
এস এম সুলতানের শিল্প ও বাংলার গল্প ‘আদম সুরত’
‘আদম সুরত’ — একটি নাম, একটি প্রামাণ্যচিত্র, একটি আত্মসন্ধানী শিল্পভাষ্য। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রটি বাংলাদেশের প্রান্তিক বাস্তবতা, গ্রামীণ সভ্যতার মর্মরস এবং একজন মহাপ্রাণ শিল্পীর অন্তর্জগতকে এক অনুপম সৌন্দর্যবোধ ও ধ্যানমগ্নতায় ধারণ করে। এই চলচ্চিত্র শুধু এস. এম. সুলতানের জীবন বা শিল্পের গল্প নয়—এটি বাংলার মাটির সঙ্গে এক গভীর নৈতিক, দার্শনিক ও নন্দনতাত্ত্বিক সংলাপ।
তারেক মাসুদ যেমন নিজেই বলেন,
“চলচ্চিত্র আমার কাছে শুধু গল্প বলার মাধ্যম নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।”
‘আদম সুরত’ সেই স্বপ্নেরই এক নির্জন অথচ অনন্ত বিস্তার।

এস. এম. সুলতান: শিল্পীর জীবনের অনন্য বয়ান
শেখ মোহাম্মদ সুলতান—বাংলা চিত্রকলার প্রান্তিক অথচ প্রবাদপ্রতিম নাম—জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইলের মাটি ও নদীতে ঘেরা মাছিমদিয়া গ্রামে। মিস্ত্রিপিতার ঘরে বেড়ে ওঠা এই শিল্পী বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু সৃষ্টিশীলতা যেন জন্মসূত্রেই তাঁর অস্তিত্বে রোপিত ছিল।
১৯৩৮ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেও তা তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তিন বছরের মাথায় ছেড়ে দিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন এক পরিক্রমণ—শিল্প, দর্শন ও জীবনান্বেষার এক আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা। তাঁর শিল্পভ্রমণ প্রসারিত হয় ভারত, পাকিস্তান, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর কাজ যতই প্রশংসিত হোক না কেন, সুলতানের আত্মা ছিল নড়াইলে—বাংলার গ্রামীণ মানুষের মাঝে।
সুলতান শুধু একজন চিত্রকর ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দর্শনের ধারক। গ্রামীণ শিশুদের জন্য ‘শিশুস্বর্গ’ নামে বিকল্প শিল্পবিদ্যালয় গড়ে তুলে তিনি যেভাবে স্বাধীন শিল্পভাবনার চর্চা করেছেন, তা এই উপমহাদেশে বিরল। তাঁর নিজের ভাষায়:
“আমি বরং নিমিত্ত; আমাকে উপলক্ষ করে আপনারা বাংলার কৃষকের ওপর ছবি বানান।”
আহমদ ছফা ও তারেক মাসুদ: চিন্তার এক সেতুবন্ধ
তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র-ভাবনার ওপর সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফার প্রভাব ছিল গভীর ও স্থায়ী। ছফা ছিলেন এস. এম. সুলতানের জীবন ও শিল্পচিন্তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যাকার। তাঁর রচনায় যেমন দেখা যায় শিল্পী সুলতানের ঐতিহ্য, দর্শন ও দারিদ্র্যের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, তেমনি তারেক মাসুদ এই জীবনদর্শনকে চলচ্চিত্রের পর্দায় অনুবাদ করেন অত্যন্ত সংবেদনশীলতায়।
ছফার মতো মাসুদও বিশ্বাস করতেন—শিল্পের চূড়ান্ত দায়িত্ব হলো মানুষের গভীর সত্যকে উদ্ঘাটন করা। ছফার ‘সুলতান’ প্রবন্ধ শুধু তথ্যসূত্র নয়; এটি ছিল তারেক মাসুদের জন্য এক নৈতিক-সাংস্কৃতিক নির্দেশনা, যা ‘আদম সুরত’-এর গঠনমূলক দর্শনকে শক্তি জুগিয়েছে। ছফার প্রভাবেই মাসুদের মধ্যে শিল্পকে আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যম হিসেবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়।

সুলতানের চিত্রভাষা: প্রতিরোধ, সৌন্দর্য ও শক্তির রূপান্তর
সুলতানের ক্যানভাস ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র, যেখানে কৃষক, শ্রমজীবী, গরীব মানুষ এবং বাংলার প্রকৃতি এক অন্তরশক্তির প্রতিমূর্তি হয়ে ধরা দিয়েছে। তাঁর ছবিতে মানুষের শরীর যেন দেহ নয়—নৈবেদ্য। পেশীবহুল, বলিষ্ঠ পুরুষ-নারী যেন প্রকৃতির সন্তান, যারা পরিশ্রম আর প্রতিরোধের প্রতীক।
ফার্স্ট প্ল্যানটেশন (১৯৭৫), চর দখল (১৯৮৮), নবান্ন (১৯৮৫), শস্যভরা ধানের ক্ষেত—এসব চিত্রকর্মে শুধু রঙ ও রেখা নেই, আছে ইতিহাসের শরীর, সমাজের ভাষা এবং জাতিগত আত্মপরিচয়ের প্রতিবাদী ঘ্রাণ।
তাঁর শিল্পে ইউরোপীয় আধুনিকতার ছায়া থাকলেও মূল ভিত্তি ছিল মাটি, নদী, ধানক্ষেত, শ্রমজীবনের কাব্য। তাঁর নিজের কথায়:
“আমার শিল্পে আমি মানুষের শক্তি ও প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ধরতে চাই।”
‘আদম সুরত’: নির্মাণের অন্তরশক্তি ও চলচ্চিত্রের শরীর
আদম সুরত এস এম সুলতানের জীবনের বিভিন্ন দিক—তাঁর শৈশবের সংগ্রাম, শিল্পী হয়ে ওঠার যাত্রা, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি এবং গ্রামে ফিরে সাধারণ জীবনযাপন—একটি সুসংগত, আবেগময় এবং কাব্যিক বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরে। তারেক মাসুদ সুলতানের শিল্পচিন্তা, সমাজের প্রতি তাঁর গভীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলার কৃষক সমাজের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসাকে কেন্দ্রে রেখেছেন। সুলতানের একটি উক্তি—“আমি বরং নিমিত্ত, আমাকে উপলক্ষ করে আপনারা বাংলার কৃষকের ওপর ছবি বানান”—ছবিটির মূল সুর হয়ে উঠেছে।
ডকুমেন্টারিটি সাক্ষাৎকার, সুলতানের চিত্রকর্মের ক্লোজ-আপ শট, নড়াইলের গ্রামীণ জীবনের দৃশ্য এবং তাঁর দৈনন্দিন কার্যকলাপের একটি সূক্ষ্ম সমন্বয়। এটি সুলতানের সাধারণ জীবনধারা, গ্রামের শিশুদের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক এবং শিল্পের প্রতি তাঁর অটুট নিষ্ঠাকে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে ধরে। ছবিটির গঠন সরল কিন্তু গভীর, যা দর্শককে সুলতানের জীবন ও বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির গভীরে নিয়ে যায়।
দৃশ্য ও সিনেমাটোগ্রাফি: একটি দৃশ্যকাব্য
১৬ মিলিমিটার ফিল্মে শ্যুট করা আদম সুরত তার সময়ের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দৃশ্যগত সৌন্দর্যে অতুলনীয়। চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের ক্যামেরা নড়াইলের প্রাকৃতিক দৃশ্য—নদীর তীর, সবুজ মাঠ, গ্রামের পথ—এবং সুলতানের রঙিন ক্যানভাসকে একটি কাব্যিক ছন্দে ধরে। সুলতানের চিত্রকর্মের ক্লোজ-আপ শটগুলো তাঁর শিল্পের গভীরতা, শক্তি এবং আবেগকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়। নদীর ধারে সুলতানের হাঁটা, গ্রামের শিশুদের সাথে তাঁর হাসিমুখে কথোপকথন এবং তাঁর আঁকার মুহূর্তগুলো ছবিটিকে একটি দৃশ্যমান শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করে।
তারেক মাসুদ নিজে বলেছিলেন যে ফিল্ম স্টক ও আলোর অভাবে একটি মাস্টার শট নেওয়া সম্ভব হয়নি, যা তাঁর জন্য একটি আক্ষেপের বিষয় ছিল। তবে, মিশুক মুনীরের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি এবং তারেকের দৃষ্টিভঙ্গি এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ছবিটিকে একটি দৃশ্যকাব্যে পরিণত করেছে। প্রতিটি ফ্রেম যেন একটি চিত্রকর্ম, যা সুলতানের শিল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রামীণ বাংলার সৌন্দর্যকে উদযাপন করে।
সঙ্গীত ও শব্দ: গ্রামীণ জীবনের সুর
আদম সুরত এর শব্দ নকশা এবং সঙ্গীত ছবিটির গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে অপূর্বভাবে মিলে যায়। গ্রামের প্রাকৃতিক শব্দ—পাখির কলতান, নদীর কলধ্বনি, গ্রামবাসীর কথোপকথন—এবং সূক্ষ্ম পটভূমির সঙ্গীত ছবিটির আবহকে গভীর ও আবেগময় করে। সঙ্গীতের ব্যবহার অত্যন্ত সংযত, যা সুলতানের জীবনের সরলতা এবং শিল্পের প্রতি তাঁর নিষ্ঠার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই শব্দ নকশা দর্শককে নড়াইলের গ্রামীণ পরিবেশে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করে, যেন তারা সুলতানের পাশে হাঁটছে।
প্রভাব ও তাৎপর্য: একটি সাংস্কৃতিক মাইলফলক
আদম সুরত শুধু একটি ডকুমেন্টারি নয়, এটি তারেক মাসুদের শিল্পীসত্তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি সাংস্কৃতিক মাইলফলক। ছবিটি নির্মাণের সময় তারেক মাসুদ সুলতানের সান্নিধ্যে এসে নিজের জীবনবোধে একটি গভীর পরিবর্তন অনুভব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “সুলতানের ছায়া, আমার জীবনে, আমার কাজে, আমার মৃত্যুতে।” এই ডকুমেন্টারি তাঁর পরবর্তী কাজ, বিশেষ করে মাটির ময়না (২০০২) এবং রানওয়ে (২০১০) এর মতো চলচ্চিত্রের জন্য ভিত্তি রচনা করে।
ছবিটি সুলতানের শিল্পের প্রতি অটুট নিষ্ঠা, বাংলার কৃষক সমাজের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা এবং শিল্পের মাধ্যমে মানবতার সন্ধানের গল্প বলে। এটি দর্শককে শিল্প, জীবন এবং সমাজের মধ্যে একটি গভীর সংযোগের কথা ভাবতে বাধ্য করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তারেক মাসুদ উৎসবে ছবিটির ডিভিডি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যা সুলতানের জীবন ও শিল্প নিয়ে একটি অমূল্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই ডকুমেন্টারি বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য সুলতানের উত্তরাধিকারকে জীবন্ত রাখে।

সীমাবদ্ধতা: প্রযুক্তির সীমা, শিল্পের অসীমতা
আদম সুরত তারেক মাসুদের প্রথম কাজ হওয়ায় কিছু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। ১৬ মিলিমিটার ফিল্মের কারণে কিছু দৃশ্যে রেজোলিউশনের সীমাবদ্ধতা এবং শটের সংখ্যার স্বল্পতা অনুভব করা যায়। তারেক মাসুদ নিজে বলেছিলেন যে ফিল্ম স্টকের অভাবে তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত সব শট নিতে পারেননি। তবে, এই সীমাবদ্ধতাগুলো ছবির আবেগময় গভীরতা, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাংস্কৃতিক মূল্যকে ম্লান করতে পারেনি। তারেক ও মিশুকের সৃজনশীলতা এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করে ছবিটিকে একটি শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেছে।
তারেক মাসুদের সৃজনযাত্রার সূচনা
এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকালে তারেক মাসুদের জীবনে ঘটে দুটি মৌলিক ঘটনা: তিনি তাঁর সৃষ্টিশীল পথ নির্ধারণ করেন, এবং পরিচিত হন ক্যাথরিন শেপিয়ারের সঙ্গে, যিনি পরবর্তীতে ক্যাথরিন মাসুদ হিসেবে তাঁর সঙ্গী হন ব্যক্তিজীবন ও চলচ্চিত্রজগতে।
সুলতানের জীবনদর্শন, পরবর্তীতে ‘মাটির ময়না’ ও ‘মুক্তির গান’-এর মতো চলচ্চিত্রে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়, যেখানে বাংলার ইতিহাস, ধর্ম, সমাজ এবং মানবিক দ্বন্দ্ব এক অন্তঃসলিলা দর্শনে রূপ পায়।
উপসংহার: একটি নিরবধি শিল্পকর্ম
আদম সুরত একটি হৃদয়গ্রাহী, চিন্তাশীল এবং দৃশ্যত মনোমুগ্ধকর ডকুমেন্টারি, যা এস এম সুলতানের জীবন ও শিল্পের মাধ্যমে বাংলার মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতির গল্প বলে। তারেক মাসুদের সংবেদনশীল পরিচালনা, মিশুক মুনীরের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি এবং সুলতানের জীবনের আকর্ষণীয় গল্প এই ছবিকে একটি নিরবধি শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেছে। এটি শিল্প, সংস্কৃতি এবং মানবতার প্রতি আগ্রহী যেকোনো দর্শকের জন্য একটি অবশ্যদ্রষ্টব্য চলচ্চিত্র। আদম সুরত তারেক মাসুদের পরবর্তী মাস্টারপিসগুলোর ভিত্তি রচনা করেছিল এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও শিল্পজগতে তাঁর অবদানের প্রথম স্বাক্ষর হিসেবে চিরস্মরণীয় থাকবে।
রেটিং: ৯.২/১০
একটি প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে অত্যন্ত শক্তিশালী, আবেগময় এবং সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকলেও, এর শৈল্পিক গুণাবলী এবং গভীরতা এটিকে একটি কালজয়ী কাজে পরিণত করেছে।ছে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করেছে।
সুপারিশ
যে দর্শক শিল্পকে শুধু সৌন্দর্যের উপাদান নয়, বরং নৈতিক প্রতিজ্ঞা, দার্শনিক অনুসন্ধান ও আত্মিক সেতুবন্ধ হিসেবে বিবেচনা করেন, তাঁদের জন্য ‘আদম সুরত’ হবে এক বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা। এটি একটি আত্মার চলচ্চিত্র।