স্মৃতিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ সমালোচনা
সূর্য দীঘল বাড়ী ১৯৭৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারিখে মুক্তি পায়। ১৯৮০ সালের ১২ জানুয়ারী সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় স্মৃতিময় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম এই চলচ্চিত্রের সমালোচনা লিখেন। অনুপম হায়াৎ রচিত ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ বই থেকে সমালোচনার অংশ বিশেষ বিএমডিবি-র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
সূর্য দীঘল বাড়ী। আবু ইসহাক রচিত ছবি। জনচিত্রায়ন প্রযোজিত ছবি। শাওন-সাগর পরিবেশিত ছবি। সরকারী অনুদান মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি। মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নেয়ামত আলী পরিচালিত ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মনন্তর পার হওয়া তদানীন্তন একটা দেশের একটা গাঁয়ের ছবি। যে ছবিতে সবুজ মাঠ ও কাঁশবন, নারকেল-কলা-তালগাছ, নৌকা ও কচুরীপানা, পুকুর ও জিলাবাঁধা বরশী হাঁস ও মুরগী, ব্যাঙ ও ঝিঝির ডাক, কিত্ কিত্ ও কাবাডি খেলা, ছাগল-গরু ও গোবর চড়কি মেলা ও ভেজা কাঁথা, হোকজোর টান ও রোদে বসে তেল মাখা, চালের চোরা কারবার ও চালের জন্য হাহাকার, হিজল তমালের সারি, ঘুঘু কোকিলের ডাকাডাকি, মসজিদে আজান ও সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত এবং সর্বোপরি মানুষ। গাঁয়ের শক্তিমান ও শক্তিহীন মানুষ! অত্যাচার ও অত্যাচারিত মানুষের হাহাকার! শতাব্দীর লাঞ্ছিত ইতিহাস, বাংলার গ্রামের ইতিকথা নকশী কাঁথার মতোই সূর্য দীঘলের সর্বাঙ্গে জড়ানো। এ ছবি নিকট দূরে অনুষ্ঠিতব্য বার্লিন কিংবা যে কোন প্রতিযোগিতা থেকে পুরস্কার ছিনিয়ে আনলে একটুও অবাক হবো না। কারণ বেদনার্ত মানুষের কথা সততার সঙ্গে বলেও সত্যজিৎ কান চিত্রোৎসব থেকে জয়ের মালা গ্রহণ করেছিলেন।
উপন্যাসের গল্প ও চলচ্চিত্রের গল্প
কাহিনী নেই বলে যারা অনুকরণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হন তাদের কাছে শাকের নেয়ামত জুটি প্রমাণ করলেন, কথাটা অসাড়, অসত্য। ইতিপূর্বে আশরাফ সিদ্দিকীর ‘গলির ধারের ছেলেটি’ আলমগীর কবিরের ‘সীমানা পেরিয়ে’, আবদুস সামাদের ‘সূর্য সংগ্রাম’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সারেং বউ’, কিংবা আমজাদ হোসেনের ‘দ্রৌপদী এখন ট্রেনে’ কি প্রমাণিত হয় নি বাংলাদেশের সাহিত্য সমৃদ্ধ। যে প্রখর পর্যালোচনা ও অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্যের সন্ধান প্রয়োজন বেদনার হলেও সত্যতা পর্যাপ্ত নয়!
আবু ইসহাক তাঁর এই স্মরণীয় উপন্যাসে জয়গুনের চরিত্রকে কেন্দ্র করে এক চরম বুভুক্ষার চিত্র এঁকেছেন। ছিন্নমূল মানুষেরা জীবনের সর্বত্রই বঞ্চিত হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধ বা রাজনৈতিক শ্লোগানের প্রেক্ষিতে যে শহুরে পরিবর্তন তার পশ্চাদপটে গ্রাম বাংলার অনেক অব্যক্ত অশ্রুসজল পরিবারের কথা থাকে – যাদের খবর আমরা রাখি না।
আবু ইসহাক পরম নিষ্ঠার সঙ্গে সেই আহত ও অপমানিত জীবনের কথাই উপন্যাসের প্রতি পংক্তিতে বিধৃত করেছেন। শাকের ও নেয়ামত সেই বিধৃতিকে চলচ্চিত্রের ভাষায় রূপদান করেছেন। তবে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ভাষা ও প্রকাশের প্রকারভেদ হেতু শাকের নেয়ামত স্বাধীনতা দাবী করেছেন। এবং সেই দাবী সর্বাংশে সার্থক। হয়তো কাহিনীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাদপসরণৈর পরিবর্তে অনলগ্রাসী আক্রমনের অসহায় শিকার হয় জয়গুন বিবিরা। উপন্যাসের চিত্রকল্প ও চলচ্চিত্রের রূপকল্প এখানে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং পরিপূরক। প্রিয় বান্ধব। বুক উচু করে তাই সূর্য দীঘল দীর্ঘায়িতই হয়েছে। পাঠক ও দর্শককে একান্ত করতে সমর্থ হয়েছে।
চিত্র গ্রহণের ব্যাকরণ
সূর্য দীঘল বাড়ী‘র সবচাইতে বড় পরিচয় ‘সূর্যালোক’কে সম্বল করে আলোকচিত্র শিল্পী আনোয়ার হোসেনের কথা বলা ক্যামেরার কারুকার্য। এক একটা সিকোয়েন্সের খণ্ড খণ্ড করে শট ডিভিশন করে এক এখণ্ড দৃশ্য কাব্য তিনি গড়ে তুলেছেন। এক অসাধারণ মৌলিক ও ধ্রুপদী ভাবনায় অনিষ্ঠ আনোয়ার দেখিয়েছেন প্রচলিত ও প্রথাগত ডিজলভ ও ফেড-ইন-ফেড-আউটকে অগ্রাহ্য করে গ্রামীণ বাংলার প্রাচীন সুখ-দুঃখের ইতিকথাকে আধুনিক চলচ্চিত্রে পরিণত করা যায়। ছবিতে কাট-টু কাট পদ্ধতির সমাহারই বেশী। এক দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাবার জন্য থমকে দাড়াননি আনোয়ার হোসেন। বরং বিনা দ্বিধায় সাহরস ভরে পদচারনা করেছেন ফ্রেম থেকে অন্য ফ্রেমে।
বহিদৃশ্যে সাধারণত দুষ্প্রাপ্য ট্রলির পরিবর্তে ইদানিং জুম লেন্স ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক সিনেমায় এটা একটা অমোঘ হাতিয়ার। আনোয়ারও তাই ব্যবহার করেছেন প্রায় চল্লিশটি শটে। আনন্দে আমরা একাত্ম হই যখন দেখি বাঁশ বাগানকে প্রেক্ষাপটে রেখে আগমনরতা বেশ ক’জনের মধ্যে জয়গুনকে জুম চার্জ করে পয়েন্টেড করা হয়, হাঁস পাবার আনন্দে নৃত্যরতা ময়মুনার ঘূর্ণায়মান উচ্ছাসকে জুম চার্জ করে ধরে রাখা যায়, বাজারে সামান্য বেহালা বাদককে ভিড়ের মধ্য থেকে আলাদা করা হয় কিংবা কেরামত মাওলার মৃতদেহকে টপ অ্যাঙ্গল থেকে জুম চার্জ করে নির্দিষ্ট শোক বৃত্তে আনা হয়।
আবার জুম-এর ব্যাকরণ বহির্ভূত ব্যবহারও আছে এই ছবিতে। যেমন দুটো দৃষ্টান্ত ব্রীজের উপরে দাঁড়ানো হাসুর পারস্পেক্টিভ জুম চার্জ করে দৃশ্যমণ্ডলকে তার নিকটতর করা হয় এবং এটিএম শামসুজ্জামান এসে জয়গুনদের বাড়ির দিকে তাকালে তার পারস্পেক্টিভ জুম চার্জ করা হয়।
