লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন ও নন রোমান্টিক শহীদুল ইসলাম খোকন
সময়টা ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে হতে পারে। হলে গিয়ে আমার প্রথমবারের মতো সিনেমা দেখা। পরিচালকের নাম মনে রাখার সঙ্গত কোন কারণ নেই। কিন্তু নায়ক চরিত্রে রুবেল বলে কথা। সে সময়টাতে রুবেল মানেই একটা উন্মাদনা। হলে তিল ধারনের জায়গা নেই। দৃশ্যপটে রুবেল হাজির হলে করতালি এবং চিতকারে ভেঙে যেতে নিচ্ছিলো সিনেমা হলের চারপাশ। রুবেলের এক ফ্যান বড় ভাইয়ের সাথে মিলে ছবিটি দেখতে যাওয়া। সেই ছবিতেই হয়তো প্রথম পরিচয় হুমায়ূন ফরিদী এবং এটিএম শামসুজ্মানের সাথে। সিনেমার নাম ‘ভণ্ড’। পরে জানলাম তার পরিচালকের নাম শহীদুল ইসলাম খোকন। এরপর থেকে অ্যাকশন ছবি মানেই খোকন, ফরিদী এবং রুবেলের এক অনবদ্য জুটি। যখনই পর্দায় হাজির হয়েছেন অ্যাকশন, ড্রামা এবং রোমান্সের ছড়াছড়ি। কিন্তু আমি পরিচিত হওয়ার আগেই তারা বাংলা সিনেমায় নিজস্ব বয়ান ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন।
আমাদের শৈশবের বিশাল একটা অংশ জুড়ে ছিলো সালমান শাহ আর রুবেলের দাপট সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী সিনেমা করে একই সময়ে হল জুড়ে রাজত্ব। কেউ কারো চেয়ে কম নন। কোথাও কোথাও এই দুজনের ভক্তগোষ্ঠীও আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। সপ্তাহ শেষে শুক্রবার আসলে পর্দায় কার দেখা মিলবে সে হিসেব নিকেশও কম হতো না।
নব্বই পরবর্তী বাংলা সিনেমার দর্শকদের একটা অংশের রুচি যদি সালমান শাহ দ্বারা শাসিত হয়। তার অন্য অংশের ভার ছিলো রুবেলের হাতে। আর রুবেলের আড়ালে দাঁড়িয়ে যিনি পুরো ম্যানুস্ক্রিপ্ট সাজাচ্ছিলেন তিনি আর কেউ নন শহিদুল ইসলাম খোকন। ‘লড়াকু’ সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রথম রুবেলকে পর্দায় হাজির করেন খোকন।এরপর এই দুজনের জুটিতে একে একে মুক্তি পেয়েছিলো উদ্ধার, বীরপুরুষ, বজ্রমুষ্ঠি এবং মাকড়শার মতো ছবি। বাংলা সিনেমায় মার্শাল আর্ট যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সামনে আসতে পারে তা প্রথম দেখিয়েছ্নে খোকন। পরে সেখানে যুক্ত হন হুমায়ূন ফরীদি। সিনেমায় নায়ক-ভিলেনের বাইনারী ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। তার সিনেমায় ভিলেন চরিত্রে ফরীদি মানে কখনো কখনো নায়কের চেয়ে অধিক জনপ্রিয় ছিলেন। ফরীদি যতটা না ভিলেন ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন চরিত্রভিনেতা।
শহিদুল ইসলাম খোকন যে কেবল অ্যাকশনধর্মী সামাজিক সিনেমায় আবদ্ধ ছিলেন তা কিন্তু না। বর্ণাঢ্য সিনেমা জীবনে বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। সাহিত্যকে সিনেমায় রূপান্তরের যে গুটিকয়েক উদাহরণ বাংলা সিনেমা দেখা গেছে তাতেও রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ এর মতো নায়িকা প্রধান উপন্যাসকে তিনি সিনেমায় রূপান্তর করে দেখিয়েছেন। এছাড়া ‘ম্যাডাম ফুলি’র মতো নায়িকা প্রধান তুমুল জনপ্রিয় নির্মাণ করে খোকন সাড়া ফেলেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘ম্যাডাম ফুলি’ এখনো একটা মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের যে বিকাশ তাতে শহীদুল ইসলাম খোকন নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব সিনেমাশৈলী দিয়ে। তার পূর্বে সিনেমার ট্রেডিশনাল যে বয়ান তাকে তিনি পুরোপুরি বাদ না দিয়ে সেখান থেকেই নিজেকে আলাদা করে চেনাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ছবিটির কথাই ধরা যাক। সিরিয়াল কিলিংয়ের অদ্ভুত এক কাহিনী নিয়ে এ সিনেমা নির্মিত হয়েছে। যেখানে কিলার ফরীদি তার প্রেমিকাদের মেরে গলার তিলের মালা বানাতো। নাগরিক অ্যাবসার্ডিটির এরকম অভিনব প্রকাশ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে আর আছে কিনা জানা নেই।
শহীদুল ইসলম খোকনের হাত ধরেই বাংলা সিনেমা নতুন একটা পথ খুঁজে নিয়েছিলো। নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক মেলোড্রামার পথ পেরিয়ে অন্য একটা পথের সন্ধান নিয়েছিলো, যা নব্বই পরবর্তী সময়ে দর্শকরা লুফে নিয়েছিলো। এসব ছবি মূলত দর্শকদের মানসিকতা পাঠ করতে পেরেছিলো দারুণভাবে। তবে মজার বিষয় একই সময়ে কাজ করেও চলচ্চিত্র জগতের অন্য এক মহাতারকা সালমান শাহ’র সাথে কোন ছবি করেননি শহীদুল ইসলাম খোকন। এই দুই সফল পরিচালক এবং নায়ক একে সাথে কাজ না করেও সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত বাংলা সিনেমার জন্য এক অভিনব ঘটনা বটে।
শেষ নব্বইয়ে বাংলা সিনেমা যখন তার পথ হারাচ্ছিলো। তখনো শহীদুল ইসলাম খোকনের মতো কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যে পরিণতি কারো ঠেকানোর উপায় ছিলো না তা ঠেকাতে পারেন নি তিনিও। যে অগ্যস্ত যাত্রায় বাংলা সিনেমা এগিয়েছে সেখানে হারিয়েছেন তিনিও। সেখান থেকে বাংলা সিনেমার ফেরার চেষ্টায় থাকলেও আর ফিরতে পারেননি শহীদুল ইসলাম খোকন। শেষ পর্যন্ত হারিয়েছেন দৃশ্যমান জগত থেকেও। তবে আধুনিক বাংলা ছবির ডাগআউটের এক কারিগর হিসেবে শহীদুল ইসলাম খোকনের নাম লেখা থাকবে আরো বহুদিন।
(লেখাটা গত ৫ এপ্রিল ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো )