুমার তার মামা পীতলরাম সুরের থেকে শেখেন তেলরঙের কাজ। জলরঙের কাজ শিখেছেন গিরিন দাসের থেকে। পুনম কি রাত নামের উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রের পোস্টার ডিজাইনের মাধ্যমে ১৯৬৬ সালে এ পথে হাঁটেন। এরপর আলিবাবা, মণিহার, নয়নমণি, ছক্কা-পাঞ্জা, আনার কলি, বাগদাদের চোর, মহুয়া সুন্দরী, আয়না বিবির পালা, দাঙ্গা, দেশপ্রেমিকসহ অনেক বিখ্যাত ছবির পোস্টার ডিজাইন করেন। বর্তমানে জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রায় সব ছবির পোস্টার ডিজাইন করেন তিনি।
মূলত সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নিরীক্ষাধর্মী কাজ শুরু হয়। ওই দশকের শেষের দিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ইসলামী ঘরানার ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনা ঘটে। যার প্রভাব পড়েছিল পোস্টার ডিজাইনেও। দুই রাজকুমার, বাদশা, বাহাদুর, দাতা হাতেম তাই, বিজয়িনী সোনাভাণ ইত্যাদি চলচ্চিত্রের পোস্টারে সাপ, জিন, পরী, দৈত্য-দানব ইত্যাদি ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পাশাপাশি সশস্ত্র অশ্বারোহী, ধাবমান ঘোড়া, নারীদেহের সীমিত প্রদর্শন ইত্যাদি বহুবিধ উপাদানের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ফলে পোস্টারে জায়গা কমে আসে। এজন্য তীব্র উজ্জ্বল রঙ দিয়ে বিষয়ের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হতো।
এছাড়া বিভিন্ন থিমের ওপরও পোস্টার করা হতো সেই সময় থেকেই, যার উদাহরণ মণিহার সিনেমা। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া মণিহারের পোস্টারে দেখা যায় একটা গলার হার। হারের মূল লকেটে নায়ক-নায়িকা ও ভিলেনের ছবি। মূল লকেটের সঙ্গে আরো কিছু ছোট ছোট লকেট ঝুলছে। ছোট লকেটগুলোর মাঝে সিনেমার অন্যান্য চরিত্রের ছবি। পোস্টারটির ডিজাইনার বিদেশ কুমার ধর। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনী পোস্টার তৈরির ক্ষেত্রে পরবর্তী কয়েক দশক পর্যন্ত ডিজাইনটি অনুসরণ করা হতো। ১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্র পোস্টার অফসেট প্রিন্টিংয়ে ছাপা হতে শুরু করে। ছাপাখানার প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে চলচ্চিত্র পোস্টারের মান আরো উন্নত হতে শুরু করে। দেশে চলচ্চিত্র পোস্টার মুদ্রণের ক্ষেত্রে কিছু প্রিন্টিং প্রেস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ফাইন আর্টস ও উদয় প্রেস তার মধ্যে অন্যতম। কালার ফটোগ্রাফি আসার ফলে পোস্টার ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
৯০ দশকে সুভাষ দত্ত, খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলামের মতো পরিচালকরা সিনেমা নির্মাণ কমিয়ে দেন। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির কারণে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে দর্শকের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয়। দর্শক টেলিভিশনকেন্দ্রিক বিনোদনে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এ সময়ে রিমেক সিনেমা তৈরি বাড়তে থাকে, যার প্রভাব পড়ে পোস্টারেও। টিনএজ প্রেমভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি বাড়তে থাকে। এসব চলচ্চিত্রের পোস্টারে প্রেম ও প্রেমকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব প্রাধান্য দেয়া হয়। এ সময়ে কাজী হায়াতের হাত ধরে রাজনীতি, গডফাদার, অসৎ পুলিশ, প্রতিবাদী নায়কের সমন্বয়ে সহিংসতানির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে শুরু করে। এসব চলচ্চিত্রের পোস্টারে রক্ত, রক্তাক্ত ছুরি, জখম হওয়া মুখচ্ছবি, অস্ত্র হাতে ধাবমান যুবক, ধর্ষণের শিকার রমণী ইত্যাদির উপস্থিতি লক্ষণীয়। সামাজিক অ্যাকশন ও মার্শাল আর্টনির্ভর চলচ্চিত্রও নির্মাণ শুরু এ দশকে। তখন পোস্টারে মার্শাল আর্টধর্মী মারামারির ছবির পাশাপাশি নায়ক-নায়িকা, ভিলেনের ছবি প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশে ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রের সূচনাও হয় ৯০ দশকে। তার মধ্যে চাকা, একাত্তরের যিশু, আগুনের পরশমণি, মুক্তির গান, দুখাই, হাঙর নদী গ্রেনেড, এখনো অনেক রাত, চিত্রা নদীর পাড়ে অন্যতম।
এ দশকের শেষের দিকে চলচ্চিত্রের অশ্লীলতার আগমন, যার প্রভাব পড়ে পোস্টারেও। ফলে চলচ্চিত্র পেস্টারে নারীর অর্ধনগ্ন দেহ, ক্লোজআপ শটে নারীর বিভিন্ন দেহাংশের অতিরঞ্জিত প্রদর্শন শুরু। রাঙা বউ, পরাধীন, রানী কেন ডাকাত, ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা, নয়া কসাই, গুণ্ডা নাম্বার ওয়ান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
২০১০-এর দশকে অবস্থা বদলাতে থাকে। এ সময়ে ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। শুরু হয় গ্রাফিক ডিজাইননির্ভর পোস্টার তৈরি। পোস্টারে আসে ভিন্নতা। কম্পিউটারে উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করে পোস্টার ডিজাইন করা হয়। নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় পোস্টার ডিজাইনে। প্রতীকী উপায়ে সিনেমার গল্প তুলে ধরা হয় পোস্টারে। পিঁপড়াবিদ্যা, আইসক্রিম, আয়নাবাজি ইত্যাদি চলচ্চিত্রের পোস্টার প্রশংসিত হয়েছে। আবার নকলের অভিযোগও উঠেছে অনেক পোস্টারের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পাওয়া সিনেমা সিয়াম আহমেদ অভিনীত মৃধা বনাম মৃধার পোস্টারের ইউনিক থিমের প্রশংসা করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিতে দেখা যায় দর্শক সমালোচকদের।
এখনকার নির্মাতাদের ছাপা পোস্টারের চেয়ে ডিজিটাল পোস্টারের দিকে নজর বেশি। কেননা সিনেমা প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে সোস্যাল মিডিয়া। পোস্টার নির্মাতা বিদেশ কুমার ধর ২০১৫ সালে হতাশার সুরে জানান, বর্তমানে কাজ করে তিনি আনন্দ পান না। এখান পোস্টারে ক্রিয়েশনের জায়গা কমে গেছে। ৯০ দশকে পোস্টারে ডেপথ অব ফিল্ড ও ডিটেইলিংয়ের কাজ বেশি ছিল। নির্মাতার মৌলিক ধারণা থেকে পোস্টার ডিজাইন করা হতো। এখন কম্পিউটারে নদী, পাহাড় বসিয়ে কৃত্রিম ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর ডিজাইন করা হয়।
আবার অনেকে মনে করেন, কম্পিউটারে আঁকা পোস্টারেও নান্দনিকতা আছে। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পোস্টারের অভিব্যক্তিও বদলে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জটা মোকাবেলা করাই আসল কথা।
সবশেষে পোস্টার নিয়ে একটা মজার কথা বলা দরকার। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রে অভিনীত কেন্দ্রীয় চরিত্র তথা নায়ক-নায়িকার ছবি পোস্টারে দেয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পোস্টারে শুধু সুপারস্টারদের ছবি বড় করে দেয়া হয়। ছবি পোস্টারে না থাকা নিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পীদের মান-অভিমানের ঘটনাও শোনা যায়। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী-২ সিনেমার পোস্টারে শুধু নায়ক শাকিব খান ও জয়া আহসানের ছবি দেখা যায়। সিনেমার আরেক নায়ক ইমনের ছবি পোস্টারে না থাকায় তিনি মন খারাপ করেন।
তথ্যসূত্র: সিনেমার পোস্টার (প্রথম খণ্ড), সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পোস্টারের বিবর্তন, মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, তানিয়া সুলতানা, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