Select Page

‘তুফান’ সিনেমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা গল্পে

‘তুফান’ সিনেমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা গল্পে

[সতর্কতা:তুফান‘-এর রিভিউতে বর্ণিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অপরাধ জগত সম্পর্কিত ঘটনা বিএমডিবি যাচাই করে দেখেনি। এ বর্ণনা একান্ত রিভিউ লেখকের]

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইনের। গোটা দশক ধরে শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশে ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে তিনি। পরিণত হয়েছেন দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীতে। সুব্রত বাইনের উত্থান হয় ৯১-এর বিএনপি সরকারের সহচর্যে। বিএনপির লুৎফজ্জামান বাবর, গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, হারিস চৌধুরী এমনকি তারেক জিয়ার কাছেও বিশেষ কদর ছিল সুব্রত বাইনের। সেই সুবাদে সন্ত্রাসের যত শাখা আছে তার সবকটিতেই অবাধ বিচরণ ছিল সুব্রতের। তার নামে ৩০টি মার্ডারের মামলা থাকলেও সুব্রত বাইনের প্রকৃত মার্ডারের সংখ্যা ছিল তারচেয়ে বহুগুণ বেশি। মানুষ পিঁপড়া মারতেও যতটা ভাবে সুব্রত বাইন মানুষ মারতেও ততটা ভাবতো না।

নব্বইয়ের গোড়ার দিকে মগবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো তৎকালীন আরেক দুর্ধষ সন্ত্রাসী যুবলীগের লিয়াকত। আধিপত্য নিয়ে লিয়াকতের সাথে সুব্রত বাইনের দ্বন্দ্ব তখন চরমে। সেই সময় লিয়াকতের কবল থেকে মগবাজার এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বিএনপির নেতারা সমর্থন দেয় সুব্রত বাইনকে। এরপর সুব্রত খুন করে আগারগাঁওয়ে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মুরাদকে। এইসব ঘটনায় ক্রমেই বিএনপির প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে সুব্রত। মগবাজারের মধুবাগ মাঠে একবার তার জন্মদিনের উৎসব হয়। ওই উৎসবে বিএনপির অনেক নেতা উপস্থিত হয়েছিল। সেই ঘটনায় সুব্রত বাইন রাতারাতি তারকা সন্ত্রাসী বনে যায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সুব্রত বিএনপির হয়ে মগবাজার এলাকায় কাজ করে। এরপর সুব্রত বাইন বিএনপির লুৎফজ্জামান বাবরসহ অনেক নেতার কাছের লোক হয়ে ওঠে।

সুব্রত বাইনের জীবনের গল্পের ওপরই মূলত নির্মিত হয়েছে ‘তুফান’ সিনেমাটি। তবে সিনেমার প্রয়োজনে গল্প শেষ পর্যন্ত আর সুব্রত বাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরিণতি দিতে তুফানের গল্প মাঝপথে সুব্রত বাইনকে ছেড়ে এগিয়েছে নিজস্ব গতীতে। তাই এটা সুব্রত বাইনের বায়েপিক নয় বললেও আপত্তি করা যাবে না। কারণ সুব্রত বাইনের জীবনের হাত ধরে গল্প শুরু হলেও শেষে পর্যন্ত তুফান এগিয়েছে স্বাতন্ত্র্যভাবে।

রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকেই হয়তো বলবেন তুফানের গল্পের সাথে সুব্রত বাইনের জীবনের কোনো সংযোগ নেই। তাদের জন্য আমি কয়েকটি প্রমাণ দিচ্ছি, ‘তুফান’ সিনেমায় তুফান চরিত্রে শাকিব খানের বাবা একজন এনজিওকর্মী। সুব্রত বাইনের বাবাও ছিল একজন এনজিওকর্মী। ১৯৯৭ সালে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম নামক একজন এসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এসি) গ্রেফতার করেছিল সুব্রত বাইনকে। তুফান সিনেমায় গোয়েন্দা পুলিশের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর নামও আকরাম ওরফে এসি আকরাম। এসি আকরাম সুব্রত বাইনকে গ্রেফতার করেছিল নয়াপল্টনের একটি হাসপাতাল থেকে। তুফান সিনেমায়ও একটি হাসপাতালে তুফানকে গ্রেফতার করতে গেলে পুলিশের সাথে একটা ফাইটিং সিন আছে। তৎকালীন বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবর দেশে সন্ত্রাসের বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিল ‘আর লুকিং ফর শত্রুজ’। এখনো পর্যন্ত লুৎফজ্জামান বাবরের কথাটি বিখ্যাত হয়ে আছে। তুফান সিনেমায় সরকারি দলের নেতার চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু কুখ্যাত সন্ত্রাসী তুফান প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে লুৎফজ্জামান বাবরের সেই বিখ্যাত ডায়ালগটি একটু ঘুরিয়ে বলে, ‘ইউ আর লুকিং ফর অপরাধীজ’! এক সুব্রত বাইনের ওপর ভর করে না হলেও টোকাই সাগর, পিচ্চি হান্নান, মুরগী মিলন, কালা জাহাঙ্গীর, কিলার আব্বাস, ভিপি হান্নানসহ বিএনপি সেই সময় এরকম কুখ্যাত সন্ত্রাসী এবং সিরিয়াল কিলারদের ওপর ভর করে ক্ষমতায় এসেছিল এবং টিকে ছিল। দেশ পরিণত হয়েছিল সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে। পরবর্তীতে বিতর্কের চাপে বিএনপি নিজেই এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। তুফান সিনেমায়ও যে তুফানের কাঁধে ভর করে সরকারি দল ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকারই পরবর্তীতে তুফানকে শেষ করে দেয়ার জন্য হুলিয়া জারি করেছে।

এবার সিনেমা প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক। শুরু থেকেই বলা হচ্ছে তুফান কেজিএফ, অ্যানিমেল, জাওয়ানসহ বলিউডের চারটি মুভির আনঅফিশিয়াল রিমিক। বিষয়টা একেবারেই সত্য নয়, আমি অ্যানিমেলও দেখেছি, কেজিএফও দেখেছি। তুফান সিনেমার গল্পের কোনো অংশই এই সিনেমাগুলোর গল্পের সাথে মেলে না। যারা তুফানকে কপি বলছে, তারা আদত নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশন অনুযায়ী শাকিব খানের কস্টিউম, অ্যানিমেল সিনেমার আদলে একটা ভারি মিনিগান দিয়ে নায়কের এলোপাতাড়ি ফায়ারের দৃশ্যের মিল দেখেই কথাগুলো বলছে। তবে হ্যাঁ, অফিসিয়াল বা আনঅফিশিয়াল রিমিক না হলেও তুফানের কিছু কিছু সিন বলিউড তো বটেই আমাদের ঢালিউডেরও কিছু কিছু মুভি থেকে অনুপ্রাণিত।

এই প্রথম শাকিব খানের কোনো অভিনয়কে আমার মোটামুটি রিয়েলস্টিক মনে হয়েছে। স্ক্রিপ্টেড মনে হয়নি। শাকিব খান তার গতানুগতিক ধারা থেকে বের হতে পেরেছে তুফানে। মিমি চক্রবর্তী এককথায় অসাধারণ। মিমির গ্ল্যামার তুফান সিনেমার গ্ল্যামারও বাড়িয়েছে। ‘বিউটি উইথ ব্রেইন’ বলতে যা বোঝায় নাবিলা এককথায় তাই। স্ক্রিনটাইম কম হলেও দুর্দান্ত করেছে আমাদের নাবিলা। চঞ্চল চৌধুরীর কথা নতুন করে বলার কিছু নাই। মিস্ট্রিয়াস কারেক্টারে এসি আকরাম অনবদ্য। চমৎকার অভিনয় করেছে গাজী রাকায়েত।

সবচেয়ে ভালো করেছে পরিচালক রায়হান রাফী। মিনমিন প্রেম পিরীতের গল্প থেকে বের হয়ে একেবারে ভিন্ন একটি গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে তুফান। সাধারণত কেরালা, সাউথইডিয়ান চলচ্চিত্রে এই জনরার গল্প বেশি দেখা যায়। বাংলা চলচ্চিত্রেও পার্কে বসে প্রেম, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ, চৌধুরী গ্রুপ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকের কন্যার সাথে কলেজের সিঁড়িতে ধাক্কা এইসব বস্তাপচা কাহিনি থেকে বের হয়ে ক্রাইম ও পলিটিকাল থ্রিলার জনরার গল্প নিয়ে সিনেমা হয়েছে, বিষয়টা স্বস্তির। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এটা একটা মাইলফলকও বটে।

‘তুফান’ সিনেমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা গল্পে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো একটি গল্প দাঁড় করাতে পারেনি। মনে হচ্ছিল বিক্ষিপ্ত ঘটনার স্লাইডশো। গল্পের মূল প্রোটাগনিস্ট তুফান। কিন্তু তাকে দাঁড় করাতে সিনেমার অর্ধেক পার হয়ে যায়। তুফান স্ক্রিনেও আসে প্রথম চল্লিশ মিনিট পর। এসি আকরাম স্ক্রিনে আসার আগ পর্যন্ত তুফানের কোনো প্রতিপক্ষ নাই, গল্পে কোনো দ্বন্দ্ব নাই, ডিফিকাল্টিস নাই। তুফানের সামনে দাঁড়ানোর মতো কেউ নাই। সুপারম্যানেরও দুর্বলতা আছে, কিন্তু তুফানের নাই। সব শক্তি তার কাছে খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। এটা দুর্বল গল্পের নজির। কোনো টুইস্ট নাই, মাথাখাটানোর ব্যাপার নাই, দ্বান্দ্বিকতা নাই। তুফান আসে, ধাঁই ধাঁই করে গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলে। এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্রাটের আসনে বসে পড়ে।

একটা বিশেষ দৃশ্যের জন্য রায়হান রাফীকে হেড খোলা অভিবাদন। গভীর রাতে পাড়ার হিন্দু নারী পার্বতী ভাবির লেবারপেইন উঠলে শান্ত পার্বতিকে হসপাতালে নিয়ে যায়। রোগীর জীবন বাঁচাতে রক্ত লাগবে। শান্তর অনুরোধে পাড়ার মসজিদের ইমাম মসজিদের মাইকে রক্ত চেয়ে ঘোষণা দেয়। সেই ঘোষণায় রক্ত দিতে এগিয়ে আসে হিন্দু, মুসলিম নারী পুরুষ। এই দৃশ্যে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। চোখ ছলছল করে উঠেছে অদ্ভুত এক ভালোলাগায়। আমাদের চলচ্চিত্রগুলো সবসময় একমুখী। আমাদের চলচ্চিত্র পরিচালকরা একেকটা মসজিদের খতিব। এরা সিনেমাতেও একটা ধর্মকেই প্রমোট করে। অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে এদের সুযোগ থাকলেও এরা দায়িত্বশীল নয়, পক্ষপাতদুষ্ট। সেই সাম্প্রদায়িক ধারা ভেঙে তুফান সিনেমার একটা দৃশ্যে রায়হান রাফী ধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক সহবস্থানের যে চিত্র তুলে ধরেছে তার জন্য এই সম্ভাবনাময় তরুণ নির্মাতার কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা।

রেটিং: ৬.৫/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

রহমান বর্ণিল

"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী"

মন্তব্য করুন