শুধুই শমী-র গল্প
‘রোদ নেই জেগে ওঠা ভোরে
আজ তাই মেঘের ঘুড়ি ওড়ে
মন বলে আকাশের সূর্যটা তোমার এই ঘরে
কাছ থেকে দেখবে বলেই সে তোমার চাদরে
দূরে ছিলে ছিল তাই অনেক ভালো
মেঘ ধোঁয়া জলে ছিল স্বপ্নগুলো
তুমি এলে রাত আজ ভীষণ কালো’
গানটা মনে পড়ছে কি?
হুম ‘স্বপ্ন’ টেলিফিল্মের গান। সেই যে একুশে টিভিতে গানটি প্রায়ই দেখাত। শমী কায়সার আর লিটু আনাম দুজনকে মনে করছে আর স্মরণ করছে নানা খুনসুটি। বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে শমী, লিটুকে জলে ভিজিয়ে দিচ্ছে, রেডিয়াম বল নিয়ে খেলা করছে। অসাধারণ এ গানটি শমীর ভাই অমিতাভ কায়সারের গাওয়া। ফ্যান্টাসি ও রিয়েলিটির মিশ্রণে অসাধারণ টেলিফিল্ম ছিল ‘স্বপ্ন।’ শমীর অভিনয় স্মরণীয়।
‘যত দূর চোখ যায়
সবুজের সীমানায়
মন আমার নিমেষে হারায়
পেতে চায় মুক্তির নিঃশ্বাস
দূরে বহুদূরে আকাশ নেমে এলে পরে
সবুজের সীমা ছুঁয়ে
মন আমার নিমেষে হারায়
পেতে চায় মুক্তির নিঃশ্বাস’
এ গানটিও মনে পড়ে কি?
‘আরিয়ানা’ টেলিফিল্মের গান। শাহেদের বিপরীতে ছিল শমী কায়সার। এ গানেও কণ্ঠ দিয়েছে তার ভাই অমিতাভ কায়সার। গানে সেই সময়ের অ্যানিমেশন, কালার গ্রেডিং দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। টেলিফিল্মটিও ছিল হার্ট টাচিং স্টোরি-র।
বলছি শমী কায়সারের গল্প। একাই একটি অধ্যায় নব্বই দশকের আলোড়ন তৈরি করা একজন শিল্পী। তাকে ছাড়া নব্বই দশকের তারকাদের সম্পূর্ণ কোনো তালিকা হতেই পারে না। শমী সেই আর্টিস্ট যার সাথে অন্য কাউকে তুলনার বিন্দুমাত্র সুযোগও নেই।
শমীর জন্ম ১৫ জানুয়ারি, ১৯৬৯। ফেনীতে। বাবা সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার ও মা লেখক-রাজনৈতিক নেত্রী পান্না কায়সার। বিখ্যাতদের পরিবারে জন্ম নিয়েও শমী তার নিজ প্রতিভায় স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে পেরেছিল। ছোটভাই শিল্পী অমিতাভ কায়সার। শমীর প্রথম বিয়ে ১৯৯৯ সালে ব্যবসায়ী ও নির্মাতা রিঙ্গো-র সাথে। ২০০১ সালে ডিভোর্স হয়ে যায়। ২০০৮ সালে বিয়ে হয় ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মোহাম্মদ আরাফাতের সাথে। কয়েক বছরের মাথায় সে ঘর ভাঙে। ২০২০ সালের অক্টোবরে বিয়ে করেন ব্যবসায়ী রেজা আমিন সুমনকে।
ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েসে শমীকে জিজ্ঞেস করা হয়-‘এই অনিন্দ্যসুন্দর রূপের রহস্য কি?’ শমী বলে-‘জানতে চান? সবার আগে সুন্দর ত্বক।’ রহস্য বলার পরে শেষে বলে-‘আমার সৌন্দর্যের গোপন রহস্যটা বলে দিলাম কিন্তু।’ লাক্সের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরদের মধ্যে শমী ছিল একজন। বিজ্ঞাপনে তাকে গর্জিয়াস লেগেছে। মডেলিং-এর আদর্শ আর্টিস্টদের মধ্যে সে একজন।
নাটকের শমী বৈচিত্র্যময় ও ঈর্ষণীয় সাফল্যের অধিকারী। আশির দশকের শেষের বছর ১৯৮৯ সালে শ্রদ্ধেয় আতিকুল হক চৌধুরী তাঁর ‘কেবা আপন কেবা পর’ নাটকে নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষা বলতে পারা একজন অভিনেত্রীকে খুঁজছিলেন। শমী সে সুযোগটা পায়। নিজের পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত করেছে মঞ্চের প্রফেশনাল প্ল্যাটফর্মে। ঢাকা থিয়েটারে ছিল এক যুগ। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ‘হাত হদাই’ নাটকে অভিনয় করে নাম কুড়ায়। সহশিল্পী ছিল শহীদুজ্জামান সেলিম। তার নাটক অসংখ্য সেকাল-একাল মিলিয়ে।
টেলিভিশনে প্রথম নাটক ‘কে আপন কে পর।’ উল্লেখযোগ্য নাটক/টেলিফিল্ম – ‘আরিয়ানা, স্বপ্ন, প্রেরণা, যুবরাজ, নক্ষত্রের রাত, নয়ন, ইতিকথা, পান্থজনের সখা, তোমায় দিলাম পৃথিবী, যত দূরে যাই, রাজকুমারী, গাংচিল ভালোবাসা, নিতু তোমাকে ভালোবাসি, প্যাকেজ সংবাদ, অন্তরে নিরন্তরে, শেষের পরে, ছোট ছোট ঢেউ, বোধ, স্পর্শ, ঠিকানা, ছায়াবৃক্ষ, আকাশে অনেক রাত, গাঙচিল ভালোবাসা, প্রেমের পরীক্ষা, কোথায় সে জন, রাজকুমারী, ছায়াবৃক্ষ, বন্যার চোখে জল, কুড়িয়ে তুমি নিও, প্রতিদিন একটি গোলাপ, বৈশাখী ঝড়, নাগরিক-অনাগরিক, বৃষ্টির চোখে জল, ভুলো না আমায়, ভালোবাসা শুধায়ো না ভালোবাসি কারে, দেবো না ভুলিতে, তারায় তারায় খচিত, জীবনসাথী, পরের জায়গা পরের জমি, নক্ষত্র দিনের গল্প, আকাশ চেয়েছে পাখি, দীঘল গাঁয়ের কন্যা, ভরা পূর্ণিমা, অচেনা, কুসুম কাঁটা, গাঙচিলের পালক, খোয়াব, আশায় বসতি, লন্ডনী কইন্যা, তোমায় ছুঁয়ে, বোধ, স্পন্দন, প্রতিপক্ষ, কি হইতে কি হইল, পরিচয়, বিকেলের মেঘ, নোলক, প্রিয়া, তিনি একজন, প্রহরী, সোনার ময়না পাখি, নাটের গুরু ইত্যাদি।
প্রযোজক শমী ১৯৯৭ সালে ‘ধানসিড়ি প্রোডাকশন’ প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত হয় ‘মুক্তি, অন্তরে নিরন্তরে’ নাটকগুলো।
নির্মাণের পাশাপাশি সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের কাজেও এ প্রতিষ্ঠান জড়িত। য়ক সালমান শাহ-র সাথে ‘নয়ন’ ও ‘ইতিকথা’ নাটক/টেলিফিল্ম দুটি শমীকে বিপুল জনপ্রিয়তা দেয়। দুজনের দুইরকমের তুমুল জনপ্রিয়তা এখানে এক হয়ে গিয়েছিল। ‘নয়ন’ টেলিফিল্মে শুভ্র দেবের গাওয়া ‘এই ভালোবাসা আর এই অভিনয় থাকবে না চিরদিন থাকবে না’ গানটি আজও জনপ্রিয়।
‘যুবরাজ, নক্ষত্রের রাত, ইতিকথা’ ধারাবাহিকের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। একক কাজের মধ্যে ‘আরিয়ানা, স্বপ্ন, প্রেরণা, ছায়াবৃক্ষ, নয়ন’ জনপ্রিয়। ‘আরিয়ানা’ টেলিফিল্মে রিচি সোলায়মান যখন শমীকে বলে সে প্রেমে পড়েছে শমীর সাথে তার কথোপকথনটি অনবদ্য ছিল-
