সফল জুটি : রিয়াজ-শাবনূর
নব্বই পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রে অন্যতম সেরা জুটি রিয়াজ–শাবনূর। সমসাময়িক চলচ্চিত্রের দুর্দশায় এই জুটি ছিল স্বস্তির নিঃশ্বাস। বাণিজ্যিক সফল এই জুটি এখন পর্যন্ত ছবি করেছে ৪৩টি।
১৯৯৭ : প্রয়াত পরিচালক আবিদ হাসান বাদল সালমান-শাবনূর-রিয়াজ এই ত্রয়ীকে নিয়ে মহরত করেছিলেন ‘তুমি শুধু তুমি’ সিনেমার। সালমানের অকালপ্রয়াণে সেই চরিত্রে স্থলাভিষিক্ত হন অমিত হাসান। এটাই রিয়াজ-শাবনূরের একসাথে প্রথম ছবি, তবে এই ছবি বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ। অন্যদিকে মতিন রহমানের ‘মন মানে না’ ছবিতে প্রায় ৫০ ভাগ কাজ করেছিলেন সালমান-শাবনূর। পরবর্তীতে এই ছবিতে সালমানের জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন রিয়াজ। জনপ্রিয় একটি হিন্দি ছবির অনুকরণে নির্মিত এই ছবিটির গান দর্শকপ্রিয়তা পেলেও ছবিটি বাণিজ্যিক সফল হয়নি।
১৯৯৮ : বাদল খন্দকার এই জুটিকে নিয়ে নির্মাণ করেন সুপারহিট ছবি ‘পৃথিবী তোমার আমার’, এই ছবির বাণিজ্যিক সফলতাই চলচ্চিত্র জগতে শাবনূর-রিয়াজ জুটি দাঁড়িয়ে যায়, ছবিটিও বেশ উপভোগ্য। চুক্তিবদ্ধ হন বেশ কয়েকটি ছবিতে। এই বছর তাদের একটি ছবিই মুক্তি পায়, পরবর্তীতে কলকাতায় এই ছবিটি রিমেক হয়।
১৯৯৯ : আগের বছরের সাফল্যের রেশে এই বছর এই জুটির মুক্তি পায় মোট ৬টি সিনেমা। সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে মতিন রহমানের ‘বিয়ের ফুল’। এই ছবিতে শাবনূর-রিয়াজের পাশাপাশি শাকিল খান অভিনয় করেছিলেন। একটি হিন্দি ছবির অনুকরণে নির্মিত এই ছবির গান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ব্যবসায়িক দিক দিয়েও ছবিটি স্থান করে সেরা পাঁচে। বাণিজ্যিক সাফল্যে এই বছর আরেকটি ছবি সেরা পাঁচে জায়গা করে নেয়, নাম ‘ভয়ংকর বিষু’, অবশ্য মনতাজুর রহমান আকবরের এই ছবিটি বেশ সমালোচিত হয়।
এই জুটির মুহম্মদ হান্নানের ‘ভালোবাসি তোমাকে’ ও আজাদী হাসানাত ফিরোজের ‘কাজের মেয়ে’ ছবি দুটিও সুপারহিট ব্যবসা করে। ছটকু আহমেদের গল্প নির্ভর ছবি ‘বুক ভরা ভালোবাসা’ ছবিটিও বেশ ব্যবসা করে। তবে হতাশাজনক ভাবে ফ্লপের ঘরে জায়গা করে নেয় শাবানা প্রযোজিত মনোয়ার খোকনের উপভোগ্য ছবি ‘স্বপ্নের পুরুষ’। এছাড়া একটি হিন্দি ছবির অনুকরণে নির্মিত মতিন রহমানের ‘আমি তোমারি’ও বাণিজ্যিকভাবে অসফল হয়।
২০০০ : এই বছর শাবনূর-রিয়াজ জুটির ৭টি ছবি মুক্তি পায়। আগের বছরের সাফল্যের রেশে প্রত্যাশা ছিল বেশি, কিন্তু সেই তুলনায় সাফল্য সন্তোষজনক হয়নি। তৎকালীন অশ্লীল ছবির দাপটে কিছু ভালো ছবি কোনঠাসা হয়ে পড়ে, তার মধ্যে এই জুটিরও ছবি আছে। মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে এফ আই মানিকের ‘এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে’, একটি হিন্দি ছবির অনুকরণে নির্মিত হয় এই ছবি। নন্দিত নির্মাতা জাকির হোসেন রাজু শাবনূর-রিয়াজ-পূর্ণিমাকে নিয়ে তৈরি করেন ‘নি:শ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’। বাণিজ্যিক সফলতার পাশাপাশি বেশ সমাদৃতও হয়। মতিন রহমান তার আগের ছবির সাফল্যের রেশে রিয়াজ-শাবনূর-শাকিল ত্রয়ীকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘নারীর মন’, মুক্তির আগেই গানগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়, বেশ হাইপও তোলে, কিন্তু মুক্তির পর বাণিজ্যিক ফলাফল সন্তোষজনক আসেনি। একই অবস্থা মতিন রহমানের আরেক ছবি ‘এই মন চায় যে’, এই ছবিতে শাবনূর-রিয়াজের পাশাপাশি অভিনয় করেছিলেন ফেরদৌস। এছাড়া এই বছর মুক্তি পাওয়া বাকি ছবিগুলো এরই নাম দোস্তী, কারিশমা, আশা আমার আশা ফ্লপের ঘরে নাম লিখায়।
২০০১ : এই বছর বেশ ভালো সময় পার করেন শাবনূর-রিয়াজ। মুক্তি পায় ৬টি ছবি। গাজী মাহবুবের ভালোবাসার ছবি ‘প্রেমের তাজমহল’ সুপারহিট ব্যবসা করে, জায়গা করে নেয় শীর্ষ পাঁচে। প্রশংসিত এই মৌলিক ছবিটির গানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, তিনটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। সিনেমাটি এই জুটির অন্যতম সেরা ছবি হয়ে থাকবে। ব্যবসায়িক সাফল্যে বছরের শীর্ষ পাঁচে জায়গা করে নিয়েছিল দেবাশীষ বিশ্বাসের সিনেমা ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, একটি ভারতীয় ছবির অনুকরণে নির্মিত উপভোগ্য এই ছবিটির মুক্তির আগে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়, ফলাফলও আসে প্রত্যাশামাফিক। বাণিজ্যিক সফল নির্মাতা এফ আই মানিক রিয়াজ-শাবনূর ও শাকিব খানকে নিয়ে একটি ভারতীয় ছবির অনুকরণে নির্মান করেন ‘স্বপ্নের বাসর’, এই ছবিটিও বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। অশ্লীল ছবির নির্মাতা হিসেবে সমালোচিত নির্মাতা বাদশা ভাই এই জুটি নিয়ে নির্মাণ করেন পরিচ্ছন ছবি ‘গুন্ডার প্রেম’, পরে অবশ্য বিতর্কিতভাবে ‘কালা মানিক’ নামে আবার মুক্তি দেন। অবাক করা ঘটনা হলো— আগে সেভাবে ব্যবসা না করলেও, পরেরবার মুক্তিতে সাফল্যের স্বাদ পায়। এই বছর মুক্তি পাওয়া অন্য দুটি সিনেমা ‘বস্তির মেয়ে’ ও ‘মন’ ব্যবসায়িক সাফল্য পেতে ব্যর্থ হয়।
২০০২ : এই জুটি অভিনীত সিনেমা মুক্তি পায় ৬ সিনেমা। শাহাদাত হোসেনের লিটনের বাণিজ্যিক সফল ছবি ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ ছিল এই জুটির অভিনীত সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা ছবি, জায়গা করে নিয়েছিল শীর্ষ দশে। একটি ভারতীয় ছবির অনুকরণে নির্মিত এই ছবিতে শাকিব খানও অভিনয় করেছিলেন।
নন্দিত নির্মাতা জাকির হোসেন রাজুর দুটি সিনেমাতে অভিনয় করেন তারা। প্রথম ছবি ‘মিলন হবে কত দিনে’, মৌলিক গল্পের এই ছবিটির ব্যবসায়িক ফলাফল সন্তোষজনক ছিল না। পরের ছবি ‘ভালোবাসা কারে কয়’। বাণিজ্যিকভাবে সফল এই ছবিটিও জায়গা করে নিয়েছিল শীর্ষ দশে, দর্শকদের কাছে ছবিটি বেশ সমাদৃত হয়। মতিন রহমানের ‘মাটির ফুল’ ছবিটিও হিটের তকমা পান, জায়গা করে নিয়েছিল শীর্ষ দশে। বরেণ্য চিত্রনির্মাতা আমজাদ হোসেনের সঙ্গে প্রথমবারের মত অভিনয় করেন এই জুটি, ছবির নাম ‘সুন্দরী বধূ’। সিনেপ্রেমীদের মনে এই ছবি নিয়ে বেশ প্রত্যাশা ছিল, তবে মুক্তির পর নকলের অভিযোগে হতাশই হতে হয়েছিল। অবশ্য ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়নি। শাবনূর-রিয়াজ ও আমিন খান-কেয়াকে নিয়ে এফ আই মানিক একটি ভারতীয় ছবির অনুকরণে নির্মাণ করেন ‘হৃদয়ের বন্ধন’, আলোচিত হলেও ব্যবসায়িক সাফল্য প্রত্যাশামাফিক হয়নি। এই বছরেই এই দুইজনের মাঝেই সম্পর্কে ফাটল ধরে।