বাঁশ বাগানে জয়গুনের ওপরে জুম চার্জ করে নিকটতর করা হয়েছিল পরিচালকের দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু যেখানে এটিএম বা হাসু দণ্ডায়মান সেখানে জুম চার্জ কেন? মানুষ স্থির থাকলে তার দৃষ্টি পড়বে। ফিক্সড ফ্রেমে শট আসবে। জুম চার্জ করে ধীরে ধীরে কাছে টেনে আনায় তাৎক্ষনিক ভালো লাগা থাকতে পারে কিন্তু এর কোন অভিজাত মূল্যবোধ নেই।
ইতস্ততঃ আরও জুমের ব্যবহার আছে। তবে তা না দোষের, না গুণের। বর্ণনাধর্মী মাত্র।
ছবিতে প্যান করার দুটো দীর্ঘ দৃশ্য আছে। একটা হাফ সার্কেল প্যানিং-এ এটিএম যখন দাওয়ায় বসে আর একটা ফুল সার্কেলে প্যানিং কাঠের গোলায়। দুটোরই ব্যবহার মনোহর। আর একটা প্যানিরিভার্স প্যানিং আছে ট্রেনে পাকিস্তান নিয়ে আলোচনার সময়। এটাও গতিসৃষ্টি করেছে। টু আউস ক্যামেরা ও এ-ওয়ে ফ্রেম দি ক্যামেরা একবারই ব্যবহৃত হয়েছে।
দৃশ্য বিভাজনে পরিচালক সতর্ক হিসেবী। তাই এটিএম ও কেরামত মাওলার দৃশ্যটাকে (১) ক্লোজ আপ (২) সামান্য জুমব্যাক করে টাইট মিড ক্লোজ ফ্রেম ও (৩) মিড লং থেকে জুম চার্জ করে মিড ক্লোজে ক্যামেরার স্থিতি – এই তিনটা শটে বিভক্ত দৃশ্যটা বড় সুষমামণ্ডিত। তবে সব চাইতে কৃতিত্ব আগুন লাগার দৃশ্যটায়। লং শট জুম, প্যানিং ক্লোজ বিগ ক্লোজআপ, মিড লং টিল্ট আপ টিল্ট ডাউন ইত্যাদি নানাবিধ শটে এক অসাধারণ গতি ও গীতিময় আকস্মিকতায় ভূষিত করেছেন ঐ দৃশ্যকে আনোয়ার। এই দৃশ্য বাংলাভাষায় নির্মিত ছায়াছবির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আলোক সম্পাত আনোয়ারের সব চাইতে বড় বৈশিষ্ট্য; বহির্দৃশ্যে এমনি করে সূর্যালোক ভিত্তিক ছবি এই উপমহাদেশে অনেকদিন দেখা যায় নি। অপূর্ব। অসাধারণ। তবে জয়গুন মায়মুনাকে যখন মারে, তালাকের দৃশ্যে একক নিঃসঙ্গ হাসু মাঠের মধ্যে জয়গুন ও জহিরুল হকের দৃশ্যে আলো, আধিক্য-দোষে দুষ্ট। তাছাড়াও কুপীর আলোর শিখা কাঁপে অথচ ছায় নিষ্কম্প, স্থির।
ক্যামেরার প্রত্যেকটা ফ্রেম, তার সাবজেক্ট-অবজেক্ট, অ্যাঙ্গেল ও মুভমেন্ট অন্যান্য সাধারণ হলেও একটা কথা – নিরুদৃষ্ট সৌন্দর্য সন্ধানই আনোয়ার সারা ছবিতে করেছেন কিন্তু তিনি যেন বড় বেশী নির্বাচিত ফ্রেম নিয়ে কাজ করেছেন।
সম্পাদকের টেবিলে
গতিশীল করার জন্য সম্পাদকের প্রয়াস প্রশংসনীয়। কোথাও জাম্প কাট মনে হয়নি। তবে জাহাজ ঘাটের দৃশ্যটা, ট্রেনের লাইনের পাশে হাসুর ছুটে চলার পূর্বে অনেকক্ষণ, ট্রেনের চাকার থমকে থাকা ও লাইনে হাসু ও জনৈকের চলে আসর দৃশ্যাবলী আরও কাটিং-এ যেতে পারতো।
শব্দ গ্রহণ