শমী : তুমি এমনভাবে বলছ যেন তুমি নিশ্চিত।
রিচি : হুম, আমি নিশ্চিত। কারণ তোমার চোখ, মুখ বলছে তুমি প্রেমে পড়েছ। প্রকৃতির মধ্যে মিশে গিয়ে মন খুলে বলো তো তুমি প্রেমে পড়েছ কিনা। দেখবে বলে দিয়েছ।
কথার পরে শমী যায় একটু দূরে খোলা মাঠে। গিয়ে হাত দুটি আকাশের দিকে ছড়িয়ে বলে-‘আই এম ইন লাভ।’ ঝরাপাতার বুক থেকে দিগন্তের বুক পর্যন্ত রোমান্টিক যে আবহ থাকে তখন তার কোনো তুলনা হয় না। শমীর অভিনয় সেসময় মাইন্ডব্লোয়িং। তার অভিনয় লাইভের মতো ঠিক চোখের সামনে যা ঘটে তাই সে অভিনয়ে দেখায়। রিয়েলিস্টিক অভিনয় যার তুলনা নেই।
চলচ্চিত্রে কাজ করেছে তিনটিতে। ‘হাছন রাজা, লালন, দ্য নেম অফ এ রিভার।’ শেষেরটি প্রখ্যাত নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের জীবনী নিয়ে নির্মিত।
শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনেত্রী হিসেবে মেরিল ভোরের কাগজ পুরস্কার ১৯৯৫ সালে পায় ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকের জন্য। এছাড়া এ পুরস্কারে ৯৬-৯৭ সালে মনোনয়ন ছিল। মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার ২০০০ সালে ও পরবর্তী বছর ২০০১ সালে পায়। মনোনয়ন ৯৮-২০০১ পর্যন্ত ছিল। ২০০৫ সালে মেরিল প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার পায়। ২০০৭ সালে নায়ক রিয়াজের সাথে উপস্থাপনায় ছিল একটি অনুষ্ঠানে। ২০০৩ সালে অভিনেতা জাহিদ হাসানের সাথে নাচের পারফর্ম করতে গিয়ে কাচের চুঁড়ি ভেঙে শমীর হাত কেটে গিয়ে বেশ রক্ত ঝরেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে জাহিদ হাসানের সাথে শমীর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। আব্দুর নূর তুষার-এর উপস্থাপনায় একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে তৌকীর আহমেদের সাথে শমীর দারুণ আড্ডা জমেছিল। ঐসময় অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়েছিল খুব।
নন্দিত শমী সরকার পরিবর্তনের পরে নিজের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বিটিভিতেই কাজ পায়নি। রাজনীতির শিকার হয়ে তাকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে। অপি করিমের উপস্থাপনায় ‘অপি-স গ্লোয়িং চেয়ার’ প্রোগ্রামে শমী তার সেইসব দুঃখের দিনের স্মৃতিচারণ করেছে।
শমী কায়সার শুধুই নাম নয় একটা, একটা আইকন অভিনয়জগতের। তাঁর জনপ্রিয়তা, স্টারডম, অভিনয়গুণ, ব্যক্তিত্ব থেকে আজকের বা অনাগত দিনের তারকাদের শেখার আছে অনেককিছু। শমী চিরদিন তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রিয়দের একজন হয়ে থাকবে দর্শকের মাঝে।