Select Page

“দবির সাহেবের সংসার” একটি কমেডি সিনেমা ?

“দবির সাহেবের সংসার” একটি কমেডি সিনেমা ?

Dabir-Saheber-Songsar-B-235x275***স্পয়লার অ্যালার্টঃ এই ব্লগে কাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। পাঠক নিজ দায়িত্বে পড়ুন। ধন্যবাদ। – অ্যাডমিন***

সত্যজিৎ রায়ের একটি বইয়ে পড়েছিলাম, পরিচালক যত কম সংলাপ ব্যবহার করে ছবির বক্তব্য বা চরিত্রের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবেন তাঁর সার্থকতা তত বেশী, অর্থাৎ পরিমিত সংলাপ ব্যবহার করার মধ্যেই পরিচালকের কৃতিত্ব। জাকির হোসেন রাজু তার নতুন চলচ্চিত্র “দবির সাহেবের সংসার” ঠিক তার উল্টোটা করেছেন। অপ্রয়োজনীয় ভাবে সংলাপ বাহুল্য ছবিটিকে বিশৃঙ্খল করে তোলে। সংলাপ রচয়িতা বা পরিচালক কে এটা বোঝা উচিৎ ছিল, দর্শক এতোটা বোকা নয় যে তাকে গল্প একেবারে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হবে।

পোড়ামন“, “এর বেশী ভালোবাসা যায়না” ছবিগুলো যে কারণে দেখতে যাওয়া “দবির সাহেবের সংসার”ও ঠিক একই কারণে দেখতে যাওয়া, কারণ জাকির হোসেন রাজু। আগের দুটি ছবি সম্পর্কে আমার বক্তব্য ছিল, জাকির হোসেন একটি গল্পকে আদতেই সিনেমা করে তুলেন। মূল ভালোলাগার জায়গাটা ছিল, গল্পকে ঘটনাবহুল ও টুইস্ট পূর্ণ করে তুলতে জাকির হোসেন যথেষ্ট পারঙ্গম। সিনেমার মূল গল্পের সাথে নানান বৈচিত্র্যের ঘটনার মিশেলে তিনি সিনেমাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন, কিন্তু এই সিনেমাটির ক্ষেত্রে সেরকমটি হয়নি, এখানে তিনি একটি ছোট অতিসাধারণ গল্পকে একরকম টেনেটুনে নিয়ে গেছেন, অনেকটা একঘেয়েমি চলে আসে।

গল্পের প্রসঙ্গে আসি, দবির সাহেব একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এবং বিপত্নীক, তার দুই মেয়ে, বড় মেয়ে বিদেশে থাকেন আর ছোট মেয়ে অনেক ছোটকালে হারিয়ে যায়। দবির সাহেব তার ছোট মেয়ে প্রতীক্ষার জন্য দীর্ঘ ১২ বছর ধরে দেশে অপেক্ষা করছেন, তার বিশ্বাস মেয়ে একদিন বাবার কাছে অবশ্যই ফিরে আসবে। এ প্রসঙ্গে একটু বলা দরকার মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার যে প্রেক্ষাপট দেখানো হয়েছে তা এই সময়ে এসে খুবই অযৌক্তিক, ৫-৭ বছরের একটি মেয়ে ইংরেজিতেও পটু, আবার বিচারকের সন্তান অথচ তাকে জঙ্গলে একজন পেয়ে ১২বছর লালন পালন করল কিন্তু একটি বারও মেয়েটি তার বাবার পরিচয় দিলনা বা বাসায় ফিরে যেতে চাইলনা! এখানে বোধ হয় ডিটেইলিং টা আরেকটু বেশী দরকার ছিল। দবির সাহেব বাড়িতে একা বিধায় তিনি তার দেখাশোনা করবার জন্য দুজন কাজের লোক নিয়োগ দেন। এখানেই ছবির প্রধান দুই পুরুষ চরিত্রের প্রবেশ কুদ্দুস চরিত্রে বাপ্পী আর আক্কাস চরিত্রে নবাগত ইমরোজ। গল্প এগিয়ে যায় নানান হাস্যরসাত্মক ঘটনার মধ্য দিয়ে। আক্কাস ও কুদ্দুস নিজেদেরকে দবির সাহেবের কাছে যোগ্য কাজের লোক প্রমাণ করার জন্য একে অপরের সাথে নানান প্রতিযোগিতামূলক আচরণ করতে থাকে। এর মধ্যেই নায়িকার আগমন, মাহি চরিত্রের নাম চুমকি। সে পাশের ফ্ল্যাটের অন্য এক পরিবারের কাজের মেয়ে। সুন্দরী চুমকিকে দেখে আক্কাস ও কুদ্দুস উভয়ের মন উথাল পাথাল করে ওঠে। চলতে থাকে নায়িকাকে জয় করার আরও নানান প্রতিযোগিতামূলক কৌশল। সিনেমাটিতে দ্বিতীয় প্রধান কোন নারী চরিত্র নেই তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে থাকে চুমকি আবার দবির সাহেবের মেয়ে নয় তো? সন্দেহটার উদয় হলেও চাপিয়ে রাখি, নতুন কিছু ক্লাইম্যাক্সের আশায়। শেষতক কি হল সেটা পরে বলছি।

সিনেমাটির পোস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে “জাজের প্রথম সম্পূর্ণ কমেডি ডিজিটাল ছবি” লাইনটি, কিন্তু ছবিটিতে ব্যবহার করা বিভিন্ন কমেডি সিকোয়েন্স, দৃশ্য, সংলাপ আদৌ কতটুকু হাসির উদ্রেক ঘটায় তা প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে যেন নতুন মোড়কে অনেক পুরাতন ফর্মুলা। অবশ্য কমেডি সিকোয়েন্স গুলোতে হলের অনেককেই হাসতে এবং তালি দিতে শুনেছি। আমাদের জীবনে হয়তো হাসির খোরাক দিন দিন কমে আসছে আর তাই এতো সাদাসিধে সাধারণ দৃশ্যগুলোতেও মানুষ হাসছে, পরিচালক এখানে অবশ্যই সার্থক।

গল্প এগিয়ে যায় ঐ চার-দেওয়ালের মাঝেই, মাঝে মাঝে গান সে ক্ষেত্রে কিছুটা আউটডোর লোকেশন রয়েছে,সঙ্গীত পরিচালক শফিক তুহিন, গানগুলো খারাপ না ভালোই, তবে দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের কিছুটা টান রয়েছে। গানের দৃশ্যায়ন ও ভালো তবে কোরিওগ্রাফির উন্নতি বেশ চোখে পড়ার মত বেশ ভালো। আবহ সঙ্গীত করেছেন ইমন সাহা ছবিটিকে কমেডি আবহ দিতে গিয়ে এমন অবস্থা, মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিলো কোন স্ট্যান্ড-আপ কমেডি রিয়্যালিটি শো দেখছি। মধ্যবিরতির পর আবিষ্কৃত হয় চুমকি আসলে চুমকি নয় তার আসল পরিচয় ডেইজি একজন নামকরা ক্লাব ড্যান্সার। কুখ্যাত ডন শামসু এই ডেইজির জন্য পাগল প্রায় আর তাই নিজেকে বাঁচাতেই ডেইজির এই চুমকিরুপ ধারণ। শামসু চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলেকজান্ডার বো, বাংলাদেশে বেশ কিছু অভিনয় শিল্পী রয়েছেন যারা যাত্রা আর সিনেমার পার্থক্য হয়তো বোঝেননা, আলেকজান্ডার বো তাদের মধ্যে একজন বলে মনে হয়েছে। ছবিটির কিছুটা ক্লাইম্যাক্স তো হল, এবার ফাইনাল ক্লাইম্যাক্স। হঠাৎ চুমকি বা ডেইজি বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা যায়, প্রায় ১২ বছর আগে তার ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছিল তাও আবার দেশে নয় বিদেশে, চুমকি ব্যথায় আর্তনাদ করতে থাকে “daddy its hurts…its hurts”। আমার যতদূর জানা বাক্যটি বোধ হয় it hurts হতো its hurts নয়। ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে আমাদের পরিচালকেরা বরাবরই উদাসীন এই ছবিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। চুমকির আর্তনাদে দবির সাহেব স্মৃতি হাতড়ান,ফ্ল্যাশব্যাকে ১২বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তার ছোট মেয়ে প্রতীক্ষার আর্তনাদ তিনি শুনতে পান “daddy its hurts”, ব্যস দর্শক হিসেবে আর বুঝতে বাকি থাকেনা এই চুমকিই দবির সাহেবের হারিয়ে যাওয়া ছোট মেয়ে প্রতীক্ষা। ছবিটির শুরুতেই দর্শক হিসেবে ভবিষ্যতবাণীর সাথে ছবির ক্লাইম্যাক্স মিলে যাওয়ায় কিছুটা আনন্দ তো হয়েছেই তবে আশাহতটা বেশী হয়েছি। এরপর আর কি, নায়িকা হাসপাতাল থেকেই অপহরণ। ভুলে গেলে চলবেনা ভিলেন আলেকজান্ডার বো ওরফে শামসু তো আছেনই। নায়িকা পরবর্তী দৃশ্যেই ভিলেনের ভয়ংকর আস্তানায়, হঠাৎ  করে ছবি কমেডি থেকে ইমোশনাল ড্রামা আর মারমুখী ইমেজে ডাইভার্টেড। অতঃপর নায়ক-যুগল এবং দবির সাহেব নিজেই মারমুখী রূপে হাজির, এবং নায়িকা উদ্ধার। একটা প্রশ্ন থেকে যায় বুকের ব্যথায় কাতরানো নায়িকার ব্যথার কি হয়? সে সম্পর্কে কোন সমাধান ছবিতে দেওয়া হয়নি। এখন হয়তো ভাবছেন নায়ক দুই,নায়িকা এক এখন কি হবে? একটা নায়ক কে মেরে ফেললেই ঝামেলা চুকে যেত। এক্ষেত্রে একটু নতুনত্ব এনেছেন পরিচালক, মাহির ভালোবাসা হিসেবে শাকিব খানের অতিথি চরিত্রে আগমন ঘটে, অতঃপর মধুরে-ণ সমপেয়ত্। সাকিবের আগমনটা বেশ চমকপ্রদ এবং ভালো লেগেছে।

অভিনয় প্রসঙ্গে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় আলীরাজের কথা, দবির সাহেব চরিত্রে তিনি যথেষ্ট ভালো করেছেন। এমনকি এও বলা যেতে পারে সিনেমাটির অন্য সবার চেয়ে আলীরাজের অভিনয় অনেক বেশী বাস্তব ও সাবলীল ছিল। নায়ক-যুগল বাপ্পী ইমরোজ দুজনের অভিনয়ই আমি প্রথম দেখছি, যদিও বাপ্পী এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ছবি করে ফেলেছেন, তবুও নবাগত ইমরোজের অভিনয় অনেক বেশী স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। চর্চার মাধ্যমে তার দ্বারা আরও দক্ষ অভিনয় সম্ভব বলে মনে হয়েছে। মাহিয়া মাহির প্রতিটি ছবিতেই বরাবরই একটা সমস্যা লক্ষ্য করি, চরিত্রের সাথে নায়িকা মাহির কোথায় যেন একটা ফাঁকফোকর থেকে যায়। চরিত্র আত্মস্থ করতে তিনি কিছুটা দূর্বল মনে হয়েছে, তবুও এতো অল্প বয়সে এবং এতো অল্প সময়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মাহি অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে, তাই মাহিকে সাধুবাদ নারী কমেডি চরিত্রের মত এরূপ একটি ভিন্নধর্মী চরিত্র উপহার দেওয়ার জন্য। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপরে অর্থাৎ শুধুমাত্র হাস্যরসকে উপজীব্য করে একটি সম্পূর্ণ ছবি করার জন্য পরিচালক এবং প্রযোজক অবশ্যই অভিনন্দন পাওয়ার দাবি রাখে। তাই ছবিটির নির্মাতা এবং প্রযোজক প্রতিষ্ঠান কে সাধুবাদ। জাকির হোসেন রাজু অনেক অভিজ্ঞ এবং দক্ষ নির্মাতা ভবিষ্যতে তিনি আমাদের আরও ভালো ভালো চলচ্চিত্র উপহার দিবেন এই প্রত্যাশা করি।


৪ টি মন্তব্য

  1. robiulrana

    আরো বেশি আশা ছিল অন্তত জাকির হোসেন রাজুর কাছ থেকে।
    কাহিনীর গভীরতা ছিল না, এক ফ্লাটের মধ্যে ঘোরাঘুরিতে দম বন্ধ লাগছিল। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে পাওয়ার বিষয়টা সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লেগেছে। বাপ্পীর অভিনয় একদম বাজে হয়েছে, সে হিসেবে সায়মন কে বাদ দিয়ে রোজ কে নেয়া ছিল একটা ভাল সিদ্ধান্ত। মাহীর অভিনয়ে পরিপক্কতা না থাকলেও অল্প সময়ে বেশ ভালোই বৈচিত্র দেখা যাচ্ছে।
    আপনার রিভিউ অসাধারন

  2. আরো বেশি আশা ছিল অন্তত জাকির হোসেন রাজুর কাছ থেকে। আপনার সাথে আমি পুরোপুরি সহমত রবিউল রানা।অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

    • robiulrana

      “Daddy it hurts” অংশটুকু খুব সম্ভবত মিসির আলীর ‘নিশীথিনী’ কিংবা অন্য কোন বই থেকে নেয়া যেখানে হনুফা নামের একটা হারিয়ে যাওয়া কিশোরী মেয়েকে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য, মর্মস্পর্শীভাবে তার বাবা-মার কাছে ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের চলচ্ছিত্রের গল্পে রহস্য, এ্যাডভেঞ্চার, রোমান্সের গন্ধও পাওয়া যায় না। সবারই ঐ এক ঘরানা, রোমান্টিক একশন ধর্মী। আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা মনে হয় সিনেমার কাহিনী ও ঘটনা সমাবেশ নিয়ে একেবারেই গবেষনা করেন না। নাহলে আমরা সাধারণ দর্শকরা যে সাধারন ভুলগুলো নিয়ে হাসাহাসি করি, সেখানে এতবড় একটা দক্ষ টীমের সবার নজর এড়িয়ে যায় এরকম অসংখ্য ভূল কি করে!

মন্তব্য করুন