অন্য দশটা ছবির চাইতে এ ছবির শব্দ গ্রাহক অনেক বেশী খেটেছেন। বড় বেশী হিমসিম খেয়েছেন। কারণ চলিত ও বহিল ব্যবহৃত সঙ্গীতের পরিবর্তে এ ছবিতে শব্দ ও ধ্বনি ব্যবহৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে। ঢেকির শব্দ, ঘুঘু-কোকিল-হাঁস-চোখগেল পাখীর ডাক অথবা নিষ্পন্দ দৃশ্যে একটা কাকের আওয়াজে ভয়ঙ্কর মুহূর্তেরসৃষ্টি করেছেন শব্দ গ্রাহক। পাশাপাশি শিল্পীদের ডাবিং এর ত্রুটি বড় প্রকট। বিশেষ করে পথের মোড়ে বসে থাকা বুড়িও ট্রেনের হকারের ডাবিকং একদম হয় নি। ব্যাঙের ডাক বড় বেশী উচ্চকিত। বৃষ্টি শব্দেরও অনুসঙ্গ তৈরী হয় নি। এছাড়াও রেল লাইন দিয়ে দূর থেকে হেটে ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসা হাসু ও জনৈক শিল্পীর কন্ঠস্বর একই স্থান থেকে প্রক্ষিপ্ত হবার ফলে দূর থেকে কাছে আনার এফেক্ট তৈরী হয়নি।
শিল্প নির্দেশকের চেতনা
ডিটেলের প্রতি সূক্ষ্মচেতনাই এ ছবির অকল্পনীয় গৌরব।
সঙ্গীতের সংযোজন
আলাউদ্দিন আলী এ ছবিতে চিরাচরিত কোন পুর্ণাঙ্গ গান ব্যবহার করেননি। বরং কিছু গানের টুকরো অংশ দিয়েই পুরো ধারা বর্ণনায় সহযোগী হতে চেয়েছেন। এবং তিনি তা পেরেছেনও। কোন দর্শকের আর্দ্র মন দাবী করেনি যে একটা গান থাকলে ভালো হত।
সঙ্গীত ও আবহ যে মূল ছবির বার্তাবরণ বা বিশেষ্যের বিশেষণ – এ তো প্রায় আমরা ভুলেই থাকি। কারণ ছবির শ্যুটিং এর আগেই ঠিক হয় ক’টা গান থাকবে। আলাউদ্দিন আলী সুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
যন্ত্র সঙ্গীতে যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে তাতে কোন বিদেশী যন্ত্র নেই। একেবারে পরিবেশনানুগ সব যন্ত্রের ব্যবহার। জ্বিনের ভয় দেখানোর সময় যেমন অর্কেষ্ট্রা স্টাইলে সঙ্গীতের ব্যাঞ্জনা আবার বড় ভাইকে দেখে হাসুর একক দৌড়ে একক দোতরার সহযোগী হওয়া তেমনি শ্রুতিমধুর।
তবে ক্ষোভ থাকবে; কারণ জয়গুন যখন শোনে ময়নাকে তাড়িয়ে দিয়েছে তখন যন্ত্র-সঙ্গীতের নির্বাকত্ব বিরক্তিকর। ভালো লাগে না একেবারে শেষ দৃশ্যে বেহাগী সুরে কন্ঠ দিয়েই পরক্ষণে যন্ত্রসঙ্গীতের আশ্রয় নিয়ে সুর ও দৃশ্যের করুণ গীতি ধর্মিতায় ব্যাতয় ঘটানো।
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যায় যখন আগুনে পুড়ে সব স্বপ্ন ধ্বংস হবার মুহুর্তে ধ্বনি ও সঙ্গীতের অপূর্ব সংমিশ্রনের চূড়ান্ত মুহুর্তে সমস্ত সঙ্গীত ধ্বনি থেমে যায়। মানুষের ক্রন্দন ও আর্তনাদের শেষ কথা বোবা মুক হয়ে যাওয়া। আলাউদ্দিন অসামান্য দক্ষতায় তাই দেখিয়েছেন।
চরিত্র চিত্রণ
সূর্য দীঘলের নানা চরিত্রে স্টার, সুপারস্টার বক্স অফিসের কেউ নেই। যেমনটি হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’র সময়। অথচ নানা চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান, নরেশ ভূইয়া, কেরামত মাওলা, রওশন জামিল, ফখরুল হাসান বৈরাগী, জহিরুল হক, আরিফুল হক, নাজমুল হুদা, হাসান ইমাম এবং জয়গুন চরিত্রে ডলি আনোয়ার। কেউ এই ছবিতে অভিনয় করেননি। প্রত্যেকে এক একটা চরিত্র। অবাক। জীবন্ত। নানা ভাব, রসের প্রতীক। তবু এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন ডলি আনোয়ার। এই বয়সে ঐ রকম রূপসজ্জায় গ্লামারহীন অবস্থায় তাঁর এই চরিত্র চিত্রণ বাংলা ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের এক অতুলনীয় সম্পদ বলে গন্য হবে।
এবং পরিচালনা
মসিহউদ্দিন শাকের আর শেখ নেয়ামত আলীর কথা ভাবলেই সত্যজিৎ রায়ের কথা এসে যায়। সত্যজিৎ বলেছেন – যারা ফাটাবার তারা প্রথমেই ফাটায়।
শাকের ও নেয়ামত জুটি সে কথারই মূর্ত রূপ। সূর্য দীঘলের মত একটা কাহিনী নির্বাচন, চরিত্র বুঝে শিল্পী নির্বাচন, হাটি হাটি পা পা করে শ্যুটিং স্পট বাছাই, ডিটেলের প্রতি কঠোর মনোযোগী কনটেন্ট ও ফর্মের সাযুজ্য ঘটানো এবং দ্বৈত সত্তার সার্বিক পরিস্ফুটনে সূর্যদীঘল বাড়ি তারা সৃষ্টি করেছেন। ছবি করা, ছবি বানানো নয়, এবার আরও একধাপ কমিয়ে ছবি এঁকেছেন তাঁরা গ্রামবাংলার সবুজ প্রকৃতির সং ও লাঞ্ছিত মানবাত্মার বুকের রক্ত দিয়ে। তাই ছবির শেষ মুহুর্তে নীরব দর্শকের দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘজীবী হয় শাকের নেয়ামত জুটির আগামী ভবিষ্যত।
ছবির শুরুতে ডকুমেন্টারি ফর্মে বিমান-বোমা-বিস্ফোরণ দিয়ে সময় নির্ধারণ করে শাকের নেয়ামত শিল্পাচার্য্যের অসামান্য স্কেচ চিত্রে নিজেদের পায়ের তলার মাটি খুঁজে নিয়েছেন। এরপরই তারা স্বতঃস্ফূর্ত।
পরিচালকের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য বা সময়ের ঘটনা তাকে সঠিক ভাবে উপস্থিত করা। ১৯৪৪-‘৪৮-‘৪৯ সালের কোন ফুটেজেই ‘৭৯ সালের ছাপ পড়েনি। কোনভাবে কোন ক্রমেই নয়। আধুনিক রেলগাড়িকে এড়িয়ে ইঞ্জিন, ইঞ্জিনের চাকা, হুহুসেলের দড়ি থেকে বুদ্ধিদীপ্ত শাকের নেয়ামত পুরোন ট্রাকও জোগাড় করেছেন। যেখানেই ব্যাকগ্রাউন্ডে সমকাল এসে যেতে পারে সেখানেই তড়িৎ গতিতে তারা ক্যামেরাকে কাট করিয়েছেন। কি পোষাক কি ব্যাকগ্রাউন্ড, কি ডিটেলে সর্বত্রই তাঁরা দর্শকের সমীহ আদায় করেছেন।
রূপক ও প্রতিকধর্মী ব্যাঞ্জনাও ছবির পরতে পরতে। রওশন জামিলের ছোট বেলাকার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় মরা পাখীর কোকানিতে মায়মুনার বিয়ের কথা শোনার মুহুর্তে বাপ কেরামতের কোলে মরা বাছুর। বিরাট নিসর্গকে পশ্চাদপট করে হাসুকে একা নৌকায় বসিয়ে রাখা, তেল মালিস করে জহিরুল হকের মানসিকতা বর্ণনা, হাসুকে ট্রেনের পাদানীতে দাঁড় করিয়ে হাত দুলিয়ে যন্ত্রের সঙ্গে জীবনের গতিময়তার সাদৃশ্য সৃষ্টি, ভাইয়ের হাতে চড়কি দিয়ে ঘূর্ণায়মান জীবনের প্রতীক অর্পণ, সৎমায়ের চিরুনী তুলে দিয়ে ছোট্ট হাসুর প্রতি স্নেহ জমিয়ে তোলা ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাকার বহু সুন্দরের নন্দনতাত্ত্বিক সমাহারে সূর্য দীঘল বাড়ীকে সাজিয়েছেন শাকের নেয়ামত।
চিত্রনাট্যে স্বাভাবিকভাবে ইথাল-পাতাল প্রেম নেই। গান নেই। মেলোড্রামা নেই। বাজার মাত করা সংলাপও নেই। বরং ঢলাঢলি শারীরিক প্রেমের পরিবর্তে আছে অব্যক্ত ও বেদনার্ত মাতৃস্নেহ, আছে দুঃখী দরদী মানুষের ঐকান্তিক ভাবে বাঁচার আকুতি। এসব গভীর ব্যাঞ্জনার মধ্যেও শাকের নেয়ামতের অনুচ্চারিত রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় শুকনো গাছে পতাকা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে।
এতো ভালো লাগার কথা। কিন্তু মন্দ লাগার কি কিছু আছে?
আছে, নিশ্চয়ই আছে। শাকের নেয়ামত জুটির অস্বাভাবিক সচেতনতাই স্বাভাবিক অচেতনতার প্রতীক। বড় চিন্তিত। ভাবিত। এবং এটা একটা সংক্রামক ব্যাধি। এটা পরিত্যাজ্য।
প্রথমেশ বড়ুয়ার ‘মায়ের প্রাণ’ ছবির একটা পোস্টার লাগালেও ‘ভারত ছাড়’ দেয়াল লিখনই কি যথেষ্ট সময় নিরুপনের পক্ষে? যে শহরে কাশু ঘুরছিল তার নাম নারায়ণগঞ্জ। যদি স্থান-কাল-নিষ্ঠ থাকার কথা ওঠে তাহলে বলতে হয় ঐ ছবি কদাপি নারায়ণগঞ্জে মুকইত পায়নি। ভারত ছার দেয়াল লিখনও ঐভাবে লেখা হতো কি?
মায়মুনাকে খেদাইয়া দিছে – একথা শুনেও গর্ভধারিনী জয়গুনের কোন রিঅ্যাকশন নেই কেন> কেন নেই কেরামতের মৃত্যুর পর জয়গুনের কোন প্রতিক্রিয়া যদিও প্রাক্তন স্বামী। তবু চোখের সামনে নিহত মানুষটার জন্যে কি কিছুই করণীয় ছিলনা?
সারা ছবিতে ধূমপানের বড় আধিক্য। চাল বেচা বুড়ি থেকে জহিরুল হক পর্যন্ত ধূমপায়ীদের বড় ছড়াছড়ি। চোখে লাগে।
ট্রেনের শব্দ শুনে ছুটে যাওয়া ও বুড়ির সামনে মরা পাখী দোলানো – সত্যজিৎকে তাৎক্ষনিক মনে করিয়ে দেয়। এটাকে এড়ানো যেত না?
ছবিতে প্রকৃতি ও নিঃসর্গ বড় প্রধান। অনেক সময় মানুষ ম্লান হয়ে গেছে পটভূমির বিন্যাস ও সুসৌন্দর্য্যের কাছে।
এটিএম পান চাইবামাত্র জয়গুনের হাতের কাছে পানের বাটা একেবারে সাজানো মনে হয়। এ ছবিতে প্রকৃতির অন্যতম নিদর্শন বৃষ্টচি নিরুদ্দিষ্ট। যদিও রাতের ঘটনায় বৃষ্টি আছে তবে তা ধ্বনির প্রয়োগে। চোখের দেখা বিরাট ক্যানভাসে বৃষ্টির রূপায়নে শাকের নিয়ামত ব্যার্থ।
শেষ কথা
পঞ্চাশ বছর পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ রায় আবির্ভূত হয়েছেন। আনন্দ ও গৌরবের কথা স্বাধীনতার মাত্র ন’বছরের মাথায়ই শাকের নেয়ামতরা দেখা দিলেন।
আমরা দর্শক। আমাদের আশা রইলো দুঃখ বেদনা, অশ্রু-আনন্দ ও গৌরবগর্ব দিয়ে আমাদের জীবনের যে পথের পাঁচালী রচিত হয়েছে সেই পথেরই প্রান্তে সুবর্ণ স্মৃতিতে মোড়া সূর্য দীঘল বাড়ী দাড়িয়ে থাকবে – আগত কালের দর্শকের জন্য।
সারা ছবিতে রিলিফ নেই। কাশুর লুঙ্গি আটকে যাওয়া, কেরামতের লুঙ্গি ঝাড়া দেয়া ও বুড়ির নৌকায় বসে ঘন ঘন হাসিই কি দুঃখী মানুষের জীবন রসের ছিটেফোটা পরিচয়? নারায়ণগঞ্জ থেকে হেটে কাশু আসে। নিশ্চয়ই কাশু চাষারা নারায়ণগঞ্জ থেকে সাড়ে তিন মাই হেটেই যদি আসতে পারে, তবে পরিচিত গ্রামের পথে দেড় মাই দূরবর্তী জালুকাড়িতে গেল না কেন? সেই কালে স্টেশনের টিমটিমে কেরোসিনের আলোতে রেল লাইনের অতদূর আলোকিত হতো নাকি? তাছাড়া ফতুল্লা স্টেশনে ঐ সময় কেন এখনো অত বড় কোন প্লাটফর্ম নেই।
আগুন লাগার আর্তচিৎকারে গ্রামবাসীদের কেউ জয়গুনদের বাড়ি এলোনা কেন? গরীব মানুষের পারস্পরিক সহানুভূতি ও সম্পর্ক কি অস্বীকৃত? তাছাড়া কথাবলা চরিত্র ব্যতীত জালুকড়িতে আর লোকজন নেই? …