Select Page

আমাদের চলচ্চিত্র: তুলনার প্রেক্ষিত

আমাদের চলচ্চিত্র: তুলনার প্রেক্ষিত

comparison

ব্যাপারটা দু:খজনকই। যে জাতির চলচ্চিত্রই হোক, তা যদি জাতে না উঠতে পারে, অবলীলায় তাকে ‘বাংলা সিনেমা’ বলে ‘গালি’ দেই। দুর্বল কাহিনী বা নির্মাণের কোন চলচ্চিত্রের একটা পরিভাষা-ই যেন হয়ে গেছে ‘বাংলা সিনেমা’। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন আবাসিক হলের টিভিরুমে এরকম বিদঘুটে একটা ব্যাপার ঘটে। চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে যদি কখনো বাংলা চলচ্চিত্রের কোন দৃশ্য এসে যায়, টিভিরুমজুড়ে সে কী হৈ চৈ, হাসাহাসি! বানর নাচছে যেন ! অবিলম্বে চ্যানেলটা বদলেও যায়। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় আমাদের, যাদের বিশ্বাস মন্দ-ভালো যাই হোক, আমার সন্তান আমার-ই!

আবার, এমন অনেককেই চিনি, যারা হলিউডি সিনেমার সাথে বাংলা চলচ্চিত্রের তুলনা করে এর দৈন্য দেখাতে চান (আমার এক বন্ধু যেমন কিংকং আর খেলাঘর এর মধ্যে তুলনা এঁকেছিলেন)। ব্যাপরটা সত্যি। কিন্তু এটাও তো ঠিক, হাতি আর ছাগল দুই-ই প্রাণি, তবু তাদের মধ্যে শক্তিমত্তা আর শৌর্যের তুলনা করাটা বোকামি! বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে হলিউডি (বা এমনকি বলিউডি) সিনেমার তুলনাও তেমনই। আমার বিশ্বাস- আরেকটু বড় হলে, আরেকটু বুঝতে শিখলে এরকম চাষাড়ে তুলনা আর করবো না। এ বিশ্বাসের ভিত্তি কিছু চিন্তার ইটে গাঁথা, সেগুলোর নমুনা দিয়ে যাই।

প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৮৯৫ সালে, আমাদের প্রথম ১৯৫৬-তে। তখনই পিছিয়ে ছিলাম ৬ দশক। প্রযুক্তিসহ নানামুখী অগ্রগামিতার কারণে পশ্চিমারা এগিয়ে গেছে আরো। আরো পিছিয়েছি আমরা। যতবার আপনার ঘরের দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার এসেছে, ততবারই আমরা এক এক দশক পিছিয়ে গেছি; জ্যামিতিক হারে। কতটা? দেখুন। মোস্ট ওয়েলকাম সিনেমার প্রিভিউ লিখতে গিয়ে আমাদের প্রথম সারির এক পত্রিকার লেখক লিখেছিলেন, ঢাকায় সিনেমায় আমরা যেখানে বিমানের উঠানামা দেখেই অভ্যস্থ, সেখানে বিমানের অন্দরমহলের দৃশ্যায়ন দেখাও তো একটা ব্যাপার! এবার হলিউডের দিকে তাকান। বিমান নিয়্ েডজন ডজন তো সিনেমা হয়েছেই, একটা বিমানের আরেকটা বিমান ভেঙে তার যাত্রী ছিনতাই করার দৃশ্যও আমরা দেখলাম সম্প্রতি (ডার্ক নাইট রাইজেস)। হলিউড পৃথিবীকে ধ্বংশের কিনার থেকে রক্ষা করে (আরমাগেডান ও আরো অনেক), এখন অন্য গ্রহ রক্ষার মিশনে উঠেছে (এ্যভাটার, জন কার্টার), আর আমরা নায়কের ওড়ার দৃশ্যে দড়িটাও লুকাতে পারিনা! প্রযুক্তির সোনার কাঠি আমাদের ঘুম পুরো ভাঙতে পারেনি এখনো।

চলচ্চিত্রের জীবনের ভাগ মোটামুটি দুইটা। নির্মাণ এবং বাজার। প্রথমটা নিয়ে কোন তর্ক নেই- ভালো গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ ইত্যাদি যেকোন জায়গাতেই আসতে পারে; প্রযুক্তির কথা তো বললামই। কিন্তু বাজার? যার উপর নির্ভর করে চলচ্চিত্রের নির্মাণ?

