Select Page

মানসম্মত অথচ আফসোসের নায়ক

মানসম্মত অথচ আফসোসের নায়ক


বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সুদর্শন নায়কদের মধ্যে অন্যতম ফেরদৌস। মূলনাম ফেরদৌস আহমেদ। চলচ্চিত্রে সংক্ষিপ্ত নাম ফেরদৌস। ১৯৭২ সালের ৭ জুন ঢাকায় জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেছে। ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা নায়কদের মধ্যে ফেরদৌস অন্যতম।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের হাত ধরে ‘ramp model’ হিশাবে ফেরদৌসের আগমন। ফেরদৌস প্রথম কাজ শুরু করে ‘পৃথিবী আমারে চায় না’ ছবিতে ১৯৯৭ সালে। এ ছবিতে পর্দায় তার নাম ছিল নবাগত দুর্জয়। নৃত্য পরিচালক আমির হোসেন বাবু তাঁর নাচ নিয়ে ‘নাচ ময়ূরী নাচ’ ছবিতে ফেরদৌসকে নিতে চেয়েছিল পরে ছবিটি হয়নি। অমর নায়ক সালমান শাহ-র মৃত্যুর পর ‘বুকের ভিতর আগুন’ ছবির অসমাপ্ত কাজ করে ফেরদৌস। ছবিতে আগুনে সালমানের মুখ পুড়িয়ে দিলে প্লাস্টিক সার্জারির পর চেহারা পাল্টে যায় ফেরদৌসের। হাসপাতালে ওয়াশরুমে মুখ ধুতে গিয়ে আয়নায় নিজের অন্যরকম চেহারা দেখে বিলাপ করতে থাকে ফেরদৌস। একটাই কথা তার ‘ঋষিতা (শাবনূর) তো আর আমাকে চিনবে না।’ ডাক্তার বলে ‘ভালোবাসা গায়ের রঙে নয়, মনে হয়। মন থেকে তোর ঋষিতাকে ডাকলে সে ঠিকই তোমার ডাকে সাড়া দেবে।’ ফেরদৌসের অভিনয় দারুণ প্রাণবন্ত ছিল।

‘বুকের ভিতর আগুন’ ছবির রাশ প্রিন্ট দেখে টলিউডি পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি ফেরদৌসকে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’-র জন্য নির্বাচন করে। তারও আগে মৌসুমী-ওমর সানি জুটির ‘দোলা’ ছবিতে একটা সিকোয়েন্সে হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছিটিয়ে মৌসুমীকে ভালোবাসার কথা জানায় সানী। হেলিকপ্টার চালিয়েছিল ফেরদৌস। ছবির নায়ক বিমান চালাতে জানত না তাই তার হয়ে ক্যামেরার আড়াল থেকে কাজটি করে দেয় ফেরদৌস। এটা কিছুটা ব্যতিক্রমী ছিল। ছবিগুলোতে প্রায় সমসাময়িকভাবে কাজ করে ফেরদৌস তবে প্রথম মুক্তি পায় ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবি।

ফেরদৌস প্রথম নায়ক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে দুই বাংলায় সমানভাবে কাজ করেছে। ফেরদৌসের সেরা কাজ ‘হঠাৎ বৃষ্টি।’ পাশাপাশি ফেরদৌস-প্রিয়াঙ্কা জুটিই সবচেয়ে পারফেক্ট যদিও ফেরদৌস বেশকিছু নায়িকার সাথেই সফল ছিল। প্রিয়াঙ্কার সাথেই ফেরদৌসের রসায়ন অসাধারণ লাগে। যদিও এ জুটির সব ছবিকে আমাদের ছবি বলা যায় না। ‘হঠাৎ বৃষ্টি, চুপি চুপি’ দুটোই অসাধারণ কাজ।তবে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’-র থেকে ‘চুপি চুপি’ অনেক বেশি রিয়েলিস্টিক। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ রিয়েলিস্টিক না তা নয়। স্টোরি টেলিং এর দিক থেকে ‘চুপি চুপি’ ছবিতে বাস্তবতা ছিল বেশি। ১৯৯৮ সালে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ টিভিতে মুক্তির পরই তারকাদের মধ্যে ফেরদৌস হয়ে যায় টক অফ দ্য কান্ট্রি। তার নিজের স্মৃতিতেও আসে কলকাতা শহরে এ ছবির বড় বড় বিলবোর্ড দেখে জীবনের সেরা সময়টা উপভোগ করেছিল। ছবির ফিনিশিং-এ দর্শকের ধৈর্য আর কুলায় না কখন তাদের পরিচয়টা ঘটবে। ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে প্রিয়াঙ্কার বলা ছোট্ট মধুর সংলাপটি ‘ভাগ্যিস জামাটা পাঠিয়েছিলাম!’ ফেরদৌসও বলে তার কেনা শাড়ির কথা আর সেটা প্রিয়াঙ্কার পরনে ছিল তখন।ক্লাইমেক্সের জন্যই ছবিটি সবার ভালো লেগেছিল। এর আগে ফেরদৌসের বিভিন্ন সততা দর্শক সেন্টিমেন্টকে ছুঁয়ে যায়। বিশেষ করে ট্রেনে পাশের যাত্রীর জন্মদিন লিখে নেবার সময় লোকটি যখন ফেরদৌসের জন্মতারিখটা জানতে চায় সে জানায় সে অনাথ তাই অন্যের জন্মদিনে চিঠি লিখে তাকে শুভেচ্ছা পাঠায়। লোকটি অবাক হয়। প্রিয়াঙ্কা তার হারানো ব্যাগ ফিরে পেলে ফেরদৌসের সাথে চিঠি বিনিময়ের এক পর্যায়ে ভালোবেসে ফেলে তাকে। ভাইটাল রোল ছিল মনোজ মিত্রের। ফেরদৌসের সেই কুণ্ডুমশাই যে তার দেখাশোনা করেছে ঠিকঠাকভাবে। জুন মাালিয়া ও শ্রীলেখা দুজনই চমৎকার ছিল। জুন মালিয়া ফেরদৌসকে পছন্দ করেছিল সেটা খুব ভালোমত বোঝা যায় যেদিন ফেরদৌস চলে যায়। শ্রীলেখা তো দিওয়ানা ছিল ফেরদৌসের জন্য। শেষের দিকে প্রিয়াঙ্কার সাথে তার সিকোয়েন্সটি টাচি ছিল। ছবির গানগুলো অসাধারণ। প্রিয়াঙ্কার বিপরীতে ‘টক ঝাল মিষ্টি’ নামে আরেকটি ছবিতে অভিনয় করে ফেরদৌস।

টলিউডে ঋতুপর্ণার সাথেও ফেরদৌসের ভালো জুটি গড়ে ওঠে। তাদের অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী, ওস্তাদ’ অন্যতম। সেখানে ফেরদৌসের অন্যান্য ছবিগুলোর মধ্যে আছে-‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, অকৃতজ্ঞ, আমাদের সংসার, দাদাঠাকুর, সাঁঝবাতির রূপকথা’ ইত্যাদি। ঢালিউডে ফেরদৌসের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে -‘মধু পূর্ণিমা, জবাবদিহি, মিস ডায়না, সন্তান যখন শত্রু, জীবন চাবি, প্রেমের জ্বালা, কেন ভালোবাসলাম, চুঁড়িওয়ালা, বিপ্লবী জনতা, দিল তো পাগল, ঘরজামাই, এই মন চায় যে, বস্তির মেয়ে, কাল সকালে, আয়না, দুই নয়নের আলো, আমার প্রতিজ্ঞা, সবার উপরে প্রেম, বলো না ভালোবাসি, তুমি বড় ভাগ্যবতী, ফুলের মতো বউ, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, খায়রুন সুন্দরী, প্রাণের মানুষ, কুসুম কুসুম প্রেম, যত প্রেম তত জ্বালা, এক কাপ চা, তুমি শুধু আমার, আমার স্বপ্ন তুমি, ভালোবাসার যুদ্ধ, রাণী কুঠির বাকি ইতিহাস, বউ শ্বাশুড়ির যুদ্ধ, দজ্জাল শ্বাশুড়ি, না বোলো না, গোলাপি এখন বিলাতে, ব্যাচেলর, পরমপ্রিয়, গঙ্গাযাত্রা, হঠাৎ সেদিন, রূপান্তর, শোভনের স্বাধীনতা, কালের পুতুল।

সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্রে ফেরদৌস চমৎকার। এ ধরনের ছবিতে তার পারফেকশন চোখে পড়ার মতো। যেমন – নন্দিত নরকে, মেহেরনেগার, রাক্ষুসী, বৃহন্নলা, গেরিলা, অনিল বাগচীর একদিন। ফুটবল নিয়ে প্রথম সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ছবি ‘জাগো’-তে ফেরদৌস মূল ভূমিকায় ছিল।

ফেরদৌস ‘মিট্টি’ নামে একটি কমার্শিয়াল হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছিল। ‘আই মিস ইউ’ নামে একটি জার্মান ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ফেরদৌস কিন্তু পরে হয়নি ছবিটা। বাণিজ্যিক ও অফট্র্যাক দুই ধরনের ছবিতেই ফেরদৌস ছিল মানানসই।

ফেরদৌসের জুটি গড়ে উঠেছিল দুই বাংলা মিলে প্রিয়াঙ্কা, ঋতুপর্ণা, মৌসুমী, শাবনূর, পপি-দের সাথে। মৌসুমীর বিপরীতে ‘খায়রুন সুন্দরী’ ছবিটি তার ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা আলোচিত ছবি।
ফেরদৌসের ছবির মধ্যে জনপ্রিয় গানও আছে বেশকিছু। কিছু দেখে নেয়া যায় –
একদিন স্বপ্নের দিন – হঠাৎ বৃষ্টি
সোনালি প্রান্তরে – হঠাৎ বৃষ্টি
আমি জানতাম জানতাম আসবে – হঠাৎ বৃষ্টি
বিকেলের শেষ আলো – চুপি চুপি
পৃথিবীর দু’কোণে – চুপি চুপি
এত ভালোবেসো না আমায় – মিস ডায়না
আসসালামাইকুম বিয়াইনসাব – প্রেমের জ্বালা
সাগরের মতোই গভীর – প্রেমের জ্বালা
তুমি আমার নজরবন্দী – প্রেমের জ্বালা
দুইকূলে দুই জনই আছি – চুঁড়িওয়ালা
তুমি খুব সাধারণ একটি মেয়ে – দুই নয়নের আলো
তোমার প্রেমে পড়েছি আমি – বলো না ভালোবাসি
এমন মিষ্টি একটা বউ – সন্তান যখন শত্রু
ভাইয়া তোমার বর – সন্তান যখন শত্রু
সুখে আমার বুক ভেসে যায় – সবার উপরে প্রেম
আমার জীবনে তুমি – আমার স্বপ্ন তুমি
ও খুশি – আমার স্বপ্ন তুমি
ভালোবাসা ছাড়া তো হয় না জীবন – যত প্রেম তত জ্বালা
ভেবে দেখলাম – ফুলের মতো বউ
গরুর গাড়ির দুই চাক্কা – চন্দ্রকথা
বাদলা দিনে মনে পড়ে – আমার আছে জল
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর – কুসুম কুসুম প্রেম
যদি বলি তুমি একটি গোলাপকলি – স্বর্গ থেকে নরক

ফেরদৌস ‘হঠাৎ বৃষ্টি এবং’ নামে একটি বই লিখেছিল। বইটি একুশে বইমেলায় প্রকাশ হয়েছিল। এ বইয়ে তার ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সম্পর্কে পুরো জার্নি উঠে এসেছে। তাকে ছবিতে কাজের আগে টলিউডে অনেকেই মানসিকভাবে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। বাসু চ্যাটার্জি তাদেরকে বলেছিলেন-‘আমি ছেলেটাকে অ্যাকটিং শেখাচ্ছি তোমরা ওকে বিরক্ত করছ কেন?’

ফেরদৌস প্রযোজক ছিল দুটি ছবিতে – হঠাৎ সেদিন, এক কাপ চা।

ফেরদৌস জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে ৪ বার – হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮), গঙ্গাযাত্রা (২০০৯), কুসুম কুসুম প্রেম (২০১১), এক কাপ চা (২০১৪)। বাচসাস পুরস্কার পেয়েছে ‘গঙ্গাযাত্রা’ ছবির জন্য ২০০৯ সালে। মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার দর্শক জরিপে তিনবার – গেরিলা (২০১১), হঠাৎ সেদিন (২০১২), বৃহন্নলা (২০১৪)।

ফেরদৌস ২০০৬ সালে বিয়ে করে তানিয়া ফেরদৌস-কে। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে।

একজন সফল নায়ক/অভিনেতা বলতে যা বোঝায় ফেরদৌস তার মধ্যে পড়ে। কিন্তু তাকে নিয়ে দর্শক-সমালোচকদের মধ্যে ক্ষোভ বা আফসোস আছে। নিজের প্রতি নিজেই অবিচার করেছে ফেরদৌস। লো বাজেটের ছবি একটা সময় এত বেশি করা শুরু করে যে সমালোচনায় পড়তে হয়। এখন পর্যন্ত এটা অব্যাহত আছে। বলতে গেলে নিজের গুরুত্ব নিজেই বোঝেনি। এজন্য মানসম্পন্ন ছবির নায়কের পরেও ফেরদৌস আফসোসের নায়ক হয়ে থাকবে।


মন্তব্য করুন