Select Page

বিষয় আর নির্মাণের দ্বন্দ্বে ‘নবাব এলএলবি’

বিষয় আর নির্মাণের দ্বন্দ্বে ‘নবাব এলএলবি’

চলচ্চিত্র দেখা আর উপলব্ধি করার মতো দর্শক দুঃখজনকভাবে একুশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এসেও সেভাবে বাড়েনি। তাই ছবির থেকে তারকা এখনো বড় করে দেখা হয় আমাদের চিরাচরিত দর্শক মানসিকতায়। যে বাস্তবতায় বলিউডে অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, সালমান খান-দের সিনেমা ওভারঅল মানসম্মত না হলে দর্শক সিনেমাহল থেকে বেরিয়েই সরাসরি ‘বেকার মুভি’ পর্যন্ত বলে দেয় আমাদের এখানে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। ছবিকে ওভারঅল জাজমেন্ট করলে হতে হয় গালমন্দের শিকার আর খণ্ডিত বা কৌশলী জাজমেন্ট করলে পাওয়া যায় বাহবা। এই যখন বাস্তবতা এ যাত্রায় আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে বান্দা হাজির ‘নবাব এলএলবি’-র।

পরিচালক অনন্য মামুন দারুণভাবে আলোচিত গত মাসখানেক ধরে পজেটিভ/নেগেটিভ দুইভাবেই। তার নতুন ছবি ‘নবাব এলএলবি‘ মুক্তি পেয়েছে। ‘আই থিয়েটার’ নামের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবিটি দুই কিস্তিতে মুক্তি পেয়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে এবং ছবির প্রথম কিস্তিতে একটি বিতর্কিত ইস্যুতে পরিচালক ও একজন অভিনেতা প্রশাসনিকভাবে অভিযুক্ত হয়েছে।

ছবির বিষয় ইমোশনাল, সমসাময়িক, সমাজের চলমান সমস্যাকে কেন্দ্র করে। ধর্ষণবিরোধী অবস্থান থেকে ছবির গল্প এগিয়েছে এটা ভালো কথা। কিন্তু ছবি তো ওভারঅল তখনই মানসম্মত হয় যখন এর মেকানিজম সব ক্যাটাগরিতে ঠিক থাকে মানে নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। নির্মাণের উপর ভর করে সাধারণ গল্পের ছবি অসাধারণ হয়ে ওঠে আর অনেক ভালো গল্পের ছবিও দুর্বল নির্মাণে মানসম্মত হয়ে ওঠে না। ‘নবাব এলএলবি’ নির্মাণের জায়গায় পিছিয়ে।

স্পর্শিয়া একজন আরজে। পরিবার নিয়ে তার দিন ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন তারই প্রতিষ্ঠানের বসের খারাপ নজরে সে পড়ে যায়। ধর্ষিত হয় এবং সে সামাজিকভাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। উকিল শাকিব খানের কাছে যায় কিন্তু কোথাও একটা কিছুর কমতি মনে হয় তার কাছে। শাকিব কি পারবে তাকে সুবিচার এনে দিতে নাকি ধর্ষকরা বেঁচে যাবে?

এই প্লটের উপর দাঁড়িয়ে ছবির নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল বেশ। পয়েন্ট করে বলা যাক –

১. দুই কিস্তিতে মুক্তির প্রথম কিস্তিতে ছবির প্রায় আধঘণ্টারও বেশি সময় সস্তা ভাঁড়ামিতে নষ্ট করা হয়েছে যেখানে ভালো কিছু যোগ করা যেত।

২. ছবির প্লট অনুযায়ী নামকরণে ধর্ষিতা স্পর্শিয়ার বাস্তবতা অনুযায়ী নাম দেয়া যেত। কারণ ছবির ওভারঅল প্রেজেন্টেশনে শাকিব খান একটা হিরোইজম নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় কিস্তির সাথে দ্বন্দ্ব বেঁধেছে। প্রথম কিস্তিতে যেখানে স্পর্শিয়া ছিল ফোকাসে দ্বিতীয় কিস্তিতে সে জায়গাটি শাকিব খান দখল করে। অনেকে হয়তো বলতে পারে আদালতের কার্যক্রমের জন্য শাকিবই ফোকাসে থাকবে কিন্তু পরিচালক যেভাবে স্পর্শিয়ার শুধুমাত্র স্যাড এক্সপ্রেশনকে ফোকাস করে শাকিব খানকে লাইমলাইটে রেখেছেন দ্বিতীয় কিস্তিতে এটা মোটাদাগে হিরোইজমকে তুলে ধরেছে। শাকিব খানের আদালতে কথা বলার স্টাইলেও একটা হিরোইজম লক্ষ করা গেছে। দ্বিতীয় কিস্তিতে ধর্ষিতার থেকে হিরো শাকিবই যেন বড় হয়ে উঠেছে।

৩. খুব সচেতনভাবে দেখলে হিন্দি ‘পিঙ্ক’-এর সাথে ‘নবাব এলএলবি’-র কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। শাকিব খানের আদালতের শেষ কয়েক মিনিটের বক্তব্যের সাথে ‘পিঙ্ক’-এ অমিতাভ বচ্চনের স্পিচটাকে মেলালে এর সাদৃশ্য চোখে পড়বে। রাশেদ মামুন অপুর সাথে শাকিবের জিজ্ঞাসাবাদের সময়টাতেও চোখে পড়বে। এই মিলটা হয়তো নেগেটিভ কিছু না তবে চোখে পড়াটা ছবির জন্য একটা দুর্বলতা।

৪. আদালতেই ছবির এক তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় হয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। একজন জজকে আমরা অতীতেও বহু কমার্শিয়াল ছবিতে দেখেছি। কিন্তু এ ছবির জজের মতো এমনটা দেখা যায়নি। জজ কথা বলছেন মজার ছলে, অসংলগ্নভাবে, নাটকীয়তা রেখে। জজের অ্যাটিচিউডকেও ঠিকভাবে দেখানো হয়নি।

৫. মাহিয়া মাহীর চরিত্রটি ছবিতে না রাখলেও কোনো সমস্যা হত না এমনই একটি চরিত্র। আদালতক্ষে বসে থেকে যে নায়িকা ছবি প্রায় শেষ করে ফেলল তাকে রাখা না রাখা সমান কথা। নায়কের সাথে গানে রোমান্স করা আর তার সাথে দু’একটা রোমান্টিক সিকোয়েন্স করার জন্য তাকে না নিলেও চলত।

৬. বড় অপচয়টা করা হয়েছে শহীদুজ্জামান সেলিমকে দিয়ে। তার মতো লিজেন্ডারি অভিনেতা এত হাই ভয়েসে থেমে থেমে স্লো ডায়লগ ডেলিভারিতে অভিনয় করল এটা মানা কষ্টকর। শাহেদ আলীর মতো জাত অভিনেতাকে দিয়েও ভাঁড়ামি করানো হয়েছে। রাশেদ মামুন অপুর চরিত্রটি মোটামুটি ঠিক ছিল। ভিলেন হিসেবে যতটুকু দরকার তার অভিনয় ঠিকঠাক। সুষমা সরকারও পরিমিত অভিনয় করেছে।

এই সীমাবদ্ধতাগুলো যখন উঠে আসে নির্মাণের জায়গাটি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর কি বলার অপেক্ষা রাখে! ক্ষেত্রবিশেষে ভারতীয় কেডি পাঠকের ‘আদালত’ শো-র মেকানিজমও গল্পে, উপস্থাপনায় এ ছবির থেকে বেটার হয়।

অবশ্যই ধর্ষণবিরোধী বক্তব্যধর্মী কমার্শিয়াল ছবি দরকার। কিন্তু ছবি তো শুধু ইমোশন দিয়ে হয় না সেখানে লজিক্যাল মেকিং লাগে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটা গান বানানো হয়েছে আর কি লাগে এই যদি হয় ছবিকে বিচার-বিশ্লেষণের মানসিকতা তবে চলচ্চিত্রের থেকে তারকাই বড় হয়ে থাকবে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। ভালো দিক অবশ্যই এ ছবির বিষয়। স্পর্শিয়াকে প্রথম কিস্তিতে ফোকাস করাটা পজেটিভ ছিল ছবির গল্পের জন্য আর ছবির গল্পের আল্টিমেট লক্ষ্যটা দেখানোও ভালো ছিল। এ কয়েকটি বিষয় বাদ দিলে সীমাবদ্ধতা বেশি।

অনন্য মামুনের উচিত হবে ভবিষ্যতে কোনো কন্ট্রোভার্সি ছাড়া ভালো গল্প ও নির্মাণ দুটোর দিকেই সমানভাবে নজর দিয়ে ছবি বানানো। এ দুটি ঠিক থাকলে কোনো নেগেটিভ প্রচারণার দরকার পড়বে না কারণ দর্শক শেষ পর্যন্ত ভালো জিনিসই চায়। শুভকামনা পরের ছবির জন্য।

রেটিং – ৫/১০


মন্তব্য করুন