সযত্নে থাকুক ‘হলুদবনি’
হলুদবনি (২০২০)
ধরণঃ ড্রামা
গল্পঃ সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
পরিচালনাঃ তাহের শিপন ও মুকুল রায় চৌধুরী
প্রযোজনাঃ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও টেলিসিনে মাল্টিমিডিয়া প্রা.লি.
অভিনয়ঃ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় (পলাশ), নুসরাত ইমরোজ তিশা (অণু), পাওলি দাম (কস্তুরী), সোমা চক্রবর্তী (অণুর মা) প্রমুখ।
শুভমুক্তিঃ ৬ ই মার্চ, ২০২০ (বাংলাদেশ); এপ্রিল, ২০২০ (ভারত)।
নামকরণঃ গল্পের প্রায় পুরোটাই হলুদবনি নামক মফস্বল কে কেন্দ্র করে সামনে এগিয়েছে। হলুদবনি তে রয়ে যাওয়া চরিত্রগুলোর অতীত স্মৃতি, হলুদবনির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, হলুদবনির একটি বাড়িতে বসবাসকারী সদস্যদের টানাপড়েন… এসবকিছুই উঠে এসেছে এই অদ্ভুত সুন্দর জায়গাকে কেন্দ্র করে। এছাড়া যে উপন্যাস অবলম্বনে এছবি নির্মাণ করা হয়েছে, তার নামও “হলুদবনি” ই ছিল। তাই নামকরণ হিসেবে এছবির নাম “হলুদবনি” আমার কাছে যথার্থ মনে হয়েছে।
কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপঃ ওপার বাংলার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এর উপন্যাস “হলুদবনি” অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। সেই উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্রের জন্য উপযুক্ত চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন ভারতের পদ্মনাভ দাশগুপ্ত।
হলুদবনি ভারতের পূর্বী সিংহভূম জেলায় অবস্থিত পাহাড়টিলায় ঘেরা একটি অঞ্চল। এটি ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশে অবস্থিত। জায়গাটি ততটা জনবহুল না হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা। কস্তুরীর (পাওলি দাম) ছোটবেলা এরকম একটি জায়গায় কেটেছে। বর্তমানে তিনি একজন সফল কর্মজীবী, জীবনে তার অর্থ, ঐশ্বর্য ও সম্মানের কোনো অভাব নেই। তবে অভাব একটা আছে, সঙ্গী। তাই একাকীত্বের টানে তিনি ফিরে যান তার সেই ছোটবেলার জায়গায়। তো সেখানে গিয়ে কি কি হয় এবং তার গল্পে পলাশ (পরমব্রত) ও অণু (তিশা) কীভাবে জড়িয়ে যায়, সেটাই দেখতে পাওয়া যায় প্রায় দুই ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের এছবিতে।
ছবি শুরু থেকেই কিছুটা ধীরগতিতে এর স্তম্ভ তৈরি করেছে। এধরনের গল্প সাধারণত ধীরেসুস্থেই গড়ে ওঠে, এতে করে দর্শককে ভালোভাবে চলচ্চিত্রের সাথে কানেক্ট করিয়ে নেওয়া যায়। তাই প্রথমার্ধ দেখতে-শুনতে খারাপ লাগবে না। চিত্রনাট্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংযুক্ত করা হয়েছে যাতে করে হলুদবনির কৃষ্টি-কালচারের সাথে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। অপরদিকে দ্বিতৗয়ার্ধে গল্প বলার গতি বৃদ্ধি না পাওয়ায় একটা সময় গিয়ে দর্শকমনে ছেদ কাটতে পারে। উপরন্তু কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি গল্প বলার খাতিরে সংযুক্ত করায় এগুলো গল্পের গতিকে বারংবার বাধাগ্রস্ত করে। ফলে হয় কি, একটা সময় গিয়ে প্রেক্ষাগৃহে থাকা দর্শকেরা গল্পের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে ধৈর্য্যের পরীক্ষায় বসতে শুরু করেন, অপেক্ষার প্রহর গোনেন এ গল্পের শেষ টা দেখার।
ততটা অর্থবহ কিংবা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো সংলাপ হয়তো এই ছবিতে খুজেঁ পাওয়া যাবে না। কারণ সংলাপগুলোকে একদম সাধারণ এবং স্বাভাবিক রাখা হয়েছে, যেমন করে আমরা আমাদের আপনজনদের সাথে কথা বলে থাকি।
এ অংশ পাবে ৭০% মার্ক।
পরিচালনাঃ যৌথভাবে “হলুদবনি” পরিচালনা করেছেন আমাদের তাহের শিপন এবং কোলকাতার মুকুল রায় চৌধুরী। এদের এটি দ্বিতীয় ছবি, এর আগে দুজনেই যথাক্রমে “একাত্তরের নিশান” (২০১৭) ও “টান” (২০১৪) নামে একটি করে চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন।
এছবিতে তাদের পরিচালনা আমার কাছে মোটামুটি লেগেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হচ্ছিল চমকপ্রদ কোনো কাজ দেখতে পাচ্ছি, ওরকম ফিল যদি পুরো ছবিজুড়ে বিরাজমান থাকতো তবে “হলুদবনি” একটা দারুণ ছবি হতে পারতো। আফসোসের বিষয় এটাই, দুজনেই যেহেতু অভিজ্ঞতার দিক থেকে তরুণ, তাই হয়তো পুরো ছবি মনে গেথে রাখার মতো হয়নি। আশাকরি ভবিষ্যতে তাদের কাছ থেকে এর থেকে ভালো নির্মাণ পাবো।
অভিনয়ঃ গল্পে চরিত্র খুবই কম, বড়জোর ১০/১১ টি হবে। পুরো গল্পটাই মূলত তিনটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে; পলাশ, কস্তুরী ও অণু। গল্পে তিনটি চরিত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
কোলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে এবার এক ভবঘুরের চরিত্রে পাওয়া গেলো, যিনি কাজের খোঁজে রয়েছেন। অভিনয়ের সময় তার বাচনভঙ্গিতে এক ধরনের বিশেষত্ব দেখা যায়, আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে আমতা-আমতা করে কথা বলি। এই দিকটা অনেক তরুণ অভিনেতার জন্যই শিক্ষণীয় হতে পারে। কারণ আমরা আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে কখনোই সর্বদা স্পষ্টভাষায় কথা বলতে পারি না। কখনো স্পষ্ট আবার কখনো অস্পষ্ট, অনেকসময়ই উচ্চারণ অনুসারে আমাদের বলা শব্দগুলো স্পষ্ট হয় না, যেটা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে খুজেঁ পাওয়া যায়।
ব্যক্তিগত পারসেপশনের দিক থেকে যদি বলি, তবে একটি বিষয়ে আমি অন্য সবার সাথে সম্পূর্ণ একমত, তিনি যেকোনো চরিত্র ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারদর্শী। যেমন এছবিতে তিনি উচ্চপদস্থ চাকরি করা একজন বিত্তশালী, স্মার্ট চাকরিজীবীর চরিত্র রূপদান করেছেন। এরকম চরিত্র যেমন তিনি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, ঠিক তেমনি এর সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বহু চরিত্র তিনি এর আগে সফলভাবে রূপদান করেছেন। সফল অভিনেত্রীদের বিশেষত্ব হলো এটি।
বাঙালি নারীদের কল্পনা করলে যেরকম অবয়ব খুজেঁ পাওয়া যায়, অণু চরিত্র রূপদান করা নুসরাত ইমরোজ তিশা যেনো সেরকম এক অবয়বের প্রতিচ্ছবি। তার স্ক্রিণপ্রেজেন্সে এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা আছে, এগল্পে যখন তিনি পর্দায় আসেন তখন সবকিছু কেমন যেনো রঙিন মনে হয়েছে। তার চরিত্রে বেশ ভালো গভীরতা খুজেঁ পাওয়া গেছে। ছবির বাকি দুই চরিত্রের মতো তার চরিত্রটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
ছবিতে থাকা বাকি চরিত্রগুলি যারা রূপদান করেছেন তাদের ব্যাপ্তি খুবই কম। তাই উল্লেখ করার মতো কিছু করে দেখানোর কোনো সুযোগ পাননি। তবে যতটুকু পেরেছেন তারা তাদের সক্ষমতার প্রমাণ রেখে গেছেন।
এ অংশ পাবে ৯০% মার্ক।
কারিগরিঃ ছবির সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিলেন সামিত গুপ্ত ও তাপস কুমার রাহা, তাদের কাজ আমার কাছে মোটামুটি লেগেছে। দিনের বেলার অংশে তাদের কাজ বেশ ভালো হয়েছে, তবে রাতের সৌন্দর্য্য এছবিতে ভালোভাবে ফুটে ওঠেনি। এছাড়া যে বাড়িকে ঘিরে এছবির গল্প, সেটি আরো সুন্দরভাবে দেখানোর প্রয়োজন ছিল। বিপরীতে আবার তারা হলুদবনি এলাকাটিকে বেশ ভালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন।
