সুশীতল করেছে ‘জান্নাত’
জান্নাত
পরিচালনা: মোস্তাফিজুর রহমান মানিক
অভিনয়ে: মাহিয়া মাহি, সাইমন সাদিক, মিশা সওদাগর, আলীরাজ, শিমুল খান, চিকন আলী, রেহানা জলি, মারুফ, রিলু রিয়াজ, বিশেষ চরিত্রে আরেফিন রুমী ও রাহা তানহা খান
রেটিং: ৩.৫/ ৫
এই তো কিছুদিন আগেও ছোট পর্দায় ঈদের নাটক মানেই ছিল দম ফাটানো হাসির নাটক। যে নির্মাতা-নাট্যকার যত বেশি দম ফাটাতে (!) পারবেন, তিনি তত বেশি সফল। ‘বিকাল বেলার পাখি’ কিংবা ‘বড় ছেলে’র মত নাটকগুলো এই বিপ্লবের কান্ডারী। এখন ঈদের নাটকে যত বেশি কান্না, তত বেশি ‘ইউটিউব’ ভিউজ, তত বেশি টিভি চ্যানেলের টিআরপি। চলচ্চিত্রের জন্য প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা কিংবা পরিবেশকরা খুব সম্ভবত এখনো এই বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত নন । গাঁজাখুরি কোনো গল্পের চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বাধা নেই, কিন্তু একটু ভিন্ন, সম্পূর্ণ মৌলিক চলচ্চিত্র ঈদ উৎসবে প্রদর্শনের ব্যাপারে তাদের রাজ্যের অরুচি; এবারের ঈদে যে রূঢ় সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হয়ে গেল।
ঈদের মাত্র তিন দিন আগে সেন্সর হওয়া মাহিয়া মাহি অভিনীত ‘মনে রেখো’ মুক্তি পেয়েছে ৭০টি প্রেক্ষাগৃহে; যে চলচ্চিত্রের গল্প শুধু গাছেই চড়েনি, আকাশে উড়ে আবার ধরণীতে পতিত হয়েছে। ভয়ানকভাবে কারণ হয়েছে আমাদের মস্তিষ্ক বেদনার। অন্যদিকে মাহিয়া মাহি’র-ই আরেকটি চলচ্চিত্র ‘জান্নাত’ ২৫ মার্চ সেন্সর ছাড়পত্র পাবার প্রায় ৫ মাস পর মুক্তি পেয়েও প্রেক্ষাগৃহ পেয়েছে মাত্র ২৩টি; অথচ এ চলচ্চিত্রটির গল্প সমসাময়িক, মৌলিক এবং বেশিরভাগ দিক দিয়েই ‘মনে রেখো’র তুলনায় এগিয়ে। বিষয়টি হতাশাজনক। অবশ্য এ ছবির নায়িকা মাহিয়া মাহিও পত্রিকার মাধ্যমে বলেছেন, ‘জান্নাত’ ঈদে মুক্তি দেয়া ঠিক হয়নি।’ তবে এ ব্যাপারে আমি দ্বিমত পোষণ করি। ঈদের ছবি মানেই ‘লাড়ে লাপ্পা’ নকল কাহিনীর ছবি হবে, যুক্তির দরজাগুলো বাসায় তালা দিয়ে প্রেক্ষাগৃহে এসে যা ইচ্ছা তাই দেখতে হবে-এমন দিন বদলে যাওয়াটা এ মুহূর্তে খুব জরুরী। বিরহের মাঝেও বিনোদন আছে, কান্নার মাঝেও পূর্ণতা আছে। ঈদ উৎসবে অবশ্যই আমরা মসলাদার চলচ্চিত্র দেখবো, তবে পাশাপাশি মসলা কম, কিন্তু পুষ্টিযুক্ত সুস্বাদু চলচ্চিত্রকেও টেবিলে সম্মানজনক জায়গা করে দেয়া আমাদের সবারই কর্তব্য।
সরাসরিই বলি, ‘জান্নাত’ আমার জানে পানি দিয়েছে। নকল/ মানহীন ছবির ভীড়ে ‘জান্নাত’ সুশীতল করেছে আমাদের। যদিও ২ ঘন্টা ২৫ মিনিট ব্যাপ্তির এ ছবিটি অন্তত ১৫ মিনিট কমিয়ে আনার যথেষ্ট সুযোগ ছিল, তবে এ ছবির যতটুকু দুর্বলতা তা এড়িয়ে যাবারই চেষ্টা করেছি। কারণ, প্রথমত: আমাদের মূলধারার বানিজ্যিক ছবিতে আজকাল মৌলিক গল্প নিয়ে কাজ করার সাহস করেন খুব কম নির্মাতা। বড় পর্দায় বাংলাদেশকে এবং বিশেষ করে এ সময়ের বাংলাদেশকে খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। ‘জান্নাত’ এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মৌলিক গল্পের সাহসী ও সময়োপযোগী একটি চলচ্চিত্র। দ্বিতীয়ত: পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক তার প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলোতে আমাকে মুগ্ধ করলেও শেষ কিছু চলচ্চিত্রে (কিছু আশা কিছু ভালোবাসা, ইটিশ পিটিশ প্রেম) হতাশ করেছিলেন। তার ৭ নম্বর চলচ্চিত্র ‘জান্নাত’ দেখার পর নির্দ্বিধায় বলবো, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক খুব ভালোভাবেই ফিরে এসেছেন। পরম যত্ন দিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘জান্নাত’। তরুণ ডিজাইনার সাজ্জাদুল ইসলাম সায়েমের দৃষ্টিনন্দন পোস্টারগুলো মূল প্রচারণায় (রাস্তায়, প্রেক্ষাগৃহে) পরিচালক ব্যবহার করেছেন। অন্যদের মত হল পোস্টার এবং অনলাইন পোস্টারের মধ্যে বিভেদ করেননি। এজন্য তাকে এবং ডিজাইনার সায়েমকে বিশেষ ধন্যবাদ। তৃতীয়ত: আজকাল প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হবার পর প্রায়ই সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রের নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পাই না। ‘জান্নাত’ দেখবার পর যা পেয়েছি। ছবিটি দেখতে গিয়ে প্রতিটি বাঁকে আবিষ্কার করেছি, সত্যিই তো, আমাদের সবকিছুর একটিই আরাধ্য গন্তব্য: জান্নাত। এই জান্নাত লাভের আশায় কেউ সঠিক পথে ছোটেন। কেউ ভুল পথ বেছে নেন। কিন্তু বিপথে যাওয়া উগ্রবাদীদের যে আসলে কোনো ধর্মই নেই, সে বার্তাই একটি প্রেমের গল্পের মোড়কে মুড়িয়েছেন পরিচালক মানিক। এ ক্ষেত্রে গল্পকার সুদীপ্ত সাঈদ খান এবং চিত্রনাট্যকার আসাদ জামান তাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন। যদিও ছবির গল্প, বিশেষ করে শেষ পরিণতির অধ্যায়টি কাকতালীয়ভাবে আমির খান ও কাজল অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ফানা’র কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠেই বলবো, ‘জান্নাত’ একটি মৌলিক চলচ্চিত্র। ভালো চলচ্চিত্র। তবে এই আন্তরিক প্রচেষ্টা ‘কালজয়ী চলচ্চিত্র’ হতে গিয়েও হয়নি। তার একটিই কারণ: বাজেটের দৈন্যতা, সঠিক প্রচারণার অভাব। ‘জান্নাত’ দেখতে গিয়ে বার বার ভাবছিলাম: কারিগরী দিক দিয়ে এ ছবিটি নামজাদা কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রযোজকের হাতে পড়লে অন্য উচ্চতায় চলে যেতে পারতো। এ ধরনের গল্পে ভিএফএক্সের কাজ হওয়া চাই নিখুঁত (যা এখানে পাইনি)। অ্যাকশন হওয়া চাই স্মার্ট (এ ছবিতে বেশ সেকেলে)। সম্পাদনা হওয়া চাই ধারালো, আধুনিক (এ ছবিতে বাজেটের স্বল্পতা প্রকট আকারে ধরা পড়েছে)। শিল্প নির্দেশক এ ছবিতে হাসপাতাল বোঝাবার জন্য সাদা পর্দার গায়ে লাল রঙা স্কচটেপ লাগিয়েই কাজ সেরেছেন।
শুধু তাই নয়, এ ছবিটিকে মাহিয়া মাহি ও সাইমন সাদিক তাদের অভিনয় ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র বললেও ‘জান্নাত’ মুক্তির আগে কিংবা পরে তাদের খুব একটা প্রচারণা করতে (বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলে) দেখা যায়নি। সাইমনকে তাও টুকটাক দেখা গিয়েছে, মাহি ছিলেন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এর কারণ কি? একটি চলচ্চিত্রের প্রতি নায়ক-নায়িকা দরদ না দেখালে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে আসবেন কেন? প্রচারণার বিষয়টি নিয়ে প্রযোজক, পরিচালক থেকে শিল্পীদের আরো অনেক বেশি গবেষনা করতে হবে, আন্তরিক হতে হবে।
পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক ‘জান্নাত’ চলচ্চিত্রে প্রমাণ করেছেন, তিনি তার কাজটি বোঝেন। জঙ্গীবাদের মত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেননি। তবে কোনো শিল্পই সাধারণত নিখুঁত হয় না। মানিকের এই চলচ্চিত্র নিয়েও আমার বেশ কিছু খেদ রয়েছে। প্রথমত: এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে নির্মাতা দুই নৌকোয় পা না রাখলেও পারতেন। ‘গেরিলা’ কিংবা ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রের সঙ্গে যেমন আইটেম গান মানায় না, ঠিক তেমনি ‘পাংকু জামাই’ জাতীয় চলচ্চিত্রে কবিতা কিংবা ভারী কোনো কাব্যিক সংলাপ চলে না। ‘জান্নাত’ নির্মাণ করতে গিয়ে মানিক একই সঙ্গে শিল্পমানসমৃদ্ধ ছবিটিকে বানিজ্যিক উপাদানের প্রলেপ দিতে চেয়েছেন; যে কারণে ছবির চরিত্রগুলো কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। একজন খাদেমের মেয়ে, যিনি নিজেও একজন পরহেজগার, সেই জান্নাত (মাহি) কেন সারাক্ষণ চড়া মেকআপে নিজেকে রাঙিয়ে রাখবেন? গ্রামের মেয়ে সাজগোজ করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে পরহেজগার একটি মেয়ে চোখে মোটা দাগের আইল্যাশ, উজ্জ্বল রংয়ের লিপস্টিক এবং আলনা ভর্তি উজ্জ্বল রংয়ের সব পোশাক ছাড়া কিছুই বুঝবেন না? এমনকি জায়নামাজে বসেও নামাজ পড়ার সময় মাহির সাজ, চুলের স্টাইল বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। মেনে নিলাম, বাংলা সিনেমার নায়িকাকে নন-গ্ল্যামারাস হওয়া যাবে না। কিন্তু তাই বলে, চরিত্রের সাথে যায় না এমন অবিশ্বাস্য কিছুও কি দেখানো ঠিক? ‘যদি এক পলকে’ গানে লাল শাড়িতেও অহেতুক মাহির দেহসৌষ্ঠব দেখানোটা বানিজ্যিক কারণ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। গান দেখে যদি একটি ছবির একটি চরিত্রকে অন্য ছবির অন্য চরিত্র থেকে আলাদা করা না যায়, তাহলে আর প্রতিটি চলচ্চিত্রে নতুন গান করার দরকারটাই বা কি? মেকআপ ছাড়াই মাহি সুন্দরী। স্বল্প সাজে শুভ্র মাহি এ চরিত্রে আরো আকর্ষণীয় হতে পারতেন। তবে মাহির এই সাজ চড়া লাগবার পেছনে আলোক সম্পাত এবং ক্যামেরার কারুকাজ কতটা দায়ী, তা ভেবে দেখার বিষয়।
অবশ্য শুধু ‘জান্নাত’ মাহি নন, এ ছবিতে খাদেম নূর মোহাম্মদ (আলীরাজ) থেকে ধার্মিক পুরুষ আসলাম (সাইমন) এবং পীর (মিশা সওদাগর) প্রত্যেকেই চোখে লাগার মত উজ্জ্বল রঙয়ের পোশাক পরিধান করেছেন। এ বিষয়ে আরেকটু যত্নশীল হওয়া যেতো। চরিত্রায়ণের ব্যাপারেও গল্পকার এবং চিত্রনাট্যকার বিশেষ ধ্যান দিতে পারতেন। শিমুল খান, চিকন আলী যতটুকু ছিলেন, ভালো। তবে আরোপিতভাবে কমেডি’র সংযোগ চোখে লেগেছে। এ ছবিতে হাস্যরসের আয়োজন না থাকলেও বানিজ্যে কোনো হেরফের হতো না। মিশা সওদাগরের চরিত্রও পূর্ণতা পায়নি। তার চরিত্রটি গল্পে আরো নানা ভাবে ব্যবহার করা যেতো। তবে শেষ পর্যন্ত সেটিও হয়নি। বিরতির আগে দর্শকদের বড় ধরনের একটি ধাক্কা দিয়েছেন পরিচালক। নড়ে চড়ে বসেছেন সবাই। টান টান উত্তেজনা। কিন্তু সব উত্তেজনায় পানি ঢেলে দেয় ‘মন যদি ভেঙে যায়’ গানটি। এ গানটি বিরতির পর এলে চিত্রনাট্যের বুনন আরো অনেক বেশি পোক্ত হতো। ছবির শেষাংশে আলীরাজ-সাইমনের পরিণতির দৃশ্য আরো নাটকীয় হতে পারতো। যৌক্তিক হতে পারতো। দীর্ঘক্ষণ মাজারে তারা বাগবিতন্ডায় মেতে উঠলেন, কিন্তু আশেপাশে একটি কাক পক্ষীও সেটি দেখলেন না-বিষয়টি অবান্তর। আসলামের মায়ের মৃত্যুর দৃশ্য এত ঝটপট দেখানো হয়, দর্শকরা হেসে ফেলেন। যেন এ ছবিতে মায়ের আগমনই হয়েছে মৃত্যু দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য। পহেলা বৈশাখে গানের অনুষ্ঠানে আসলাম বৈশাখের কোনো পোশাক পড়লে আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় হতো। বিশেষ করে উপস্থিত দর্শকদের কেউই তেমন বৈশাখের পোশাক গায়ে জড়াননি। এই দৃশ্য নির্মাণে আরেকটু যত্নশীল হওয়া যেতো। এ ছবির দু-একটি দৃশ্যে ভায়োলেন্সের আধিক্য রয়েছে (কবি হত্যা, ব্লগার হত্যা)। কোমলমতি দর্শক কিংবা শিশুদের জন্য ছবির শুরুতে একটি সাবধানতামূলক টেলপ দেয়া যেতো। বোমা সিরিজের পরিকল্পনা এবং কিভাবে ব্লগার কিংবা লেখকদের হত্যা করা হয়-তার নেপথ্যের কিছু কাহিনী দেখালেও চিত্রনাট্য আরো অনেক বেশি রোমাঞ্চকর হতো, নতুনত্বের স্বাদ পেতো বাংলা সিনেমা।
তবে অভিযোগের উল্টোপিঠে এ ছবির লেখকদের নিয়ে দু’কথা না বললেই হয়। পরিচালক মানিককে শুরুতেই ধন্যবাদ তরুণ লেখকদের মূল ধারার চলচ্চিত্রে এভাবে সুযোগ করে দেয়ার জন্য। সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রই এখন চলে নিত্যনতুন কনসেপ্টের ওপর। কাহিনীকার সুদীপ্ত সাঈদ খান এ ক্ষেত্রে সময়োপযোগী জঙ্গিবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলা ছবির দর্শককে নতুন একটি গল্প উপহার দিয়েছেন। আর সে গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রের জন্য নান্দনিকভাবে খেলেছেন চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা আসাদ জামান। মূল চরিত্রগুলো যে ধর্মভীরু তা প্রায় প্রতিটি সংলাপেই বিলক্ষণ বোঝা গেছে। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে মহানবীর সেই দুষ্টু বুড়ির রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে রাখার গল্পও এসেছে খুব সুন্দরভাবে। এ ছবিতে ক্ষুধার্ত আসলামের ভাত খাওয়ার দৃশ্য থেকে আসলামের মাছ ধরার দৃশ্য, প্রকৃতির ওপর অভিমান করে জান্নাতের বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য, পাঞ্জাবী সেলাইয়ের দৃশ্য, মৃত মায়ের সাথে মেয়ের কথা বলা, কবি ও ব্লগার হত্যা, মিলাদ, চরপাখিকে উপসর্গ হিসেবে ব্যবহার করে প্রেমের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া-প্রতিটি প্রেক্ষাপটই নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর দশটা চলচ্চিত্র থেকে এ ছবির সংলাপও বেশ শ্রুতিমধুর (চরিত্রহীন খুনীর কোনো ধর্ম হয়না/ জগতে কেউ আর একা না, সবার জন্য আল্লাহ আছেন/ এই পাঞ্জাবিটা হলো আমার হৃদয়, হৃদয় ভেবেই যত্নে সেলাই করছি)। চলচ্চিত্র লেখায় যে নতুন কারো হাত পড়েছে, স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে। সুশিক্ষিত পরিচালককে বিশেষভাবে ধন্যবাদ, আসাদ জামানের পদবী তিনি ছিনতাই করেননি। আজকাল অনেক পরিচালকই নিজের নামের পাশে অন্যায়ভাবে চিত্রনাট্যকার পদবী ঝুলিয়ে মূল চিত্রনাট্যকারকে শুধুমাত্র কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতা পরিচয়েই তুষ্ট থাকতে বলেন। এই গর্হিত অপরাধ করেননি মোস্তাফিজুর রহমান মানিক। এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই।
মাহিয়া মাহি এ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। মাহির মেকআপ নিয়ে অভিযোগের কথা আগেই বলেছি। তবে এবার বলবো তার অভিনয়ের কথা। ‘জান্নাত’ মাহির ভক্তদের জন্য পরিচালকের বিশেষ উপহার-তা চলচ্চিত্রটি দেখবার সময়ই বুঝেছি। পোড়ামন, অনেক সাধের ময়না, কৃষ্ণপক্ষ, অগ্নি-এই ছবিগুলোর সাথে এবার ‘জান্নাত’ যোগ হতে পারে অনায়াসে। ‘মনে রেখো’ চলচ্চিত্রে মাহি যতটাই আশাহত করেছেন, ‘জান্নাত’-এ ঠিক ততটাই মুগ্ধ করেছেন। মাহি আবারো প্রমাণ করেছেন, তাকে অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হলে তিনি নিরাশ করেন না। যদিও ডাবিংয়ে এবং ভয়েস মড্যুলেশনের ব্যাপারে মাহি সামনের দিনগুলোতে আরেকটু যত্নশীল হতে পারেন। তবে সব মিলিয়ে ‘জান্নাত’ তার ক্যারিয়ারে উল্লেখযৌগ্য সংযোজনই বলবো। বিশেষ করে বৃষ্টির দৃশ্য, প্রজেক্টরে আসলামের প্রকৃত পরিচয় দেখাবার সময় বোরখা পড়া অবস্থায় তার চোখের অভিব্যক্তি, হাজতে আসলামকে দেখে ফিরে আসার পর অভিব্যক্তি এবং শেষ অ্যাকশন দৃশ্যে মাহির অভিনয় দর্শক দীর্ঘদিন মনে রাখবেন। দু-একটি দৃশ্যে মাহির অভিনয় ও কণ্ঠস্বর চিত্রনায়িকা শাবনূরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।
নায়ক সাইমন সাদিক’কে সর্বশেষ দর্শকদের চমকে দিতে দেখেছিলাম ‘পোড়ামন’ ছবিতে। এরপর তিনি অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে ‘পোড়ামন’-এর অভিনয়কে তিনি ছাপিয়ে গিয়ে নতুন করে চমকে দিয়েছেন ‘জান্নাত’ চলচ্চিত্রে। তার সরল অভিব্যক্তি, চরিত্রের সাথে মিশে যাবার সততা ও আন্তরিকতা ছিল শতভাগ। আসলাম ও ইফতেখার দুটি চরিত্রে আরো অনেক বেশি তফাত আশা করেছিলাম। পাইনি। ‘আসলাম’ চরিত্রটিতে তার অভিনয়কে আমি এগিয়ে রাখবো। ‘ইফতেখার’ হিসেবে আরো হিংস্র সাইমন আশা করেছিলাম। তবে হতাশ হইনি। এটা ঠিক, কিছু উচ্চারণে (যেমন: ‘অবশিষ্ট’ বলতে গিয়ে ‘অবসিষ্ট’ বলেছেন) এবং ভয়েস মড্যুলেশনে ভবিষ্যতে তার আরো অনেক বেশি সাধনা করা প্রয়োজন। তবে সব মিলিয়ে সাইমন আমাকে মুগ্ধ করেছেন। বিশেষ করে ‘পোড়ামন’ এর পর সাইমন-মাহি জুটি নতুন করে তাদের চমৎকার রসায়ন উপহার দিয়েছে এ ছবিতে। নির্মাতারা এ জুটিকে নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবতে পারেন।
মিশা সওদাগরের এ ছবিতে আগমন একটি হামদের মাধ্যমে। গানের সুর, সেই সাথে মিশা সওদাগরের অভিব্যক্তি, লুক-সব মিলিয়ে দর্শকরা তাকে দেখে পুরোটা সময় আনন্দে চিৎকার করেছে। তিনি যতটুকু সময় অভিনয় করেছেন, তার অভিনীত চরিত্রে থেকেছেন। বাহুল্যতা ছিলনা। তবে আগেই বলেছি, এই চরিত্রের আরেকটু বিস্তার আশা করেছিলাম। মিশা সওদাগরকে এ ছবিতে আরো নানা ঢংয়ে ব্যবহার করা যেতো।
অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে আলীরাজ সৎ থেকেছেন তার চরিত্রে। অভিনয় করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন এবং তিনি তার মত করে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে পর্দায় আসার চেষ্টা করেছেন। যদিও তার কৃত্রিম দাড়ি ও চুল এ ক্ষেত্রে তাকে বার বার বাধা দিয়েছে। রূপসজ্জাকর খুব হাস্যকরভাবে তাকে এই উদ্ভট ‘লুক’ দিয়েছেন। খুব আফসোস হয় এসব দেখে, কবে আমরা রূপসজ্জার পেছনে আরেকটু মনোযোগী হবো কিংবা আরেকটু বেশি বাজেট ব্যবহার করবো?
শিমুল খান, চিকন আলীর কথা আগেই বলেছি, তাদের চরিত্রের সঠিক চিত্রায়ণ হয়নি। রেহানা জলি ছোট্ট চরিত্রে বরাবরের মতই অভিনয করেছেন। মারুফ ও রিলু রিয়াজ স্বাভাবিক ছিলেন, আন্তরিক ছিলেন। তবে মারুফ ‘আই এম রাইট?’ বলে প্রশ্নবোধক বেশ কিছু ভুল ইংরেজি বলেছেন, যা কানে লেগেছে। বিশেষ চরিত্রে রাহা তানহা খান নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি চলচ্চিত্রে নিয়মিত হতে পারেন। আরেফিন রুমীকে গানের দৃশ্যে ভালো লেগেছে।
‘জান্নাত’-এর সব ক’টি গান এ ছবির সম্পদ। অনেকদিন পর কোনো চলচ্চিত্রের প্রতিটি গান শুনেই মুগ্ধ হয়েছি। আলাদা করে একটি গানকে সেরা বলা যাবে না, তবে প্রতিটি গানই নিজ নিজ যোগ্যতায় সেরা। সুদীপ কুমার দীপের লেখা ইমন সাহার সুর ও সংগীতে বাপ্পা মজুমদার ও কোনালের গাওয়া ‘খুব বলতে ইচ্ছে হয়’ বড় পর্দায় হৃদয় কেড়েছে। গানের শুরুটা অবশ্য হিন্দি ছবি ‘ওয়াজির’-এর ‘তেরে বিন’ গানের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে খানিক বাদেই বুঝেছি ‘খুব বলতে ইচ্ছে হয়’ নকল নয়, মৌলিক গানই। কথা-সুর-গায়কী-চিত্রগ্রহণ সব মিলিয়ে গানটি দীর্ঘদিন মনে থাকবে। বাপ্পা মজুমদারকে সত্তা, গহীন বালুচর এবং এবার ‘জান্নাত’ চলচ্চিত্রে একের পর এক অসাধারণ প্লেব্যক করতে দেখে মনে হয়েছে, চলচ্চিত্রে তাকে নিয়মিত ব্যবহার করা উচিত। একই কথা প্রযোজ্য সোমনূর মনির কোনালের ক্ষেত্রেও। পাখির মত মিষ্টি কণ্ঠ তার। সুদীপ কুমার দীপের লেখা, আরেফিন রুমীর সুরে রুমী ও পড়শীর গাওয়া প্রায় ৬ মিনিট ব্যাপ্তির ‘যদি এক পলকে’ গানটি শুনতে বেশ আরাম লেগেছে। অস্থির সময়ে স্বস্তিদায়ক গান উপহার দেয়ার জন্য গীতিকার, সুরকার, শিল্পীদের অনেক ধন্যবাদ। তবে ‘পড়শী’র নাম ছবির শুরুতে ‘পরশী’ লেখা হয়েছে। এসব বিষয়ে আরেকটু ধ্যান দেয়া প্রয়োজন। একই গীতিকার ও সুরকারের আরেকটি গান ‘মন যদি ভেঙে যায়’ শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম খান আতাউর রহমান সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের ‘জোয়ার ভাটা’ চলচ্চিত্রের গানের নতুন করে সংগীতায়োজন কিনা। কিন্তু নাহ, নতুন একটি গান উপহার দিয়েছেন এ ছবির সংগীতের মানুষরা। রুমী ও পুতুল এ গানটিও খুব যতœ দিয়ে গেয়েছেন। সুদীপ কুমার দীপ নিদারুণ আবেগের সাথে এ চলচ্চিত্রের গানগুলো লিখেছেন। মুগ্ধ হয়েছি। তবে মুগ্ধতা বেড়ে গেছে রুমীর গাওয়া ও সুর করা ‘পাপী টাপী’ গানটি শুনে এবং দেখে। হামদ ‘আল্লাহু আল্লাহু’ গানের নতুন করে সংগীতায়োজন শুনে মনে হয়েছে ভারতের এ আর রহমানের সুর শুনছি। সত্যিই, আরেফিন রুমী দীর্ঘদিন পর বড় পর্দায় ফিরে এসে বিস্মিত করেছেন, মুগ্ধ করেছেন। চলচ্চিত্রে তিনি অনায়াসেই নিয়মিত হতে পারেন। এ ছবির আবহ সংগীতেও ইমন সাহা বরাবরের মত তার নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। তার কাজ প্রশংসার দাবীদার।
কারিগরী দিক নিয়ে আগেও বলেছি। এ ছবির চিত্রধারণ আর দশটা গৎবাধা চলচ্চিত্র থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। ড্রোন শটগুলো বিশেষ ভাবে ভালো লেগেছে। মানিকগঞ্জের সৌন্দর্য, বিশেষ করে গ্রাম বাংলার রূপ দেখতে বেশ লেগেছে। তবে রংয়ের বিন্যাস পুরো ছবিতে আরো ভালো হতে পারতো। চেজিং দৃশ্যে অলিগলিতে ক্যামেরার পদচারণা ভালো লেগেছে। তাছাড়া শেষ পরিণতির দৃশ্যের আয়োজন ও চিত্রগ্রহণ বেশ ভালো ছিল। রূপসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পনা হতাশ করেছে।
তবে সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মিশেলের যোগফল দাঁড়ায়, ‘জান্নাত’ সুস্থ ধারার একটি মৌলিক প্রয়াস। এ ধরনের চলচ্চিত্রকে প্রযোজক থেকে শুরু করে প্রদর্শক, হল মালিক এবং সবশেষে দর্শকদের পৃষ্ঠপোষকতা করা খুব বেশি জরুরী। আমার সামনের সারিতে বসা হিজড়া সম্প্রদায়ের তিনজন দর্শক এ ছবিটি দেখে তাদের মুগ্ধতার কথা পরস্পরের কাছে বলছিলেন। আমার পাশে বসা বোরখা পড়া এক মধ্যবয়স্ক নারীও তার স্বামীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন ছবিটি দেখবার জন্য তাকে নিয়ে আসার জন্য। এ ধরনের দর্শকদের ধরে রাখার জন্যও তো সবার আরেকটু আন্তরিকতার সাথে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রে অর্থ-মেধা-মননের সঠিক সম্মিলন, সঠিক বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।