বিরল নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন
বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি অতীত বলতে যে সময়কালকে বোঝানো হয় সে সময়ের অন্যতম সফল কারিগর শহীদুল ইসলাম খোকন।
মৌলিক গল্প, নিত্যনতুন অ্যাকশন, অজানা সব মার্শাল আর্ট ও কুংফু, প্রাণবন্ত কমেডি, টান টান উত্তেজনায় ঠাসা কাহিনি আর মিষ্টি মধুর গানে তার সিনেমায় দর্শকেরা ডুবে থাকতো পুরো আড়াই ঘণ্টা।
শুধু আড়াই ঘণ্টা নয়, ছবি শেষ হওয়ার পর তার রেশ থেকে যেতো বহুক্ষণ।
প্রেক্ষাগৃহে বাংলার দর্শকদের ধরে রাখার মন্ত্র জানা এই তুমুল জনপ্রিয় ও মেধাবী সিনেমা কারিগর ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
ওস্তাদ মানে শহীদুল ইসলাম খোকন— আমরা সে সময় যারা নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখতাম তারা খোকন স্যারকে ওস্তাদ বলে ডাকতাম, দীর্ঘ দশ বছর (১৯৭৪, মাসুদ রানা) সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন চলচ্চিত্রের আরেক নক্ষত্র অভিনেতা-প্রযোজক-পরিচালক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)-এর সঙ্গে। অনেকেই জানেন খোকনের প্রথম ছবি ‘রক্তের বন্দী’, আসলে এটি ওনার দ্বিতীয় ছবি। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পদ্ম গোখরা’ হিট বা আলোচনায় আসতে পারেনি।
দ্বিতীয় ছবি ‘রক্তের বন্দী’ ব্যবসায় মার খেলে উনি বেশ চিন্তাই পড়ে যান আর তখনই গুরু সোহেল রানা এগিয়ে আসলেন। উনি তখন ছোট ভাই মাসুম পারভেজ মানে আমাদের সবার প্রিয় নায়ক রুবেলকে নিয়ে একটি ছবি করার কথা ভাবছিলেন। আর সে ভাবনা থেকেই রুবেলের সঙ্গে নতুন ছবিটির দায়িত্ব তুলে দেন শিষ্য খোকনের হাতে।
খোকন দায়িত্ব পেয়ে গুরুর মান রাখলেন, সমুদ্র উপকূলের জেলে সম্প্রদায় নিয়ে সে সময়ের নিরিখে সম্পূর্ণ নতুন ধারায় তৈরি করলেন মার্শাল আর্ট ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘লড়াকু’, যার বাকিটা লেখা থাকলো ইতিহাসে। ভিসিআরে দেখা ব্রুসলির সব অ্যাকশন যেন চলে এলো বাংলার সিনেমা হলের পর্দায়। কী যেন পেল দেশের দর্শকেরা, যেন এ রকম কিছুর জন্যই তারা অপেক্ষায় ছিলেন, হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সবাই ছবিটি দেখার জন্য।
‘লড়াকু’ হয়ে গেল সুপারহিট থেকে বাপ্পার হিট, সঙ্গে শুরু হলো ওস্তাদ শিষ্য ‘খোকন-রুবেলে’র দীর্ঘ সফল এক পথচলা। রুবেলকে নিয়ে একের পর এক তৈরি করলেন ‘বীর পুরুষ’, ‘বজ্রমুষ্টি’, ‘বিপ্লব’, ‘উত্থান-পতন’, ‘অপহরণ’, ‘বিশ্ব প্রেমিক’, ‘লম্পট’, ‘সন্ত্রাস’, ‘টপ রংবাজ’, ‘ঘাতক’, ‘শত্রু ভয়ংকর’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘দুঃসাহস’, ‘রাক্ষস’, ‘ভণ্ড’, ‘চারিদিকে শত্রু’, ‘পাগলা ঘণ্টা’, ‘অর্কমা’, ও ‘যোদ্ধা’র মতো হিট-বাপ্পার হিট ছবিগুলো।
খোকন ছিলেন স্টার তৈরির কারিগর। যার ছবিতে পেয়েছিলাম ড্যানি সিডাক, ইলিয়াস কোবরা, সিরাজ পান্না, আলেকজান্ডার বো, সিমলা, মিশেলা ও তামান্নার মতো জনপ্রিয় তারকাদের। আর এতসব জনপ্রিয় তারকাদের মাঝে যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল, যাকে পেয়ে বাংলা চলচ্চিত্র আরও একধাপ ওপরে ওঠার রাস্তা খুঁজে পেয়েছিল— সেই তিনি হচ্ছেন মরহুম হুমায়ূন ফরীদি সাহেব।
খোকন সব সময়ই দর্শকদের চমকে দিতে পছন্দ করতেন। যেমন; পানির নিচে মারামারি, চলন্ত প্লেনে অ্যাকশন, হঠাৎ রুবেলের ন্যাড়া মাথা, রুবেলের জ্যান্ত ইঁদুর খেয়ে ফেলাসহ অসংখ্য চমক। ঠিক তেমনি বড় চমক দিয়েছিলেন আল্পনা কথাচিত্রের ‘সন্ত্রাস’ ছবিটির মাধ্যমে। যেখানে রুবেল-জাফর ইকবালদের সঙ্গে বাংলার দর্শকেরা দেখলো ভয়ংকর এক খল-অভিনেতাকে, যার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ থাকতো হলভর্তি দর্শক। শুরু হলো রুবেল-ফরীদি ও খোকনের আরেক অধ্যায়, যে অধ্যায়ের নাম ছিল শুধুই সফলতার। ফরীদিকে অনেক ছবিতে অভিনয় করিয়েছেন খোকন, যার মধ্যে ‘টপ রংবাজ’, ‘অপহরণ’, ‘সতর্ক শয়তান’, ‘বিশ্ব প্রেমিক’ অন্যতম।
শুধু রুবেলকে নিয়েই নয় ফরীদিকে নিয়েও দারুণ দারুণ চমক দিয়েছিলেন খোকন সাহেব। ‘অপহরণ’ ছবিতে সম্পূর্ণ ন্যাড়া মাথায় ফরীদিকে পর্দায় তুলে চমকে দিয়েছিলেন, আবার বাপ্পার হিট ‘বিশ্ব প্রেমিক’ ছবিতে আনলেন সাইকো চরিত্রে। আমার জানা মতে, বাংলা চলচ্চিত্রে ‘বিশ্ব প্রেমিক’ই প্রথম ছবি যা সাইকো থ্রিলার সাবজেক্ট নিয়ে খোকন স্যার তৈরি করেছিলেন। সাইকো চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদির অভিনয়, সঙ্গে নতুন ধারার গল্পে দর্শকেরা আরেকবার ঝাঁপিয়ে পড়লো হল-বারান্দায়। যা দেখার জন্য কাউন্টারে লাগলো লাইনের পর দীর্ঘ লাইন।
এখানে একটু শেয়ার করি, ‘বিশ্ব প্রেমিক’ আমি প্রথম সপ্তাহে দেখতে পারিনি শুধুমাত্র ব্ল্যাকের চড়া দামের কারণে। দেখতে হয়েছিল পুরো এক সপ্তাহ পর।
একজন খোকন বুঝতেন আজ দর্শকেরা কী চায় আর কাল কী চাইবে, কী ধরনের ছবি বানালে দর্শকেরা আরও বিনোদিত হবে। তার ছবিই যেন একটি থেকে অন্যটি আলাদা। আর সেই থেকে আমরা পেলাম সম্পূর্ণ মার্শাল আর্ট ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘বজ্রমুষ্টি’, আর এটাই সেই ছবি যা মৌলিক গল্পে চীনের মার্শাল আর্টের আদলে বাংলা চলচ্চিত্রের পূর্ণাঙ্গ মার্শাল আর্ট ভিত্তিক চলচ্চিত্র। এমন দুঃসাহস একমাত্র খোকনের মতো মেধাবীরাই দেখাতে পারতেন।
খোকন শুধু পরিচালনাই করেননি, নিজের পরিচালনায় কয়েকটি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। যার মধ্যে ১৯৯২ সালে ‘উত্থান-পতন’ ছবিতে দ্বিতীয় নায়ক হয়ে অভিনয় করেন আবার ‘সন্ত্রাস’ ছবিতে সাধু চরিত্রে চমকে দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে চমকটি ছিল ‘বিষদাঁত’ ছবিতে, যেখানে তিনি একজন মন্দ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এ ছাড়া ‘যোদ্ধা’ ছবিতে একটি গানে কিছুক্ষণের জন্যও তাকে পাওয়া গেছে, সঙ্গে ‘লাল সবুজ’ ছবিতে মাহফুজের সঙ্গে কিছুক্ষণ অভিনয় করে ছিলেন।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তাকে টিভি নাটকেও পেয়েছিলাম অভিনেতা হিসেবে। শহিদুল আলম সাচ্চুর ‘মেগা বন্ড’ ও সৌরজয় চৌধুরী পরিচালিত ‘অবশেষে’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন খোকন।
অনেকেই বলেন তিনি শুধু রুবেলকে নিয়েই সফল ছিলেন, যা মোটেও সঠিক নয়। রুবেলের বাইরেও তিনি কিছু ছবি বানিয়েছেন, যেমন মরহুম মান্নাকে নিয়ে বানিয়েছেন ‘ভেজা বিড়াল’, ‘টাকা’ ছবিতে রিয়াজ, ‘লাল সবুজ’ ছবিতে মাহফুজ, আবার ‘চেহারা-ভন্ড২’ ছবিতে শাকিবকে নিয়েও ছবি বানিয়েছেন।
খোকন যে শুধু অ্যাকশন ছবিই করতেন তা নয়। তার কাছ থেকে ‘বাঙলা’র মতো অসাধারণ চলচ্চিত্রও আমরা পেয়েছি, আবার দেশপ্রেম নিয়ে ‘লাল সবুজ’ও তার।
ওস্তাদের কথা বলে বা লিখে কখনই শেষ করা যাবে না। তবু শেষ করতে হয়, বাংলা চলচ্চিত্রের মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির অনন্য কারিগর ছিলেন খোকন সাহেব। তার মতো পরিচালকেরা একবারই আসেন।আমার দীর্ঘ চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতায় এত মেধাবী পরিচালক আর পাইনি। ওস্তাদ…আজ আপনি নেই, তবে আপনি থাকবেন আপনার কাজে, আপনার চলচ্চিত্রে আর অসংখ্য মানুষের ভালোবাসার মনের গহীনে।