ছবির সম্পাদনার কাজ করেছেন অর্ঘ্য কুমার মিত্র। কিছু কিছু জায়গায় দূর্বলতা ছিল, এছাড়া লেন্থ একটু বেশি হয়ে গেছে মনে হয়েছে। বাকি সব ঠিকঠাক। পুরো ছবিটি ভারতের ঝাড়খণ্ডের হাজারীবাগে শ্যুট করা হয়েছে, এর মধ্যে কিছু অংশ ঢাকার বনানীতে চিত্রায়িত। কস্টিউম, মেকআপ এগুলোর পারফেক্ট ছিল। মিউজিকের কাজ আমার কাছে একটু দূর্বল লেগেছে, আকর্ষণীয় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের অভাব আছে এছবিতে। সুমিত মিত্র মিউজিকের দায়িত্ব সামলিয়েছেন।
এ অংশ পাবে ৪০% মার্ক।
বিনোদনঃ এছবিতে তেমন কোনো বার্তা পৌছানোর চেষ্টা করা হয়নি, কিংবা নাচ-গান, এ্যাকশন প্রবেশ করিয়ে এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু বাড়ানো হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হলো কেন একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হলো? এক্ষেত্রে মনে হলো চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা চেয়েছেন এমন একটি গল্প শোনাতে, যা আপনার শরীরের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে মনকে তরতাজা করে দিবে। মনের চারপাশ দিয়ে এক টুকরা প্রশান্তির হাওয়া যেনো বয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টাই এছবিতে করা হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে বেশ বড় একটা বাধা হয়ে দাড়িয়েছে এছবিতে থাকা অত্যধিক গান এবং গানের মাধ্যমে গল্পকে তুলে ধরা। ছবিতে মোট ছয়টি গান রয়েছে। “বাবা হরি হরনাথ” নামে একটি জনপ্রিয় বিহারী/ভোজপুরী গানকে এছবিতে রিক্রিয়েট করা হয়েছে। এগানটি আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে, গানটির মাধ্যমে দোলযাত্রার সৌন্দর্য্যকে শৈল্পিকতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া ছবির প্রথমার্ধে আরো একটি গান ছিল যেটি ভালো লেগেছে। বাকি চারটি গানের মধ্যে দুইটি আমার কাছে মোটামুটি লেগেছে, আর বাকি দুইটির ক্ষেত্রে মনে হয়েছে এগুলো “হলুদবনি” এর গতি কমিয়ে দিয়েছে, না থাকলেও হতো।
এ অংশ পাবে ৬০% মার্ক।
ব্যক্তিগতঃ এছবির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ এর দিকে, সময়ের হিসাবে তিন বছর পর ছবিটি মুক্তি পেলো। সম্ভবত ছবিটির ক্ষেত্রে সংশোধন করার পূর্বের যৌথ প্রযোজনা নিয়মনীতি দেখে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কারণ সংশোধিত নিয়মানুযায়ী এছবি অনেকক্ষেত্রেই যৌথ প্রযোজিত ছবি হয়ে পারেনি। রাস্তায় লাগানোর পতাকার ঝালর থেকে শুরু করে গল্পের বেসমেন্ট হলুদবনি পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই এছবি কেন যেনো বাংলাদেশের হয়ে উঠতে পারেনি।
কাস্টিং ডিরেক্টরও তার কাজে সমতা ধরে রাখতে পারেননি। যেখানে মনে হয়েছে, শতকরা ৩০-৪০ ভাগ কলাকুশলী ছিল আমাদের দেশের। হয়তো তারা তাদের সুবিধার্থে এগুলো করে রাখেন। তবে আমার মতে, অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও অন্তত অভিনয়শিল্পীদের ক্ষেত্রে ৫০-৫০ সমতা রাখা উচিত।
সবমিলিয়ে বলবো “হলুদবনি” চেষ্টা করেছে একটি সাধারণ গল্পকে সাধারণভাবেই বলার। এর মাঝেই অসাধারণ কিছু মুহুর্ত তৈরি হয়েছে। তবে গল্প বলার ধীরগতি এবং অযাচিত টেনে গল্পকে দীর্ঘায়িত করায় ছবিটি অসাধারণ কিছু হয়ে উঠতে পারেনি।
রেটিংঃ ৬.৫/১০
ছবিটি কেন দেখবেনঃ আপনি যদি ভালো অভিনয়ের ভক্ত হয়ে থাকেন তবে বিনাসংকোচে, নির্দ্বিধায় চলে যান স্টার সিনেপ্লেক্স কিংবা যমুনা ব্লকবাস্টারে। যেখানে পরমব্রত, তিশা এবং পাওলির মতো সুঅভিনয়শিল্পী আছেন, এছবি ভালো অভিনয় উপভোগ করা দর্শকদের যথেষ্ট তৃপ্তি দেবে।