যেমন, আপনি একটা সিনেমা বানাবেন। শুরুতেই কি আপনি ভাববেন না এটা কোথায় প্রদর্শিত হবে? কতজন দেখবে? কারা দেখবে? তাদের শিক্ষা-রুচি-সংস্কৃতি কেমন? গরম কালের ওয়াজ শীতকালে দিলে আপনাকে কেউ কাঁথা দেবেনা। বাংলাদেশে যদি আমি ঢাউস সাইজের রুম হিটার বাজারজাত করি, কেমন চলবে আমার ব্যবসা?

আমরা এখন হলিউডি সিনেমা দেখি হলে গিয়ে। আর আমাদের সিনেমার ক্ষেত্রে অপেক্ষা করি পাইরেটেড সিডির জন্য। তাহলে? আমার সিডি কেনার টাকাটা যাচ্ছে ‘পাইরেসি-শিল্পীর’ কাছে; আর টিকিট কেনার টাকাটা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে হলিউডি সেই প্রজোজক পাচ্ছেন। তাদের চলচ্চিত্রের বাজার এত বড় জেনেই প্রজোজকেরা শত শত কোটি টাকা (আসলে ডলার) লগ্নি করেন, আর কোটিতে উঠতে গেলেই আমাদের কটি (কোমর) কেঁপে যায়! তারউপর আপনি-আমি হলে গিয়ে দেখিনা, পাইরেসি হয়। চিনি কম দিয়ে মিষ্টি বেশি চাইলে কি পাবো?

এসব কারণে নিশ্চয়ই আপনি ইনসেপশন/ম্যাট্রিক্স/দ্যা রিডার/পিয়ানিস্ট এখানে বানাবেন না। একারণেই মেমেনটো বানাতে চাইলে আগে তাকে গজিনির ছাঁচে ঢালবেন, তারপর ঢাকায় ছবির চুলাই জ্বালিয়ে পরিবেশন করবেন। একারণেই ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার ‘দ্যা গডফাদার’ ভারতে এসে প্রকাশ ঝার ‘রাজনীতি’ হয়, আর আমরা শুধু নামটা নিই আর কিছুনা (আজম খান ও রুবেল অভিনীত ‘গডফাদার’)।

আমাদের আরেক সমস্যা, আমার মনে হয়, অল্প বিদা। ভয়ংকর এই শিক্ষা নিয়ে আমরা নলিনী কেষ্ট কে ক্রিস্টোফার নোলান বা পচু আলী কে আল পাচিনোর সাথে তুলনা করি; আর আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখে বাংলা সিনেমা না দেখার সিদ্ধান্ত নিই। আর ঠাকুর ঘর থেকে আহ্লাদে আটখানা বা লজ্জায় আধখানা হয়ে ঘোড়ার স্বরে ঘোষণা করি ‘আমি বাংলা সিনেমা দেখি না’। চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি আমাদের এই নাক উঁচু ভাব আর অসামান্য অবহেলাও এর ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণ। পাশেই প্রতাপশালী হলিউডের ছায়া ফেললে কেমন দেখাবে? সাথে সিনেমা হলের করুণ দশার কথাও যোগ করুন।

আমাদেরই দোষে এ পতিতাবস্থা। উত্তরণের চেষ্টাও করতে হবে আমাদেরকেই।

আমার কোন আপনজন অমেধাবি/কম মেধাবি/প্রতিবন্ধী হলে আমি কি আমার সবকিছু দিয়ে হলেও তাকে যোগ্য করে তুলবো না?


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আশানুজ্জামান

হতে চেয়েছিল লেখক, কপাল দোষে এখন 'পতিত-ব্যাংকার'।

৮ টি মন্তব্য

  1. দারাশিকো

    খুবই চমৎকার একটি লেখা – তৃপ্তি নিয়ে পড়লাম। দারুন সব পয়েন্ট তুলেছেন – দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু কথা হল, আপনার লেখা আগে কেন পড়ার সুযোগ পেলাম না? এখন থেকে নিয়মিত পাবো তো? অমেধাবি/কম মেধাবি/প্রতিবন্ধী শিল্পটাকে দাড়া করানোর জন্য কিন্তু ভালো লেখকেরও প্রয়োজন 🙂

  2. সুন্দর লেখা।যুক্তিগুলো ভাল লেগেছে! উপস্থাপনাও সুন্দর।

    গডফাদার নাম নিয়েছে এক মুভিতে।কাহিনি নিয়ে মুভি করেছে আরেকটা।হিরা আমার নাম(শরিফুদ্দিন খান দিপু পরিচালক)

    রেগুলার লেখা চাই ব্রাদার!

