Select Page

নদীপথে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক!

নদীপথে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক!

কমলা রকেট
ধরণ : ড্রামা
পরিচালক : নূর ইমরান মিঠু
কাস্ট : তৌকীর আহমেদ (আতিক), মোশাররফ করিম (মফিজুর), জয়রাজ (মনসুর), ডমিনিক গোমেজ (গাড়ি ব্যবসায়ী), সামিয়া সাঈদ (নিশি), ফারিয়া শামস্ সেঁওতি (নিশির বড় বোন), সুজাত শিমুল, বাপ্পা শান্তনু প্রমূখ।

নামকরণ : অনেক আগে থেকেই দক্ষিণবঙ্গের নদিপথে এক বিশেষ ধরনের স্টিমার চলাচল করে; যেগুলো সদরঘাট হতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাত্রী আনা-নেওয়া করে। উপর থেকে দেখলে এর আকার কিছুটা রকেটের মতো হওয়ায় এগুলোকে ‘রকেট স্টিমার’ বলা হয়। এরকমই একটি কমলা রংয়ের স্টিমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন টাইপের লোকের যাতায়াতের সময় সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়েই এ ছবির গল্প।

তাই বলা যায়, ‘কমলা রকেট’ নামটি মূল থিম অনুসারে যথার্থ।

কা.চি.স (কাহিনী+ চিত্রনাট্য+ সংলাপ) : কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের দুটি ছোটগল্প; ‘মৌলিক’ এবং ‘সাইপ্রাস’কে এক করে বানানো হয়েছে ‘কমলা রকেট’। ঢাকা থেকে মংলা যাত্রাপথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়েই সাজানো হয়েছে চিত্রনাট্য। গল্পের থিম বিবেচনায় এটি খুবই চমৎকার। পরিচালক যতটুকু সম্ভব সহজ-সরল করে গল্পটিকে পর্দায় তুলে ধরেছেন।

স্ক্রিনপ্লের কিছু জায়গায় একটু খুঁত নজরে পড়েছে, সেগুলো সম্পর্কে এই রিভিউয়ের ‘ব্যক্তিগত’ অংশে আলোচনা করা হয়েছে। তবে যেহেতু এটি পরিচালক নূর ইমরান মিঠুর প্রথম কাজ, এসব ছোট ছোট ভুল ক্ষমার যোগ্য। ছবির স্ক্রিনপ্লে কিছুটা স্লো ছিল।

ডায়লগ বেশ সহজ-সরল ভাষায় লেখা হয়েছে। অতিরঞ্জিত কোনো ডায়লগ  ছিল না। সেই ডায়লগগুলো স্বাভাবিকভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭৫।

টিমওয়ার্ক : এ ছবিতে অনেক গুলো ক্যারেক্টারকে একসাথে পর্দায় আনা হয়েছে। তবে গল্পের প্রয়োজনে  ৯টি বিশেষ ক্যারেক্টারকে একটু বেশি হাইলাইট করা হয়েছে। একে একে আলোচনা করা যাক।

মেইন ক্যারেক্টার, অর্থাৎ যাদের নিয়ে গল্প আবির্ভূত হয়েছে তার একটি হলো তৌকীর আহমেদের। অনেকদিন পর এই গুণী পরিচালকের অভিনয় বড়পর্দায় দেখলাম; যদিও তিনি ছোটপর্দায় পরিচালক অপেক্ষা অভিনেতা হিসেবেই অধিক সমাদৃত। একজন লোভী কারখানার মালিকের চরিত্রে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। যে গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে ক্যারেক্টারটি প্লে করে গেছেন তা এককথায় অসাধারণ। সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে তার বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ। ডিজিটাল যুগে আসা অনেক অভিনেতাকেই এদিক থেকে পিছিয়ে থাকতে দেখা যায়। ক্যারেক্টার প্লের সময় বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করতে পারাটা ঐ ক্যারেক্টারে ইনভলভ হতে অনেক বেশি ভুমিকা পালন করে।

একজন নিম্নবিত্তের চরিত্রে জয়রাজের চেহারার অসহায় এক্সপেশনগুলো ছিল দূর্দান্ত। পুরো ছবিতেই মলিন চেহারায় করা তার অভিনয় বেশ ভালো লেগেছে। তবে তার কান্নার সিনগুলোতে দূর্বলতা ছিল। কিছুটা মেকি মনে হয়েছে।

কার বিজনেসম্যানের চরিত্রে অভিনয় করা ডমিনিক গোমেজে কিছুটা ওভার অ্যাকটিং নজরে লেগেছে। এছাড়া তার ডায়লগ ডেলিভরিতে সাবলীলতা খুঁজে পাইনি। একটি সিনে তার ও তৌকীর আহমেদের মধ্যে কথোপকথন দেখানো হয়,ঐ ক্লাইম্যাক্সটুকু উপভোগ্য ছিল।

তার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করা ফারিয়া শামস্ সেঁওতি মোটামুটি ভালো করেছেন। শহরের পরিবারগুলোয় একটি ছোট শিশুর লেখাপড়ার প্রতি কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করা তা এই ক্যারেক্টারের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।

সামিয়া সাঈদের অভিনয় ভালো লেগেছে; স্পেশালি তার গ্রে শেডের ক্যারেক্টারটি যখন প্লে করেছেন। পরিচালক এদিক থেকে তার মাধ্যমে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দেখিয়েছেন বলা যায়।

সুজাত শিমুল, বাপ্পা শান্তনুসহ আরো যারা ছোট-ছোট ক্যারেক্টার প্লে করেছেন সবাই মোটামুটি ভালো করেছেন। কলেজ লাইফে লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকা বন্ধু, কিংবা দুঃসময়ে একসাথে দিন-রাত এক করে দেওয়া বন্ধু যখন একটি ভালো পজিশনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে; তখন নিজেকে কতটা অসহায় লাগে—  তা কিছু ক্যারেক্টারের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।

কিন্তু, সবকিছু ছাপিয়ে এ গল্পের প্রাণভোমরা হলেন মোশাররফ করিম। তার ক্যারেক্টারটিই অত্যন্ত চমকপ্রদ ও মজাদার। আর তার অভিনয় নিয়ে তো কিছু বলার নেই। বিগত ২০১৫ সাল হতে তার অভিনীত  ছবিগুলো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়ে আসছে। এককথায় অসাধারণ ছিল তার অভিনয়। আমাদের দেশে এই ক্যারেক্টারে ওনার বিকল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। আপাতত আমার মাথাতেও কারো নাম আসছে না যিনি এই ক্যারেক্টারটি ওনার তুলনায় বেটার ভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন। তার গেটআপ হতে শুরু এক্সপ্রেশন-অঙ্গভঙ্গি সবই পারফেক্ট ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তার ক্যারেক্টারে অনেকগুলো শেড ছিল। বেকার যুবকদের সাথে বড় ভাইয়ের মতো; তৌকীর আহমেদের সাথে মনিব-গোলামের মতো। বিয়ে না হওয়া যুবকের সাথে যেমন হাস্যরসে মেতে ছিলেন, ঠিক তেমনি স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া আত্মীয়ের সাথে ইমোশনালি এ্যাটাচড্ হয়েছিলেন। তার ক্যারেক্টারটিই মূলত ছবির সব আলাদা চরিত্রগুলোকে এক সুতোয় গেথেছে; সবার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭৫

কারিগরি : সিনেমাটোগ্রাফি ঠিকঠাক ছিল। নদীর বুক চিরে যখন রকেট স্টিমার এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনকার শটগুলো খুব সুন্দর হয়েছে। সেটের লাইটিং একদম জোশ হয়েছে। অভারঅল লোকেশন এবং লাইটিং এর মাধ্যমে পরিচালক রিয়েলিস্টিক ভাব রাখতে চেয়েছেন; আর এক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন।

ছবিতে কোনো VFX এর কাজ নেই। এডিটিং মোটামুটি ভালোই হয়েছে। একটি অংশে যখন সার্কাস দেখানো হয় তখন কিছু রিয়েল সার্কাস দলে কাজ করা কর্মীদের দেখতে পাই। এটা খুবই ভালো লেগেছে।

ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক খুব একটা ভালো লাগেনি, সে তুলনায় সাউন্ড মিক্সিং ভালো। স্টিমারে রাখা মরদেহ যখন পচতে শুরু করে তখনকার সাউন্ড মিক্সিং এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করে। তবে স্টিমার যখন চরে আটকায় সেই সময়কার সিনগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখানো হয়নি। এটা নিয়ে ভাবতাম না, কিন্তু তারা এর আগে যখন স্টিমার কুয়াশায় আটকে যায় তখনকার শটগুলো এতোটাই রিয়েলিস্টিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন; চরে আটকানোর সিনগুলো ভালোভাবে না দেখতে পেয়ে খুব আফসোস হয়েছে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭৫।

বিনোদন : আর্ট ফিল্মের ক্ষেত্রে বিনোদন অপেক্ষা গল্প এবং অভিনয়ই বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এছবিতে বিনোদনের অভাব ছিল। ছবির গল্পটি একটি নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে গেছে। কোনোরকম টুইস্ট ছিল না, সাসপেন্স ছিল না। সবগুলো ক্যারেক্টারকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে মফিজের মাধ্যমে; কিন্তু ক্যারেক্টারগুলোকে বাছ-বিচার করা হয়েছে শুধুমাত্র আতিকের দৃষ্টিতে।

গান রয়েছে ২টি; কোনোটিই তেমন ভালো লাগেনি। মোমবাতি গানটার সঙ্গীতায়োজন ভালো হলেও সিচ্যুয়েশন অনুসারে এই টাইপ গান ওখানে ঠিক যায় না। এমন গান এই ছবিতে ব্যবহার না করলেই ভালো হতো।

তবে মোশাররফ করিম যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন ঠিক ততক্ষণই বিনোদিত হয়েছি। এই ক্যারেক্টার শুরু থেকেই কিছুটা কনফিউজিং ছিল, যার কারণে দর্শক এই পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ বুঝতেই বেশি সময়ক্ষেপণ করে। যদিও শেষ ক্লাইম্যাক্সে সবকিছু ক্লিয়ার হয়; স্পেশালি ছবির একদম শেষ দৃশ্যে।

এ অংশ পাবে ১০০ এ ৩৫।

ব্যক্তিগত : ছবির গল্প একটা স্টিমার জার্নি নিয়ে। জার্নি হবে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গে। এই কারণ ছাড়া এ ছবি নিয়ে আমার এক্সট্রা কোনো আগ্রহ ছিল না। কারণ, আমার বাড়িও দক্ষিণবঙ্গে। ছবির স্ক্রিনপ্লে ছিল কিছুটা ধীরগতির। কিছু ছোট ছোট অসংগতিও ছিল! অবশ্য এগুলোকে ভুল হিসেবে ধরাও যায়, আবার এড়িয়েও যাওয়া যায়।

ছবির একটি দৃশ্যে দেখানো হয় এক ছিনতাইকারী স্টিমারের ডেক থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে লাফ দেয়। বস্তুত, আমি স্টিমারে চুরি-ছিনতাই দেখেছি। কপাল দোষে ডাকাতি দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর টেকনিক ছিল আরো দূর্দান্ত। আপনি বুঝতে পারবেন না আপনি কীভাবে তাদের ট্র্যাপে ফেঁসে যাচ্ছেন। এখানে বিষয়টা কিছুটা লেইম আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আচ্ছা, ধরলাম ছেলেটা বাস্তবেই এটা করলো।  নদীর পানি খাওয়ার পর ঐ মোবাইল কী আর চলবে? ওয়াটারপ্রুফ তো ছিল না…

স্টিমার চলার সময় দুপুরের একটা টাইমে দেখানো হয় আতিকের ফোনে সময় হলো প্রায় ২টা ৪৫ মিনিট। বাইরে তখন রোদ উঠেছে। এরপর স্টিমার আটকালো চরে। আকাশে তখনো রোদ। সাধারণত এই রকম টাইমে আর এই রকম সিচ্যুয়েশনে স্টিমার কখনোই চরে আটকায় না। হ্যাঁ, যদি অলৌকিক ভাবে আটকে যায়ও, তাহলে স্টিমারের লোকজন চেষ্টা করে যতদ্রুত সম্ভব; (সন্ধ্যা হওয়ার আগে) দরকার হলে সামনে থেকে চর কেটে সরিয়ে স্টিমারকে কোনোমতে ডুবোচর থেকে বের হওয়ার রাস্তা করে দেওয়া। কিন্তু এখানে আমরা সেরকম কোনো প্রচেষ্টাই দেখতে পাইনি। চরে আটকানোর পর স্টিমারে লোকজন কী করলো সেটাও দেখানো হয়নি; উল্টো সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল এই ভেবে যে, রাতে তারা কী খাবে… আর কীভাবে ডাল-ভাত দিয়ে ধান্ধা করবে।

স্টিমারে আমি কখনো সার্কার দলকে খেলা দেখাতে দেখিনি। তবে এটুকু জানি স্টিমারে আগুন নিয়ে খেলা করা নিষিদ্ধ। একজন-দুইজন না, একসাথে প্রায় হাজার মানুষ যাতায়াত করে এক স্টিমারে। এই আগুনের রিস্ক স্বভাবতই কর্তৃপক্ষ নেয় না।

পরিচালকের প্রথম কাজ, তাই এই ভুলগুলো ক্ষমা করে দেওয়াই যায়, কিন্তু যিনি স্ক্রিনপ্লে লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন তার উচিত ছিল এসব অসংগতির দিকে খেয়াল রাখা।

রেটিং : ৩.৫/৫

ছবিটি কেন দেখবেন : এ ছবিতে আমাদের সমাজ বাস্তবতাকে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লোকাল বিজনেসম্যানরা চাচ্ছেন তাদের ব্যবসা বড় করে বিদেশে সেটেল হতে; মাল্টিপল বিজনেসম্যানেরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। মেধাবীরা ভালো জায়গায় সুযোগ পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যারা পরিশ্রমী তারা কিছুই করতে পারছে না। উল্টো মেধাহীনেরা ঘুষের মাধ্যমে তাদের নিজ স্বপ্ন গড়ে নিচ্ছে। তরুণরা চায় দেশের জন্যে কিছু করতে, কিন্তু তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়ই কনফিউজড। আবার যদি তারা দেশের বাইরে পড়ার সুযোগ পায়, তবে তারা আর দেশের নাম মুখে নেয় না। মাতৃভূমিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখায়।

এসব ফ্যাক্ট গল্পের মাধ্যমে যদি আপনি দেখতে চান, বুঝতে চান, উপলব্ধি করতে চান, এছবি আপনার জন্য। এ ছাড়া যদি ভালো কনসেপ্টের আর্ট ফিল্ম দেখতে ভালো লাগে, তবে এ ছবি আপনার জন্য!


মন্তব্য করুন