Select Page

আত্মপরিচয়ের ‘আজব কারখানা’

আত্মপরিচয়ের ‘আজব কারখানা’

দুই ধরনের ছবি হয়। এক ধরনের ছবিতে নাচে-গানে ভরপুর বাণিজ্যিক উপাদান থাকে যার শেষকথাই বিনোদন আর এক ধরনের ছবি আছে যেটাতে ভালো একটা গল্প থাকে, ভালো বার্তা থাকে যে বার্তা চিন্তার উদ্রেক করে। ‘আজব কারখানা’ ভালো গল্পের চিন্তা জাগানো একটি ছবি যার মধ্যে ব্যক্তিগত যাত্রার মাধ্যমে আত্মপরিচয়ের একটি সন্ধান মিলবে।

ছবির নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী এবং প্রযোজক সামিয়া জামান। সামিয়া জামান এর আগে পরিচালক হিসেবে ‘রাণী কুঠির বাকি ইতিহাস, আকাশ কত দূরে’ ছবিগুলো করেছেন। ছবির ট্যাগলাইন দেয়া হয়েছে ‘song of soul’ যা ছবির গল্পের সাথে রিলেটঅ্যাবল।

গল্পটা সহজ। একদম সুপারস্টার শিল্পীকে দিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা লোকশিল্পীদের গান ও জীবনযাপনকে তুলে ধরা। লোকগানের সাথে যেহেতু রিলেটেড গল্পটি তাই তাই লালন শাহ-র গান থেকে ‘আজব কারখানা’ নামটি বাছাই করা হয়েছে এবং নামকরণ অবশ্যই প্রশংসনীয়।

গল্প অনুযায়ী লোকগানের ভিত্তিতে পালাগান, জারিগান, দেহতত্ত্ব, ঘাটুগান, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি ইত্যাদি গান উঠে এসেছে। গানগুলোর শিল্পীর ব্যক্তিজীবন, পরিবেশনা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম উঠে এসেছে।

ছবির প্রধান চরিত্র পরমব্রতের শক্তিশালী চরিত্রটি এ ছবির গল্পকে ভালোভাবেই তুলে ধরেছে। তার সহজাত সাবলীল অভিনয়শক্তি সুপারস্টার শিল্পীর চরিত্রটিকে বাস্তবিক চরিত্রে পরিণত করেছে। তার জার্নিটা যতটা শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। রক থেকে তার জার্নিটা পরিবেশগত প্রভাবে অন্য একটা ধরনে পরিবর্তিত হচ্ছে। গীটারে সুর তুলছে কিন্তু তা গীটারের সুর থাকছে না হয়ে যাচ্ছে একতারার সুর। সুরের সাথে মনোজাগতিক একটা জার্নিটা তার চরিত্রটিকে শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তার চরিত্রের শেষটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র হিসেবে দিলরুবা দোয়েল ন্যাচারাল ছিল। মানসম্মত ছবি নির্বাচনে তার সচেতনতা চলমান আছে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই তার চরিত্রে, একেবারে সাবলীলভাবে অভিনয় করে গেছে। মডার্ন চরিত্র হিসেবে ইমি মানানসই। মায়মুনা ইসলাম মম বরাবরই ভালো অভিনেত্রী, ছোট্ট চরিত্রে নিজের ভালো অভিনয়ই দেখিয়েছে। তার আরো কাজ করা উচিত। বাকি চরিত্রগুলো গল্পের সাথে চলমান বিশেষত লোকশিল্পীদের চরিত্রগুলো ছবির গল্পে প্রয়োজনমতো এসেছে এবং তাদেরকে দিয়েও ন্যাচারাল অভিনয় করানো হয়েছে।

লোকসঙ্গীতের পাশাপাশি কবিতার স্পর্শও ছবিটিকে সাহিত্যের উপাদানে যোগ করেছে। তাও
জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত ‘ক্যাম্পে’ কবিতার ব্যবহার পল্লীবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ব্যবহৃত হয়েছে। পরমব্রতের ন্যাচারাল ভয়েসের আবৃত্তিতে কবিতাটির এ লাইনগুলো কানে শান্তি দেয় –
‘হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার
বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসে’
হেলাল হাফিজের কালজয়ী কবিতা ‘ফেরীঅলা’ থেকে নির্মিত গানটি ছিল অসাধারণ।

নেত্রকোণা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়ার লোকেশনে বাংলাদেশের পল্লী সৌন্দর্য ছবির কনটেন্টের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নির্মাতার ক্যামেরায় বাংলাদেশের সৌন্দর্য কথা বলেছে। ছবির সেরা দৃশ্য ছিল সবুজ ধানক্ষেতে শিল্পী পরমব্রতর বুকভরা গভীর নিঃশ্বাসে হারিয়ে নিজেকে খোঁজা। পরিচালক শবনম ফেরদৌসীর কাজ দেখে দক্ষ ও সম্ভাবনাময়ী একজন নির্মাতাই মনে হয়েছে।

বিশ্বের ১৫টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি অংশ নিয়েছিল এবং ৫টি পুরস্কারও জিতেছে। ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হয়েছে এটা ভালো দিক।

সব মিলিয়ে ‘আজব কারখানা’ একটি সুনির্মিত চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে।

রেটিং – ৮.৫/১০


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply