‘হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে’ অশ্লীল গান নয়
‘হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে’ এই গান কেন অশ্লীল ইঙ্গিতের গান নয়, কেন এই গান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে—
বাংলা ভাষায় প্রাচীন কাল থেকেই দেবর-ভাবীর মিষ্টি সম্পর্ক নিয়ে অনেক গানই তৈরি হয়েছে। শুরু করা যাক ‘ছাতা ধরো হে দেওরা’ গান দিয়ে। এই গানটি দেবর আর ভাবীর মধুর সম্পর্ক নিয়ে লেখা রাঢ় অঞ্চলের একটি আঞ্চলিক ভাষার গান।
রাঢ় হল ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের একটি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অঞ্চল। এটি পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমি ও পূর্বে গাঙ্গেয় বদ্বীপ পর্যন্ত প্রসারিত। রাঢ় অঞ্চলের সীমানা সম্পর্কে প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে নানা পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া গেলেও, বোঝা যায় যে মূলত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এই অঞ্চলের অবস্থিত ছিল। অঞ্চলের কয়েকটি অংশ বর্তমানে আধুনিক ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত।
সেই অঞ্চলের সাঁওতালদের নিজেদের সংস্কৃতির অংশ যেসব গান, তারমধ্যে ‘ছাতা ধরো হে দেওরা’ অন্যতম। গানের ব্যাখ্যায় জানা যায়, ভাবী চমৎকার করে সেজেগুজে বাইরে বের হয়েছে, সাথে রয়েছে তার দেবর। ঠিক এরকম সময়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভাবীর নতুন শাড়ী সাজানো খোঁপা যেন বৃষ্টির পানিতে নষ্ট না হয়ে যায়, তাই দেবরকে অনুরোধ করছে তার মাথায় ছাতা ধরতে।
দেবর-ভাবী নিয়ে আমাদের দেশের আরেক বিখ্যাত গান ‘বাড়ির পাশে বেতের আড়া, হাল জুইড়াছে ছোট দেওরা রে’। এই গান বরেন্দ্র অঞ্চলের গান। ঐতিহাসিকগণের মতে রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ, দার্জিলিং ও কোচবিহারসহ গঠিত অঞ্চলকে বরেন্দ্র অঞ্চল বলা হয়।
ধারণা করা হয়, এই অঞ্চলের গাড়োয়ানেরা গরুর গাড়ি বাইতে বাইতে গাইতো বারোশিয়া গান, কিংবা মাঠে কাজ করতে গিয়ে ধুমুক (অবসর) সারার সময় গানগুলি গাইত। তারা গানগুলি মুখে মুখে রচনা করে গাইত। এই গানের কোনো রচয়িতা নেই। ধীরে ধীরে এই গান একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত বারমাসি থেকেই বারসিয়া (বারমাসি > বারমাসিয়া > বারসিয়া) শব্দের উৎপত্তি। শব্দে ধ্বনি আগম ও ধ্বনি লোপের বিবর্তনের ফলে বারমাসি থেকে বারসিয়া উৎপত্তি হয়েছে। আবার বারসিয়া, বারাশে, বারইস্যা, বারোষা, বারাষী ইত্যদি নাম ধারণ করেছে অঞ্চলভিত্তিক। এদেরই গান ‘বাড়ির পাশে বেতের আড়া, হাল জুইড়াছে ছোট্ট দেওরা রে’ কিংবা ‘ও দ্যাওরারে, পিরিতী করিতে চাও, ছাড়ো দ্যাওরা ওরে বাপ মাও’ এবং আরও অনেক গান।
কোক স্টুডিওর গান ‘দেওরা’ জনপ্রিয় হয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছে, নাগরিক মানুষের কাছে। এটি একটি সারি গান। সারিগান এক প্রকার লোক সঙ্গীত যা শ্রম সঙ্গীত বা কর্ম সঙ্গীত নামেও পরিচিত। নৌকার মাঝি মাল্লাদের গান হিসেবেই এর প্রধান পরিচয়। মাঝিরা সারিবদ্ধভাবে বসে বৈঠা টানার তালে তালে এ গান গায় বলেই এর নাম হয়েছে সারি গান।
কোক স্টুডিওর ‘দেওরা’ গানের মূল স্রষ্টা সিরাজগঞ্জের ফজলু মাঝি (ফজুলুল হক), গানের সুরও বেঁধেছেন তিনি। গানটির সাথে যুক্ত হয়ে তুমুল জনপ্রিয় এখন কিশোরগঞ্জের পালাকার ইসলাম উদ্দীন। জানা যায়, ফজলু মাঝি পেশাদারভাবে নৌকা বাইচ করেন। তার রয়েছে একটি নৌকাবাইচের দল। বাইচের সময় দলের সদস্যদের নিয়ে দলগতভাবে ‘দেওরা’ গানটি পরিবেশন করেন তিনি। হালের মিউজিক সেনসেশন প্রীতম হাসানের এক অনবদ্য সৃষ্টি হয়ে থাকলো এই অসামান্য সমন্বয়।
যেকোনো গান সফল হলে কেউ কেউ তার পেছনে লেগে যায়, লেগে যাবার আগে বোঝা উচিত, হারিয়ে যাওয়া বা প্রায় বিলুপ্ত অনেক গানই আজকের অনেক আধুনিক সঙ্গীত আয়োজকদের উদ্যোগে নতুন করে জনপ্রিয় হতে পারে, আর এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক।
সুন্দরকে থামিয়ে না দিয়ে আসুন সুন্দরের পক্ষে থাকি। ধন্যবাদ।
(তথ্য সংগ্রহ করে লেখা, কোনও মনগড়া লেখা না)
২৯ মে, ২০২৩
নিকেতন, ঢাকা।