Select Page

বাড়ির নাম শাহানা
ডানা ভাঙা নয় ডানা মেলার গল্প

<div class="post-subheading">বাড়ির নাম শাহানা</div>ডানা ভাঙা নয় ডানা মেলার গল্প

অতটুকু চায়নি বালিকা
অত শোভা, অত স্বাধীনতা
চেয়েছিলো আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক।
অতটুকু চায়নি বালিকা
অত হৈ রৈ লোক, অত ভিড়, অত সমাগম
চেয়েছিলো আরো কিছু কম।
নিঃসঙ্গতা, আবুল হাসান

প্রতিটি মেয়ে বিশেষত যারা বাস্তবতার পোড় খেয়ে বড় হয় বা শেখে তারা জীবনে এতটুকুই চায়। আয়নার সামনে তারা নিজেদের যতটুকু প্রকাশ করতে পারে বাস্তবতার শৃঙ্খলে ততটা পারে না কারণ বাস্তবের মানুষগুলো তাদেরকে আবদ্ধ জীবনে বন্দি করতে চায়। সেই বন্দিত্বের শৃঙ্খল ভেঙে পাখির মতো নিজের বাঁধাহীন ডানা মেলা জীবনের কথা বলা ছবি ‘বাড়ির নাম শাহানা’। লিসা গাজী-র পরিচালনায়।

প্রচলিত সমাজে মেয়েদের জীবনে কোনো বড় ঘটনা থাকলে বাইরের সমাজ তো পরের কথা নিজের সমাজ যাকে আমরা পরিবার বলি সেই পরিবারই স্বাভাবিকভাবে মানতে পারে না। পরিবারের মানুষের চোখগুলোকেও তখন বড় বড় মনে হয়, এই বুঝি সেগুলো শৃঙ্খলতার শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে। ছবির প্রধান চরিত্রে আনন সিদ্দিকাকে সেইসব চোখের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই করতে হয়েছে। তার জীবনে কী ঘটনা ঘটেছে তা দর্শক ছবি দেখেই জেনে নিতে পারবে। ঘটনা থেকে বের হবার জন্য তার নিজের যে আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধ সেটা সমাজের অন্যান্য মেয়েদের জন্য বার্তা যারা তার মতো বাধা ভেঙে এগিয়ে যেতে চায়।

নিজের অস্তিত্বকে দিয়ে অন্যের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করার মতো মানুষ বাস্তবে কয়জন পাওয়া যায়! হয়তো অনেক কম। অন্যের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে তার জন্য কিছু করার মতো মানুষই বা কয়জন পাবেন! এটাও অনেক কম। অস্তিত্ববাদী দর্শনে এই প্রচেষ্টাটি আসে বাস্তবতার গভীর উপলব্ধির অংশ হিসেবে যেখানে ব্যক্তিমানুষ নিজের স্বাধীন সত্তা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পদক্ষেপ নিতে চায়। আনন সিদ্দিকার মধ্যে এই অস্তিত্ববাদী উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে চরিত্রটি প্রচণ্ড বাস্তববাদী হয়ে উঠেছে যা উচ্চমার্গীয়ভাবে প্রশংসার দাবিদার।

আনন সিদ্দিকার চরিত্রায়ণে কিছু উপকরণ খুব সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে যার মধ্যে আয়নার ব্যবহার ছিল নোটিশ করার মতো। সে তার অব্যক্ত কথাগুলোকে আয়নার সামনেই বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমরা এটা খুব সাধারণভাবেই জানি যারা অভিনয়শিল্পী তাদের শৈশব-কৈশোরের গল্পে আয়নার সামনে অভিনয় করার গল্প প্রায়ই শোনা যায়। একা একা নিজের মতো করে অভিনয় করার যে স্বাধীনতা সেটাই মুখ্য। এই দিক থেকে আয়নার সামনে আনন সিদ্দিকা একদিকে বিমর্ষ আবার আরেকদিকে দারুণ চটপটে। ‘আজ আমার রেহাই দিবস’ এমন সংলাপটি তার চূড়ান্ত স্বাধীনতার প্রকাশ ছিল। আনন সিদ্দিকার স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় ছবির প্রাণ ছিল।

