Select Page

বাংলাদেশী সিনেমায় ‘অন্যদিন…’

বাংলাদেশী সিনেমায় ‘অন্যদিন…’

বিশেষণ বিষয়টা খানিকটা অদ্ভুতই। হয়তো তত ভাবনা-চিন্তা থাকে না, তা সত্ত্বেও লহমায় বক্তার কল্পনার সীমাটা ধরিয়ে দেয়। প্রথমে মনে হচ্ছিল, ‘এটা অবিশ্বাস্য’; কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ‘অন্যদিন…’ দেখে। কিন্তু পর মুহূর্তে ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটা বাতিল করলাম। কারণ হিসেবে মনে হইলো, একটা অনুমিত বাস্তবতার জায়গা থেকে এমনটা ভাবা গেলেও কোনো শিল্পকে দেখার মধ্যে ঝামেলা আছে। যদিও আমাদের দেখা বা ভাবার পরিপার্শ্ব আগাম কিছু শর্ত নির্ভর যে নয় তাও নয়।

মানুষের সৃজনশীলতায় একটা গায়েবি ব্যাপার আছে। যেটা জাহের হওয়ার মাধ্যমে তার গুণাগুণরে হাজির করে। যেকোনো ঘটনার বর্ণনার মধ্যেও একটা মূল্যায়ন থাকে। মূল্যায়ন ব্যতিরেকে বর্ণনা থাকে কই! আমাদের তো ঠিক করে নিতে হয় বর্ণনার মধ্যে কোন কোন বিষয়রে আগায়া রাখবো। তো, পূর্বানুমানজনিত এ ‘অবিশ্বাস্য’ হওয়ার মাঝে সে বর্ণনাগুণের একটা বুনট আছে। ‘অন্যদিন…’ প্রসঙ্গে মূল অবতারণায় না পৌঁছে এত কথা বলার মাধ্যমে একটা পরিস্থিতি হয়তো অস্পষ্টভাবে তুলে ধরা গেল। যেমন; একটা সিনেমা একজন দর্শককে কীভাবে ভাবতে প্রেরণা দিল। হয়তো বাকি কথাও সামান্য। যথাযথ কারণেই।

যাই হোক, একটা রিভিউতে সিনেমাকে যতটা অপ্রকাশ্য করে বলা যায়, ততটা বোধহয় চমক থাকে। যদিও গল্প বলার চল যে খুব একটা অসুবিধাজনক তাও না। কারণ গল্পই যদি সিনেমা হতো, তবে গল্পই থাকত, সিনেমা না। এর উদাহরণ ‘অন্যদিন’। তারপরও বলা বা না বলার ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে যাওয়ারে কখনো কখনো সুবিধাজনকই লাগে।

‘অন্যদিন…’ কামারের ওয়াটার ট্রিলজির দ্বিতীয় সিনেমা। প্রথমটা ছিল ‘শুনতে কি পাও!’ (২০১২), ফিকশন-নন ফিকশন বাইনারির বাইরে হাইব্রিড ধারার এ সিনেমা দেশের প্রেক্ষাগৃহে লম্বা সময় ধরে প্রদর্শিত হয়ে খানিকটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সেই বিস্ময়রে স্বাভাবিক করে তোলার মতো সিনেমা তো বাংলাদেশে আর হইলো না। এটা অর্থে যে, শুধু ফিকশনই প্রদর্শনব্যবস্থা অংশীদার হবে এমন না। আবার এটাও ব্যাপার যে, জনরা আকারে খোদ বাংলাদেশে ফিকশনেও বৈচিত্র্য নাই। তো, হাইব্রিড ধারার ‘অন্যদিন’ এরই মধ্যে নামি সব উৎসবে প্রদর্শিত হয়ে আসছে। ফলত প্রেক্ষাগৃহে লম্বা সময় ধরে চলতে পারে, এমন একটা স্বপ্ন দেখা যায়! বাংলাদেশের প্রদর্শন ব্যবস্থাও আরেকটু সাবালক হইলো।

‘অন্যদিন…’-এর গল্প আগাইছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই বাংলাদেশের আমলের ৫০ বছর পরও টিকে থাকা জলযানের গল্পে। এটা স্রেফ স্টিমার না। হয়তো বাংলাদেশের একটা রিপ্রেজেন্টেশন। ফলত নদী এর ধাবমান বাস্তবতার লগে অ্যাক্ট করে। এই স্টিমারটা নদীরে শাসন করছে। পুরো সিনেমায় সংশ্লিষ্ট আবহ হিসাবে দু-একবার বা কয়েকবার নদীর তীর বা স্টিমারের বহির্দৃশ্যের দেখা যায়। ফলে এ সিনেমায় নদীমাতৃক বাংলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভাবালুতা দেখার উপায় নাই। যতটুকু আছে নদীর বিষাক্ত পানি, দূষণ বা দখলের দৃশ্য। যে বিষাক্ত আবহের মাঝে বাংলাদেশ থাকে আরকি! আর যেটুকু সৌন্দর্য হয়ে দ্যুতি ছড়াতে পারতো, তা স্রেফ কুয়াশার মাঝে গায়েব থাকে। যেমন বাংলাদেশের যাবতীয় সম্ভাবনা এখন কুয়াশাময়। সব মিলিয়ে নদী এখানে স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তিরই বিষয়। এটা একটা ব্যতিক্রম ঘটনা।

বাংলাদেশে শিক্ষিত নির্মাতাদের ফুল-পাতা বা কৃত্রিম পরিচয়বাদী বা ধর্মগন্ধী শত্রু খোঁজার ভিড়ে ‘অন্যদিন…’ একটা ঘুণপোকা। তথাকথিত শত্রুতা-বন্ধুত্বের রিসতার মধ্যে নাই, বরং বিপুল জনগণ যাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বা বাসনারে গায়েব করে দেয়া হচ্ছে, তারে আমরা দেখি। এ সিনেমায় কিছু চরিত্র সিনেমার মধ্যেই বাহাস করে যে, এভাবে— এটা কেমন সিনেমা নায়ক-নায়িকা-ভিলেন নাই। কিছু লোক খালি সবাইরে ভিডিও করছে। বাংলাদেশ তো আজ এমন পরিস্থিতি যেখানে বেশির ভাগ লোকই যেন ট্র্যাজেডির ক্যারেক্টার প্লে করে যাচ্ছে। আর যারা ভিলেন তারা আছে জেনেও ভিলেন আকারে লোকেট করা যাচ্ছে না। মানে পরিস্থিতি এখন জায়গায় গড়াইছে। তো, ‘অন্যদিন’ মূলত আমজনতার গল্প, তাদেরই হিরো হওয়ারই গল্প। তাদের কথা, যে কথা হয়তো বইয়ে থাকে না, টিভিতে দেখা যায় না। কী সহজ, কী উদ্দীপনাময় ও বৈপ্লবিক।

এ ছবিতে মজা পাওয়ার মতো অনেক দৃশ্য আছে। কিন্তু তাতেও দর্শক কোনো রিলিফ পাওয়ার সুযোগ পায় নাই। মানুষ আর মানুষ। তাদের বিচিত্রসব সমস্যা, তার অন্তরালে একটা রাষ্ট্র ও তার নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্তভাবে দমবন্ধ হয়ে থাকা মানুষগুলোর হাঁসফাঁস দেখি।

শিল্পের তো অনেক ধারা আছে। সেখানে সুবিধাজনক পরিস্থিতিও থাকে। এখানে হলো কী— কামার আহমাদ সাইমন বিমূর্ত থাকা বা বুদ্ধিদীপ্ত ইঙ্গিত দেয়ার সুযোগ খুব একটা নেন নাই মনে হয়। কারণ বাংলাদেশে যে দমবন্ধ অবস্থা বিরাজ করছে, পর্দায় তারে শুধু ইশারার মধ্যে দেখানোর সুযোগ নাই বলে ভাবা যাইতে পারে। বা সে অবস্থা যার মাধ্যমে আসলে এক ধরনের সাবধানবানী দেয়া যায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে— আমরা বোধহয় সেই সময় পার করে আসছি। কারণ, জনগণের দুঃখ-কষ্ট বা হতাশা এখন ক্ষমতাসীনদের কাছে হাসি-ঠাট্টা হয়ে উঠে সময়ে সময়ে। এ পরিস্থিতিতে হয় আপনি মুখ খুলবেন, নয় তো আপনি চুপ থাকবেন। অন্যও পথ থাকতে পারে। নির্মাতা হিসেবে মুখ খোলার দায়িত্বটাই নিয়েছেন সাইমন। এটা সাহসের বিষয় না। আত্মমর্যাদা ও গৌরবের, এই প্রকাশে যে সততা তাকে সম্মান দেখাতেই হয়। এ হিসেবে বাংলাদেশের সিনেমায় ‘অন্যদিন’ আসলেই একটা ‘অন্যদিন’। গল্প, নির্মাণ, প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার দরকার তো আছে। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলা যায়, ‘অন্যদিন…’ এমন এক সিনেমা, যারে এখনো আমাদের দেখা হয় নাই। আর দেখা হবে তো?


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বিএমডিবির সহপ্রতিষ্ঠাতা

মন্তব্য করুন