‘সখী রঙ্গমালা’র সনে
‘সখী রঙ্গমালা’ উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিয়েছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা ও সৌম্য সরকার, নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার…
শাহীন আখতারের লেখা যে খুব বেশি পড়ছি, এমন না। যতটুকু বুঝছি তিনি প্রস্তুত হয়েই লেখেন। পরিপাঠী ও মেদহীন। এবং সেই লেখাটা তাকে আলোচনা করে বুঝিয়ে দিতে হয় না। মানে লেখার ভেতরই লেখার বিষয়টা থাকে।
নাটকে রঙ্গমালা
সম্প্রতি এক গুরুজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নোয়াখালীর বিষয়াদি চলে আসছিল। উনি বলতেছিলেন, নোয়াখালীর দাঙ্গার সঙ্গে যতটা না ‘অতিপ্রচারিত’ ঘটনাগুলো সম্পর্কিত তার চেয়ে বেশি সম্পর্কিত স্থানীয় জমিদারদের অনাচার ও মজুতদারির সম্পর্ক; যেটা সাধারণত আলোচনায় এড়িয়ে যাওয়া হয়। মহাত্মা গান্ধীর ছাগল খেয়ে ফেলাও একই ঘটনা দিয়ে বোঝা যাবে। আরও বললেন, ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার আলোচনার করতে দিয়ে ১৯৬৫ সালের দাঙ্গা আড়ালে পড়ে যায়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মধ্যে ওটা ছিল জাতীয়তাবাদী ঘটনা।
ধারণা করি যে নোয়াখালীতে জমিদারির চিহ্নগুলো এখনো বিভিন্ন স্থানের নামের মধ্যে টিকে আছে। স্থাপনা আকারে কিছু আছে কিনা জানা নেই। সেই যে লক্ষ্মীপুর গিয়ে কয়েকটা জমিদার বাড়ি দেখে আসছিলাম। উনি বললেন, কেন দত্ত বাড়ি? (দত্ত বাড়ি নামে একটা জায়গা আছে, তবে ওইটা নিয়ে আমার কোনো ধারণা নাই) শাহীনের উপন্যাসটা কিন্তু ভালো। নোয়াখালী নিয়ে ভালো একটা কাজ হয়েছে। আমি ধরে নিলাম শাহীন আখতারের উপন্যাস। কোনটা হতে পারে? ‘সখী রঙ্গমালা’ কি?
বটতলা ‘সখী রঙ্গমালা’ নিয়ে টানা তিনদিনে ছয়টা শো করতে যাচ্ছে, এটা গত মাসেই শুনছিলাম। দেখারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু প্রায়ই ভুলে গেছিলাম। শেষদিনের আগের দিন সেটা মনে করাইয়া দিলেন এক বন্ধু। উনি ওই নাটকের সংগীত করছেন।
সখী রঙ্গমালার একজন বাঈজী। তার প্রেমে পড়ে হবু জমিদার রাজচন্দ্র চৌধুরী, যার ঘরে আছে বউ ফুলেশ্বরী। ফুলেশ্বরীর দাসী হিরা, যার আছে তিন প্রজন্মে দাসী হওয়ার কাহিনি। তো, ফুলেশ্বরীরে জামাই দেখতে পারে না, এটা মূলত বিয়ে করার দরকার বলে সামাজিক বিয়ে। রাজচন্দ্র পড়ে থাকে রঙ্গমালার কাছে। এ কারণে একদিন রঙ্গমালারে দেখতে যায় ফুলেশ্বরী। রঙ্গমালায় কী মধু, ঈর্ষা তো বটে! এ দেখার মধ্যে এমন কিছু আছে যে রঙ্গমালার প্রেমে পড়ে যায় ফুলেশ্বরী। নিজেরে রঙ্গমালা বলে কল্পনা করে। এই রকম একটার পর এক ঘটনায় জাড়ায়া যায় রঙ্গমালার নানান খায়েশ, তৎকালীন জমিদারি ঘটিত কুটকাচালি ও খুনোখুনি। লম্পট থেকে প্রেমিক হিসেবে রাজচন্দ্রের কিছু বদলও বটে। এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মোটাদাগের একটা চিত্র ও তার ভেতরে বহমান কিছু লেয়ার উঠে আসে।
এটা সাধারণ কথা যে উপন্যাস ও নাটকের রূপান্তর স্রেফ মাধ্যমের বদল নয়। প্রত্যেক মাধ্যমেরই নিজস্ব ভাষ্য তৈরির ধরন থাকে। ফলত নাটকে উপন্যাস আর সেই উপন্যাসটা থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রূপান্তরের প্রয়োজনে বদলে যায় ভাষ্য বা ঘটনাপ্রবাহ। সেই সৃজনশীল স্বাধীনতা নিয়ে মেলা তর্ক রয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত যে বই আর মঞ্চের ভাষা এক নয়। সম্ভবত এখানে মূলানুগ থাকতে গেলে কিছু জটিলতাও তৈরি হয়। মঞ্চে অজস্র চরিত্রের সম্মিলনে সখী রঙ্গমালা উপস্থাপিত হলেও মাঝে মাঝে মনে হয় তারা স্রেফ কাহিনী বলে যাচ্ছে। এবং গল্পের মূল মনোযোগ আসলে কী তা বোঝা সম্ভব নয় নানা সময়ে।
বিষয়টি সহজবোধ্য করে দেয় নামটি। সেভাবেই প্রস্তুত থাকে দর্শকের চোখ-কান। কিন্তু হবু জমিদারের রক্ষিতা হিসেবে বা সমাজে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে আবিস্কৃত রঙ্গমালা বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য আকারে উপস্থাপিত হয় না যে কারণে তাকে নিয়ে গল্পটা কেন্দ্রে রাখা যায়। প্রলুব্ধকর ছিনালি আছে, মধুর নৃত্য-গীত আছে; কিন্তু চরিত্রের দৃঢ় কোনো রূপ নাই, বরং শাদামাটা। তার হেঁয়ালি বা খেয়ালগুলো ততটা স্পষ্ট না। এমনও হইতে পারে বাঈজীর জীবন বেছে নেয়া সত্ত্বেও সংসারী একটা মন আছে তার। যার দেখা আমরা পাইতে গিয়েও পায় না।
নাটকে ফুলেশ্বরী
আবার মনে হতে পারে, রঙ্গমালা ও ফুলেশ্বরীর সম্পর্কই বুঝি নাটকের মূল ঘটনা। মুখোমুখি দেখা না হওয়া দুটো চরিত্র এবং ফুলেশ্বরীর সঙ্গে রঙ্গমালার সম্পর্কটুকুই এ নাটকের প্রাণ। বিশেষ করে ফুলেশ্বরী যখন রঙ্গমালাকে নিজের চেহারা হিসেবে আয়নায় দেখে; নিজের প্রণয়ের মাঝে রঙ্গমালা হয়ে হাজির হয় আবার রাজচন্দ্র নয়, রঙ্গমালার সঙ্গেই তার শরীরী আলাপ; এ দৃশ্য বেশ গভীর ও অনুভূতিপ্রবণ। যেহেতু পুরো ঘটনাটা ফুলেশ্বরীর কল্পনায় ঘটে, এ জায়গায় রঙ্গমালার চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠে ফুলেশ্বরী। তার বেদনা, আর্তি বা কামনাগুলো স্পষ্ট। কিন্তু স্পষ্ট হয় না সম্পর্কের এ ধরন বা এর মনোস্তাত্ত্বিক ভিত্তি। তবে বিষয়টা গুরুতর যে তা স্পষ্ট। এবং এটা নাটকটির সম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতি। এর চেয়ে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়ে ফুলেশ্বরী ও পাখির সখ্যর মধ্যে। এটাও হয়তো ধরা পড়ে যে যারা প্রকৃতিবিনাশী তারাও মানুষের পক্ষ নেয় না। ফুলেশ্বরী, রঙ্গমালা ও প্রকৃতি মিলে নতুন একটি ন্যারেটিভ তৈরি হয়। রঙ্গমালার নিষ্ঠুর মৃত্যু, মাতৃত্ব বঞ্চিত ফুলেশ্বরী ও পাখির সঙ্গে তার ঘর; নারীর একটা আলাদা জগত দেয়ায়।
মহিলা সমিতির সংস্কার হওয়া এ মঞ্চে আগেও নাটক দেখার অভিজ্ঞতা আগে হইছে। সর্বশেষ দেখছি সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘মন্ত্রাস ৪.৪৮’। উনার নাটকে সেট যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, এ নাটকের জন্য সেভাবেই উপযোগী মহিলা সমিতি। ‘সখী রঙ্গমালা’র ক্ষেত্রে মঞ্চের পুরো সুযোগটাই ব্যবহার করা হইছে। দুটো তলা মিলে চরিত্রের আসা-যাওয়া ঘটনা অনুসারে। প্রপস ছিল মিনিমালিস্ট ধাঁচের। তবে মঞ্চে একটি মইয়ের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। মোটামুটি প্রতিটি মুখ্য চরিত্র কখনো না কখনো এই মই বেয়ে উঠছেন। হইতে পারে পুকুর পাড়, হইতে পারে ওপর তলার বারান্দা। এর একটা রূপক ব্যাপারও থাকতে পারে। তবে দৃশ্যমানতার ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকল শেষ পর্যন্ত। ঢাকা বা চট্টগ্রামের বাইরের মঞ্চে তো নাটক হয় না, তবে বাইরের যতটুকু খবর শুনি, তাতে মনে হয় আমাদের নাটক এখনো আদ্যিকালের মতো চড়া দাগে রয়ে গেছে। মঞ্চের কারিগরি তেমন রূপান্তর ঘটে নাই। অভিনেতার চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠগত সুষমা ও উঠানামা অনেকটাই ব্যাহত। এমনকি সংলাপ অনেক সময় অবোধ্য হয়ে উঠে (অবশ্য ঢাকায় এখনো প্রচুর নাটক হয় যেগুলোর ভাষা কিছু বছর আগেও যেমনটা লেখা হইতো দৈনিক ইত্তেফাকে)। আমাদের হয়তো এ দফার রফা করা উচিত। তবে এ কারিগরি রূপান্তর হয়তো অবকাঠামোগত পরিবর্তনও। একই সঙ্গে অভিনয়ের টেকনিকের বদলও হতে পারে। যেটা বড়সড় বিনিয়োগও বটে। তবে যেহেতু এ বিষয়ে এক্সপার্ট নই, দর্শক আকারেই আগ্রহের বিষয়টুকু জানায়া রাখা আরকি।
এ নাটকের গান ও সংগীত ভালো লেগেছে। ঢাকাই মঞ্চ এখনো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদান বিশেষ করে গান যেভাবে টিকায়া রাখতে তৎপর- এটা প্রশংসার বিষয় বটে। বিশেষ করে নোয়াখালীর কিছু গান শোনা হয়েছে। গ্রেট। কিছু কিছু জায়গায় অনেক কেওয়াস মনে হইলেও দুনিয়া তো এমনই। মাঝে মাঝে। নাটক দেখতে ছিলাম যখন, পাশে থাকা বন্ধু হেসে দিল। কী হইলো? তার ইশারার পর বুঝতে পেরে না হেসে পারলাম না। ওই দৃশ্যটা হইলো- যেই না ইঙ্গা চৌধুরী নামের এক মুসলমান জমিদারকে দেখাইলো, সঙ্গে সঙ্গে দোতলার বারান্দায় চার নতর্কী হাজির। যারা আরবীয় কায়দায় কোমর-বুক দুলায়া নাচতেছে। সাধারণত এ বিষয়গুলোকে অশালীন আকারে দেখানো হয়। সংস্কৃত না আরকি। ইঙ্গা চৌধুরী চার বিয়েকেও তেমনভাবে দেখানো হলো। অন্যদিকে বারাঙ্গানা রঙ্গমালার নৃত্য-গীত কিন্তু ধ্রূপদী ঘারানার, যাকে আমরা সাংস্কৃতিকভাবে এখনো উচ্চমান্যতার বিষয় হিসেবে দেখি। হয়তো রাজচন্দ্রের লাম্পট্যকেও ঢেকে দেয়। টিপিক্যালি ও উসকানিমূলক দেখানোর এই যে ভঙ্গি তাতে নাটকটা স্রেফ নাটকই হয়ে থাকে।
ভাষাগত দিক ‘সখী রঙ্গমালা’ খানিকটা জটিলই। সময়কাল হিসেবে এভাবে ভাবা কষ্টকর নয়। এখানে যেটা হইলো, চলতি ভাষায় তর্জমা করলে হয়তো কিছুটা রগরগে মনে হতে পারে। যেটা চোখে লেগেছে গল্পের জেনে বা না জেনে অনেক অভিভাবক কমবয়সী সন্তান নিয়ে এসেছেন- সংলাপ অবোধ্য লাগলেও শরীরী ভঙ্গিগুলো নিশ্চিত তাদের চোখে লেগেছে। এ ক্ষেত্রে নাটকের দল ডিসক্লেইমার দিয়ে অবহিত করতে পারে। অথবা অভিভাবকরা কিছু বিষয়ে বেখবর না হয়েও যেতে পারেন।
উপন্যাস আকারে ‘সখী রঙ্গমালা’ আর নাটক আকারে ‘সখী রঙ্গমালা’র অভিষ্ট কি একই! হতে পারে নাও হতে পারে। তবে এ সময়ে ‘সখী রঙ্গমালা’ নাটকখানি কী হিসেবে হাজির হয়। তার তাৎপর্য কী! নাকি বিনোদনমূলক নির্মাণ যেখানে আমরা একটা সারমর্ম বা সারধর্ম খুঁজে নিতে পারি। (বটতলার কিছু ব্যাখ্যা আছে বটে) মঞ্চকে আমরা যে গুরুত্ব দিয়ে দেখি, তাতে এখানকার যেকোনো পরিবেশনা ভারবাহী বলে ভাবার চল আছে। সে দিক থেকে ‘সখী রঙ্গমালা’ নিয়ে ভাবছি- বাংলাদেশের নিপীড়নমূলক রাজনীতি, প্রকৃতিবিনাশী, মানবাধিকার বিনাশী হাঁসফাসের পরিবেশের ভেতর। হয়তো একদিন উত্তর পেয়ে যাবো। … সে হিসেবে— তবে যেটা আমি মিস করছি, তা নিশ্চয় আর চাইবো না, ‘সখী রঙ্গমালা’ পড়তে চাই। সম্ভব হলে পূর্ববঙ্গ গীতিকার ‘চৌধুরীর লড়াই’ও।