  3. souravdgx@gmail.com

    ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার ‘দ্যা গডফাদার’ ভারতে এসে প্রকাশ ঝার ‘রাজনীতি’ হয়, আর আমরা শুধু নামটা নিই আর কিছুনা (আজম খান ও রুবেল অভিনীত ‘গডফাদার’)।

    ^
    রাজনীতির সাথে গডফাদারের কোন মিল নেই।সরকারের কিছুটা মিল আছে।গডফাদার কনসেপ্ট নিয়ে বলিউডে অনেকগুলা ছবি হয়ে গেছে।তবে তার একটাও রাজনীতি নয়।রাজনীতিতে মহাভারতের একটা ছায়া আছে।রনবীর হল অর্জুন আর অজয় কর্ন।মনোজ বাজপায়ী দূর্যোধন।

    আর গডফাদারের কাহিনী নেওয়া হয়েছে রামুর কোম্পানি থেকে।মজার ব্যাপার হলো আমি হল এ প্রথমে গডফাদার দেখি।তার বছরখানেক পরে টিভিতে কোম্পানি।:-P

    রুবেলের আরও একটা ছবি মুখোশ(নদী,আলীরাজ,মিজু,ওয়াসিম,ঝুমকা) দেখার অনেক পরে আমি ডন(অমিতাভ/শাহ্রুখ) দেখি ।

    আমাদের আরেক সমস্যা, আমার মনে হয়, অল্প বিদা। ভয়ংকর এই শিক্ষা নিয়ে আমরা নলিনী কেষ্ট কে ক্রিস্টোফার নোলান বা পচু আলী কে আল পাচিনোর সাথে তুলনা করি; আর আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখে বাংলা সিনেমা না দেখার সিদ্ধান্ত নিই। আর ঠাকুর ঘর থেকে আহ্লাদে আটখানা বা লজ্জায় আধখানা হয়ে ঘোড়ার স্বরে ঘোষণা করি ‘আমি বাংলা সিনেমা দেখি না’। চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি আমাদের এই নাক উঁচু ভাব আর অসামান্য অবহেলাও এর ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণ। পাশেই প্রতাপশালী হলিউডের ছায়া ফেললে কেমন দেখাবে? সাথে সিনেমা হলের করুণ দশার কথাও যোগ করুন।

    আমাদেরই দোষে এ পতিতাবস্থা। উত্তরণের চেষ্টাও করতে হবে আমাদেরকেই।

    তবে পরিচালকদেরো আর হল মালিকদের ঘাড়েও অনেক দোষ বর্তায়।

    যাইহোক।অসাধারন লিখছেন।শুভকামনা

    • রুবেলের মুভিটার নাম মুখোশ?নাকি মুখোশধারি?
      আর ওয়াসিম নদী ঝুমকার সাথে কোন মুভিতে অভিনয় করেছে বলে জানা নাই।আপনে কি একটু লিঙ্ক দিয়ে সহায়তা করবেন যদি ঐ মুভির কোন ভিডিও ক্লিপ থাকে?

      আর গডফাদারের সাথে মহাভারত মিক্স কইরা প্রকাশ ঝা ভারতে রাজনীতি বানাইছে।
      ইন্ডিয়ার সমালোচকদের ই এমন বলতে শুনেছি।আমার কাছেও তেমন ই মনে হয়েছে।

      ধন্যবাদ!

    • অ্যাডমিন

      কিসের লিংক খুজেন?

  4. উনি উপরে মুখোশ সিনেমার নাম বলেছেন।যেখানে ওয়াসিম এর কথা এসেছে।
    আমি সেই মুখোশ সিনেমার লিঙ্ক চাইছিলাম। এডমিন।
    আপনের কাছে আছে নাকি?

মন্তব্য করুন