
টাঙ্গাইলে বাধার মুখে ‘তাণ্ডব’ প্রদর্শনী বন্ধ
সিনেমা হল না থাকায় টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তাণ্ডব’ প্রদর্শনে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। স্থানীয় একটি অডিটোরিয়াম ভাড়া নেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার হেড অব মার্কেটিং কামরুজ্জামান সাইফুল। কিন্তু স্থানীয় কিছু মানুষের বাধার মুখে সিনেমাটির প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়। গত মঙ্গলবার শো বন্ধের এই সিদ্ধান্ত নেন আয়োজকরা।
এ বিষয়ে কামরুজ্জামান সাইফুল ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘তাণ্ডব সিনেমা যে ১৩২ টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ’আউলিয়াবাদ অডিটোরিয়াম’ তার মধ্যে একটি। এখানে যা ঘটেছে তা হলো ঈদের আগের দিন স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো থেকে অডিটোরিয়ামে তান্ডব চালানো বন্ধ করার জন্য মাইকে ঘোষণা হয় এবং সমস্ত পোস্টার ও ব্যনার ছিড়ে ফেলে। এরপর আলেম সমাজ বা ওলামা পরিষদ নামে একটি মিছিল বের হয়।

ঘটনাটি ফেসবুকে স্থানীয়ভাবে ভাইরাল হয়ে যায়। এতে করে স্থানীয় জনগণের ভেতরে আশংকা তৈরি হয় যে অডিটোরিয়ামটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঈদের দিন অডিটোরিয়াম ঘেরাও হতে পারে এরকম সংবাদ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। চারিদিকে আতঙ্কিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলাফল ঈদের দিন কোন দর্শক আসেনি। সঠিক সময়ে আশে পাশের এলাকার দর্শক না আসায় দূরের দর্শক অডিটোরিয়ামের সামনে দিয়ে এসেও ঘুরে যেতে থাকে। তবুও একপ্রকার অনন্যোপায় হয়েই মাত্র ২০-২৫ জন দর্শক নিয়েই সন্ধ্যার শো টি চালু করে দেই।
শোনা যায় পরের দিন আলেম সমাজ সিনেমা হল বন্ধ করার জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে উপজেলা নির্বাহী পরিষদ বরাবর আবেদন করে। আমরা ঈদের আগেই স্থানীয় থানায় পুলিশি সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছিলাম। আলেম সমাজের কথা শুনে কার্যত থানা থেকে কোন ধরনের সহায়তা করা হয়না। ঈদের বন্ধের ভেতরে টাঙ্গাইল ডিএসবি এবং এসপি অফিসে যোগাযোগ করেও পুলিশি সাহায্য না পেয়ে ব্যর্থ হতে হয়। এমতাবস্থায় শত বাধা সত্বেও আমার একক ইচ্ছেতে ঈদের পরের দিন অডিটোরিয়াম চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেই।
সেদিন মিছিল না হলেও আলেম সমাজের সমাবেশ ঘটে। জানা যায় শুধুমাত্র আউলিয়াবাদ নয় সারা টাঙ্গাইল শহরে সর্বদলীয় আলেম সমাজ নিয়ে তারা মিছিল সমাবেশ করবে। আমার জন্য এত বড় একটা ঘটনা ঘটবে ভাবতেই আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। উপরন্তু থানা, উপজেলা, জেলা পরিষদ তদুপারি ডিএসবি অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়, এই বিষয় নিয়ে মিটিং মিছিল হলে পারমিশন ক্যানসেল করে দেয়া হবে। প্রায় সবাই আমাকে নেগোশিয়েট করার পরামর্শ দেয়। আমার গ্রামের বাড়ি এই উপজেলাতেই হওয়াতে আমি গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এরকম অনেককে দিয়েই আলেম সমাজের সাথে নেগোশিয়েট করার চেষ্টা করি। স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজনও সংস্কৃতিপ্রেমী হলেও তারা এরকম ধর্মীয় সেনসিটিভ ইস্যু নিয়ে আলেম সমাজের মতের বাইরে কথা বলতে কেউ হয়না। তবুও আলেম সমাজের সাথে কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল এক শর্তে, শুধুমাত্র আমাকেই যা বলার বলতে হবে আমার পক্ষে কেউ ওকালতি মানে কেউ কোন কথা বলবেনা।
আমি একা ভার্সেস আলেম সমাজ!
মনে মনে গুছিয়ে নিলাম কি বলবো। সব জায়গা থেকে নেয়া পারমিশন। সার্টিফিকেশন বোর্ডের ইউিনভার্সেল রেটেড সার্টিফিকেট।আমার রুটি রুজি। ইনভেস্টমেন্ট। একই এলাকায় বাড়ি। আমি তাদেরই সন্তান। ভুল হয়ে গেছে আর করবো না। জাস্ট এ রকম..
সালিসের জায়গাটিতে গিয়ে তাদের কঠোর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলা গেলোনা। আমি হাত জোড় করে মাফ চেয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময়ের আর্জি জানালাম। আলেম সমাজ অনড়। আমাকে কালই চলে যেতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না চলে যাবো ততক্ষণ পর্যন্ত তারা গোনাহগার হতে থাকবে, এলাকায় গজব পড়তে থাকবে। এতবড় পাপের বোঝা নিয়ে তারা হাসরের ময়দানে দাঁড়াতে পারবেনা। ইত্যাদি ইত্যাদি..
যাইহোক, এখানে আলেম সমাজগণ সিনেমা চালাতে না দিলে কার কি আসে যায়! ‘আউলিয়াবাদ অডিটোরিয়াম’ যেহেতু সত্যিকারের সিনেমা হল নয় এ কারনে এটি চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির অন্তর্ভুক্তও নয়। কাজেই সমিতির গায়ে আলেমদের ঝড় লাগার কথা নয়। আবার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ঈদের দিন থেকেই মাল্টিপ্লেক্স এবং সবগুলো প্রচলিত সিনেমা হলগুলো থেকেই বাম্পার ব্যবসা করে যাচ্ছে। সুতরাং অপ্রচলিত হলগুলো যারা নাকি এককালিন অগ্রিম টাকা দিয়ে নিয়ে যায় তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একটা আউলিয়াবাদ অডিটোরিয়াম থেকে পরবর্তী আয় না এলেই কিবা আসে যায়! বাকি ১৩১ টা সিনেমা হল থেকে তো আসবেই।’
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ’ নামের একটি সংগঠন। পাশাপাশি সংঘবদ্ধ হস্তক্ষেপের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জোরালো আহ্বান জানান তারা।
গতকাল বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সনদপ্রাপ্ত একটি চলচ্চিত্র ‘তাণ্ডব’-এর প্রদর্শনীতে স্থানীয় কিছু গোষ্ঠীর উসকানি এবং মব সৃষ্টির মাধ্যমে জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাকে আমরা শুধু চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখছি না, বরং এটি বাংলাদেশের সহজিয়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সহাবস্থানের চর্চা এবং শিল্প-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।’
আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশ বহু ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ। এই ভূখণ্ডের সহনশীল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের সিনেমা, সংগীত, যাত্রাপালা, নাটক ও সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। কারও কাছে কোনো সিনেমা অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু সেটি দেখা বা না-দেখা একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে, সংঘবদ্ধ মবের মাধ্যমে প্রদর্শনী বন্ধ করার চেষ্টা, সিনেমা হলের কর্মীদের হুমকি দেওয়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি স্পষ্টতই সংবিধান ও আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড।’
রাষ্ট্রের কাছে সিনেমা হল মালিক, কর্মী ও দর্শকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ‘অতএব, আমরা জোরালোভাবে বলছি, সেন্সর বোর্ডের অনুমোদিত চলচ্চিত্রের মুক্তপ্রদর্শন সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার মৌলিক অংশ। সিনেমা হলের মালিক, কর্মী ও দর্শকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এই প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জোরালো অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এ ধরনের ঘটনায় আইনি প্রেক্ষপটের বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ বিবৃতিতে বলেছে, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ মনে করে, এ ধরনের ঘটনা শুধু নৈতিক বা সাংস্কৃতিক অধিকার লঙ্ঘন নয় একই সাথে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়েও পড়ে। প্রয়োজন মাফিক এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠানো এবং উচ্চ আদালতে রুল জারির মাধ্যমে সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ভবিষ্যতে প্রশাসনিক নিরবতা কিংবা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটলে সংশ্লিষ্ট পক্ষের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার আমরা সংরক্ষণ করি।’
সবশেষে টাঙ্গাইলের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে সংগঠনটি বলে, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়। একই সঙ্গে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি ‘তান্ডব’ চলচ্চিত্রটির পুনরায় প্রদর্শনের সুযোগ নিশ্চিত করা হোক, যা গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পক্ষে স্পষ্ট বার্তা হয়ে থাকবে।’