আনন সিদ্দিকার পর যে চরিত্রটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সে ছিল পরী নামের মেয়েটি। পরীর চরিত্রটি গল্পের অন্যতম শক্তি ছিল এবং প্রধান চরিত্রের সাথে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।


ছবির অন্যান্য চরিত্রগুলোর মধ্যে কাজের মেয়ের চরিত্রটি অনেক লাইভলি ছিল। অনেক কথা বলা, রসকষ মিশিয়ে বলা আর যার সাথে কথা বলে শান্তি পাওয়া যায় তাকে ছাড়তে না চাওয়া এমনিভাবে এ চরিত্রটিকে দেখানো হয়েছে। প্রধান চরিত্রের আনন সিদ্দিকার সাথে তার বন্ধনটা দেখার মতো। পুরুষের মধ্যে যারা নারীর সহযাত্রী হতে মন থেকে চায় তাদের প্রতিনিধি ছিল ইরেশ যাকের। লুৎফর রহমান জর্জ, আমিরুল হক চৌধুরী, নায়লা আজাদ নূপুর তাদের চরিত্রগুলো সমাজের বাস্তবিক দিকটার চরিত্র যারা নিজেদের সংস্কার নিয়ে অটল।

ছবির অন্যতম সুন্দর একটি দিক ছিল জোছনা রাতে রবীন্দ্রনাথের ‘দুই পাখি’ কবিতার পোয়েটিক প্রেজেন্টেশন। শৃঙ্খলতা আর স্বাধীনতার পাশাপাশি অবস্থানের এ কবিতা ছবির গল্প ও উপস্থাপনার সাথে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করেছে।

(১)আপনি যেভাবে পৃথিবীটা দেখেন আমি দেখি না, পৃথিবীটা কি একভাবে দেখার জিনিস?
(২) আপনি সমুদ্রে ডুব দেন আবার কিভাবে কিভাবে যেন পারও হয়ে যান, সাঁতার আপনার রক্তে।
ছবির সংলাপের মধ্যে এ দুটি বাছাই করা সবচেয়ে আকর্ষণীয় সংলাপ ছিল।
লোকেশন, বিজিএম দুটোই প্রশংসনীয়। গানের ব্যবহার ছোট ছোট করে অনেক এবং মন স্পর্শ করার মতো। ন্যাচারাল প্রেজেন্টেশন পুরো ছবিটাই।

ছবির নাম ‘বাড়ির নাম শাহানা’ কেন রাখা হয়েছে এটি সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরাও এ ছবির একটি সাফল্য। গল্পের ভেতর গল্প আছে এবং এখানে বাড়ির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির যে আনন্দ তার সাথে ছবির প্রধান চরিত্রকে সম্পর্কিত করাটা ছিল বিশেষ কিছু।

এ ছবি বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে। লন্ডন, মেলবোর্ন, রোম, মুম্বাই, শিকাগোতে পুরস্কার লাভ করেছে। মুম্বাই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘জেন্ডার সেনসিটিভিটি অ্যাওয়ার্ড’, লন্ডনের বিএফআই উৎসবে হয়েছে দর্শকপ্রিয় সেরা ছবি, রোমের কারাভান ফেস্টিভ্যালে ‘সেরা চলচ্চিত্র’ নির্বাচিত হয়েছে।

দুই ধরনের ছবি আছে – মসলাদার বাণিজ্যিক ছবি অন্যদিকে ভালো গল্প ও নির্মাণের ছবি। দ্বিতীয়টি শিল্পের ক্ষু্ধা মেটাতে বেশি কাজ করে এবং ‘বাড়ির নাম শাহানা’ সেই ছবি হয়ে উঠেছে।

রেটিং – ৮.৫/১০


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply