Select Page

দুর্বল গল্পের জবরদস্ত বিনোদন

দুর্বল গল্পের জবরদস্ত বিনোদন

বেপরোয়া- ফ্যামিলি ফার্স্ট
ধরন:
অ্যাকশন কমেডি ড্রামা
গল্প ও পরিচালনা: রাজা চন্দ
প্রযোজনা: জাজ মাল্টিমিডিয়া
অভিনয়: জিয়াউল রোশান (রুবেল), ইয়ামিন হক ববি (কিরণ), পিয়ান সরকার (রুবি), ইয়ামিন হক ববি (কিরণ), তারিক আনাম খান (আফজাল সিনহা), খালেদ হোসেন সুজন (আরিয়ান সিনহা), নানা শাহ (ইন্সপেক্টর আকবর), কাজী হায়াৎ (রুবেলের বাবা), রেবেকা রউফ (রুবেলের মা), নিমা রহমান (আফজাল সিনহা’র স্ত্রী), শহীদুল আলম সাচ্চু (মানিক/রতন), শিবা শানু (কিরণের বাবা), চিকন আলী (রুবেলের বন্ধু), কমল পাটেকার (কমল), সোহেল খান, মতিন রহমান, আমিন সরকার প্রমুখ।
মুক্তি: ২২ আগস্ট ২০১৮ (সীমিত); ১২ আগস্ট, ২০১৯ (বড় পরিসরে)

নামকরণ: এ এক বেপরোয়া হিরোর গল্প, যে তার পরিবারের সদস্যদের সুখে রাখার জন্য সবকিছু করতে পারে। সে তার বোনের স্বপ্ন পুরণ করতে চায়, বাবাকে খুশি রাখতে চায়, মায়ের আশা ভরসার প্রতীক হতে চায়। দুনিয়ার কোনো বিপদকে পরোয়া করে না। এরকম একটি গল্পের জন্য এমন নামই মানানসই। তাই ‘বেপরোয়া- ফ্যামিলি ফার্স্ট’ নামটি গল্প অনুসারে শতভাগ যথার্থ।

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ:  ছবিটি ভারতের শ্রীনু ভাইটলা পরিচালিত ২০১৫ সালের তেলেগু সিনেমা ‘ব্রুস লি- দ্য ফাইটার’ এর অফিসিয়াল রিমেক। মূল ছবির কাহিনীর সাথে সম্পূর্ণ মিল রেখেই নির্মাণ করা হয়েছে। চিত্রনাট্যও হুবহু একই, শুধু গান ও শেষের ক্লাইম্যাক্সটি পরিবর্তন করা হয়েছে। তেলেগু সিনেমার মূল গল্পটি ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন জায়গায় দুর্বল ছিল, সেই দুর্বলতা এ ছবিতেও বিদ্যমান।

চিত্রনাট্যের বদৌলতে সিনেমাতে বেশকিছু অলৌকিক(!) বিষয়াদি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন; এসএসসি/এইচএসসি পাশ না করেই বিসিএস প্রিলিমিনারিতে টিকে যাওয়া, বাবা হয়ে নিজের ছেলেকে চিনতে না পারা, মাদক সেবন করেও সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসা ও স্বাভাবিক আচরণ করা, শেষ ক্লাইম্যাক্সে নায়ক নিজে মাথায় না খেয়ে বুকেই গুলি খাবে এমনটা আন্দাজ করে ফেলা ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এগুলোকে সিনেমার প্রথমার্ধে বেশ বুদ্ধিমত্তা ও রঙ্গ-তামাশার সাথে স্থাপন করা হয়েছে বিধায় কমেডির সফট টাচে উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

পুরো সিনেমাতে তেমন কোনো সাসপেন্স রাখা হয়নি, গল্প সম্পূর্ণ সমতল। এই দুর্বলতাগুলোকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ‘কমেডি অফ এরর’ থেরাপি ব্যবহার করে। যত যাই হোক, এটি একটি পরীক্ষিত নিরাপদ থেরাপি দর্শক এন্টারটেইন করার জন্য।

সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে যথেষ্ট হিরোইজম থাকায় ভালো কিছু ডায়লগ পাওয়া যায়, যা অপরপ্রান্তে থাকা খলনায়কদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার আগে দর্শকমনে শিহরণ জাগায়। কমার্শিয়াল ছবি হিসেবে যেমন সংলাপ হওয়া উচিত ঠিক তেমন পরিমিতি পাওয়া যায়।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৩০।

অভিনয় ও পরিচালনা: রোশানের সবমিলিয়ে এটি চতুর্থ ছবি। তবে এবারই প্রথম তিনি একা কেন্দ্রীয় চরিত্র সামলানোর দায়িত্ব পেয়েছেন। শুধু সামলিয়েছেন বললে কম বলা হবে, রীতিমতো পয়সা উসুল পারফরমেন্স দিয়েছেন! তার নায়কোচিত গলা সিনেমায় থাকা পাঞ্চলাইনগুলোতে ভালো শান দিয়েছে। তার ফিটনেস এবং এগ্রেসিভ অ্যাটিচিউট যেকোনো শ্রেণির দর্শকের ভালো লাগার জন্য যথেষ্ট। নাচের মুদ্রাতেও ভালো পারদর্শী তিনি। সিনেমাতে ইমোশনাল সিনের তেমন একটা গুরুত্ব নেই, তবুও মনে হলো এই জায়গা নিয়ে রোশান আরেকটু কাজ করলে ভবিষ্যতে আরো বেটার পারফরমেন্স উপহার দিতে পারবেন। তার মধ্যে ব্যাপক সম্ভাবনা আছে ভবিষ্যতে দারুণ কিছু করে দেখানোর।

‘বেপরোয়া’ দর্শকদের এক নতুন জুটি উপহার দিয়েছে – রোশান-ববি। হ্যান্ডসাম রোশানের সাথে গ্ল্যামারাস ববিকে মানানসই লেগেছে। তাদের রোম্যাঞ্চ এবং সুন্দর মুহূর্তগুলো বেশ ভালোভাবে ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে। এমনিতে কিরণ চরিত্রে ইয়ামিন হক ববির সিনেমার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা ব্যতীত অতিরিক্ত কিছু করার ছিল না। তিনি সেই কাজটি ভালোভাবে করেছেন।

রুবি চরিত্রে ভারতের পিয়ান সরকার মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন। তার ও রোশানের মধ্যকার ভাই-বোনের কেমিস্ট্রি, হাসি-কান্না বেশ উপভোগ করার মতো।

খলনায়কদের মধ্যে আরিয়ান চরিত্রে খালেদ হোসেন সুজনকে দেখে চমকে গেছি। তার রাফ এন্ড টাফ লুক দেখে প্রথমে ভারতের অভিনেতা ভেবেছিলাম। ফেসবুকের বদৌলতে তার আসল পরিচয় জানলাম। তার চরিত্রের গুরুত্ব কিছুটা কম বলা যায়, তবে ভিলেন হিসেবে তার লুক ও বডি ফিটনেস যথেষ্ট। ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর হাত ধরে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে স্মার্ট ভিলেনের একটা জেনারেশন শুরু হয়েছে, খালেদ হোসেন সুজনের অভিনয় আরেকটু শানিত করে ভবিষ্যতে ভালোভালো  নেতিবাচক চরিত্রে কাজে লাগালে তিনি ভালো প্রতিদান দিতে পারবেন আশা করি। পাশাপাশি আমরা আরো একজন স্মার্ট ভিলেন পাবো।

এছাড়া শিবা শানুকে এছবিতে পজেটিভ কোনো চরিত্রে পেলাম, সাধারণত তাকে নেতিবাচক চরিত্র রূপদান করতে বেশি দেখা যায়। মোটামুটি ভালো কাজ করেছেন।

তারিক আনাম খান, নিমা রহমান, রেবেকা রঊফ, কমল পাটেকার এরা সবাই যার যার চরিত্রে মোটামুটি ছিলেন। কাজী হায়াৎ বরাবরের মতো এবারও সংলাপ দেওয়ায় স্লো। এগুলো নিয়ে আর বলতে বলতে খোদ নিজেও ক্লান্ত, কিন্তু তার সংলাপ আওড়ানোতে কোনো পরিবর্তন নেই। এছাড়া নানা শাহকে অনেক দিন পর বড়পর্দায় দেখলাম। এছবিতে তিনি নেতিবাচক চরিত্রে ছিলেন, মোটামুটি সন্তোষজনক পারফরমেন্স দিয়েছেন।

পুরো ছবিতে হাসানোর দায়িত্ব প্রায় একা কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছেন শহীদুল আলম সাচ্চু। দ্বৈত চরিত্রে তিনি বেশ চমক জাগানিয়া পারফরমেন্স দিয়েছেন। পক্ষান্তরে চিকন আলীসহ অন্যান্য যারা ছিলেন তারা হাসানো তো দুর, ওভারএ্যাকটিংটাও ঠিকভাবে করতে পারেননি।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৫০।

পরিচালনা: রাজা চন্দ টালিগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত একজন পরিচালক। সেখানে তার মতো আরো কিছু নির্মাতা আছেন যারা রিমেক মুভি বানাতে ওস্তাদ! তারা মৌলিক কাজ যতটা সুন্দর করতে পারেন তার থেকে ভালো কাজ করতে পারেন দেখে দেখে। অতীতে রাজা চন্দ টালিগঞ্জে দেব-জিত-সোহমদের নিয়ে বেশকিছু সুপারহিট রিমেক ছবি উপহার দিয়েছেন। এ ছবিতে পরিচালনা ও চিত্রনাট্য সাজানোর পাশাপাশি তিনটি গানও লিখেছেন।

‘বেপরোয়া’ ছবির ডিরেকশন মোটামুটি মানের গতানুগতিকই, আর দশটা ছবিতে যেমন দেন আরকি। পুরো ছবি ফ্রেম টু ফ্রেম বসানো তাই এখানে ওনার ডিরেকশন নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই; নতুন নায়কের ডেডিকেশনকে কাজে লাগিয়ে তার কাছ থেকে সর্বোচ্চটা বের করে আনতে পেরেছেন, এই ক্রেডিটটাই শুধুমাত্র ওনাকে দেওয়া যায়।

কারিগরি: জাজ মাল্টিমিডিয়া বরাবরই টেকনিক্যাল দিক থেকে দেশসেরা প্রডাকশন কোম্পানি, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তারা টেকনিক্যাল দিক দিয়ে প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করার চেষ্টা করছে, যা দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় না।

ক্যামেরাওয়ার্ক এককথায় দূর্দান্ত। সাইফুল শাহীনের কাজ দেখে মনে হলো তিনি ক্যামেরা নিয়ে রীতিমতো খেলা করেছেন! বাজে সিনেমাটোগ্রাফির কারণে বাংলা ছবির মারামারি জমে না, এমন অভিযোগ বরাবরই শোনা যায়। কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে এ অভিযোগ তোলার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। ভালো ক্যামেরাওয়ার্কের সাথে ভালো কোরিওগ্রাফি অ্যাকশন সিনগুলোকে দুর্দান্ত রূপ দিয়েছে।

টালিগঞ্জের অভিজ্ঞ মোহাম্মাদ কালামের হাতে সিনেমার এডিটিংটা ঠিকঠাকভাবে হয়েছে। কালার গ্রেডিং নিয়েও কোনো সমস্যা নেই। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তেলেগু ভার্সনে যেমন ছিল এখানেও তেমন। সিনেমায় কস্টিউম ডিজাইন বেশ ভালো। রামুজি ফিল্ম সিটির লোকেশনগুলো বেশ রিয়েলিস্টিক লেগেছে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৮০।

বিনোদন: ছবিতে গান রয়েছে ৪টি। এর মধ্যে কোনো গানই পরিপূর্ণভাবে ভালো লাগেনি। তুলনামূলকভাবে কনার গাওয়া ‘ঘুম ঘুম আদরে’ গানটি ভালো। এ ছাড়া ইমরানের গাওয়া ‘তুমি বললে’ সুন্দর, মিউজিক দিয়েছেন মুশফিক লিটু ও লিরিক্স লিখেছেন এসকে দীপ। ভারতের শত্রুজিতের গাওয়া টাইটেল ট্র্যাকের মিউজিক কিছুটা হিন্দি ছবি ‘গোলমাল এগেইন’-এর টাইটেলের সাথে মিলে যায়, কোরিওগ্রাফিতেও টুকিটাকি মিল আছে। এছাড়া ভারতের শান ও কনার গাওয়া ‘খাঁটি সোনা’ গানে পুরোনো জনপ্রিয় গানের লাইন ক্রসওভার করা হয়েছে, নতুন কম্পোজ করা গানটি মোটেও ভালো লাগেনি, তবে হলে দর্শকদের অনেক উল্লাস করতে দেখলাম। ‘তুমি বললে’ গানটি বাদে বাকি তিন গানে সবগুলোর মিউজিক দিয়েছেন ভারতের ডাব্বু, লিরিক্স লিখেছেন রাজা চন্দ। গানগুলোর কোরিওগ্রাফি মোটামুটি চলনসই হয়েছে, টাইটেল ট্র্যাকের ডান্স কোরিওগ্রাফি এককথায় দারুণ! রোশানসহ পুরো ডান্স টিম দুর্দান্ত নেচেছে।

এ সিনেমার প্রথমার্ধে কমেডি, অ্যাকশন, রোম্যান্স এবং ড্রামার হালকা ছোঁয়ায় পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। শুরু থেকে শেষ অবধি নিখাদ বিনোদন দিয়ে দর্শককে আঁকড়ে রাখবে। কখন যে এগুলোর মিশেলে ছবির প্রথমার্ধ শেষ হয়ে যায় তার টেরই পাওয়া যায় না।

দ্বিতৗয়ার্ধে দূর্বল চিত্রনাট্যের সাথে বাজে অভিনয়ের মিশেলে গল্পে কিছুটা ছাড়াছাড়া ভাব এসে পড়ে। তবে দুর্দান্ত অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি সেই দূর্বলতাকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে। বাংলা সিনেমায় এর আগে এতটা ফাস্ট অ্যাকশন-কোরিওগ্রাফি খুবই নগন্য সিনেমায় দেখেছি।

কমেডির দায়িত্ব যাদের ওপর দেওয়া হয়েছিল তারা যদি ভালো পারফরমেন্স দিতে পারতেন তবে সিনেমাটি আরো বেশি উপভোগ্য হতো। ভাই-বোনের মধ্যকার অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখানো হয়েছে। পিঠাপিঠি ভাইবোনদের মধ্যে যে মিষ্টি মধুর খুনসুটি চলে সেরকম কিছু সিক্যুয়েন্স রাখা হয়েছে, ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।

ব্যক্তিগত: অনেক ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে বহুল প্রতীক্ষার পর ‘বেপরোয়া’ অবশেষে মুক্তি পেলো। দীর্ঘ একবছর ধরে এ ছবি যতটা ঝামেলা পার করে এসেছে তাতে মনে হয়েছে এর ওপর শনির দশা ভর করেছে।

সবমিলিয়ে বলবো, দূর্বল গল্পের হলেও ‘বেপরোয়া’ যথেষ্ট উপভোগ্য। পারফেক্ট ফ্যামিলি এন্টারটেইনার বলা যেতো যদি কমেডিতে দূর্বলতা না থাকতো।

রেটিং: ৬/১০

ছবিটি কেন দেখবেন: বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেখতে পারবেন, আবার পরিবার নিয়েও দেখতে পারবেন। আড়াই ঘণ্টা হইহুল্লোড় করে দেখার মতো ছবি এটি। মাস অডিয়েন্সের জন্য উপযুক্ত বলা যায়। এ ছবি উপভোগ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই মস্তিষ্ক বাড়িতে ফেলে আসতে হবে, অন্যথায় যুক্তিবিজ্ঞানের দোলাচলে দুলতে থাকবেন।


মন্তব্য করুন