২০০৩ : এই বছরে মুক্তি পায় মাত্র দুটি ছবি। ততদিনে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মনোমালিন্যের কারণে ভেঙ্গে গেছে এই জুটি। আগের করা ছবিগুলোই মুক্তি পায় এই বছর। জিল্লুর রহমানের ‘স্বপ্নের ভালোবাসা’ ছবিটি বেশ ভালো ব্যবসা করে, জায়গা করে নিয়েছিল শীর্ষ দশে। অন্যদিকে মতিউর রহমান পানুর যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘নসিমন’ ফ্লপের ঘরে নাম লিখায়।
২০০৪ : এই বছর মুক্তি পায় একটি সিনেমা, শিল্পী চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘তোমার জন্য পাগল’। ব্যবসায়িক সাফল্য আসা এই ছবিতে তাদের সহশিল্পী ছিলেন অমিত হাসান।
২০০৫ : মুক্তি পায় একটি সিনেমা। এই সিনেমাই তাদের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে সেরা সিনেমা তো বটেই, তাদের সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক সফল ছবি। নন্দিত নাট্যনির্মাতা সালাউদ্দিন লাভলু পরিচালনায় ছবির নাম ‘মোল্লা বাড়ির বউ’। রিয়াজ-শাবনূর ছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করেছেন মৌসুমী ও এটিএম শামসুজ্জামান। বছরের সেরা ব্যবসাসফল ছবি হিসেবে স্থান করে নেয় ছবিটি। গানগুলোও বেশ সমাদৃত, দর্শক মহলে ছবিটি আজো সমাদৃত। এছাড়া শাবনূর- ফেরদৌস-শাকিল অভিনীত ‘দুই নয়নের আলো’ ছবিতে অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন রিয়াজ। পরিচালনা করেন মোস্তাফিজুর রহমান মানিক। এ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার জেতেন শাবনূর।
২০০৬ : মুহম্মদ হান্নানের ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ মুক্তি পায় এই বছর। ধারণা করা হয় রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য ছবিটির ব্যবসায়িক সাফল্য আসেনি। এই ছবিতে জায়েদ খানের অভিষেক হয়।
২০০৭ : একটি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে মালেক বিশ্বাস নির্মাণ করেন ‘মেয়ে সাক্ষী’। তবে ছবিটির নির্মাণ বেশ দূর্বল ছিল, এই জুটিরও জনপ্রিয়তা কমে যায়। ব্যবসায়িকভাবে বেশ ধরাশায়ী হয়।
২০০৯ : এই বছর আবার নিয়মিত হয় এই জুটি, মুক্তি পায় সাতটি সিনেমা। তবে ছবি নির্বাচনে বেশ ভুল করেন, জনপ্রিয়তাও বেশ হ্রাস পায়। মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে এটিএম শামসুজ্জামানের ছবি ‘এবাদত’ নিয়ে প্রত্যাশা থাকলেও ব্যর্থ হয়, তবে ছবিটি প্রশংসিত হয়। এছাড়া ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ ও ‘মন ছুঁয়েছে মন’ কিছুটা চলেছিল, তবে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও আসে। চাঁদের মত বউ, বধূ তুমি কার, ভালোবেসে বউ আনবো ব্যবসায়িকভাবে ফ্লপের শিকার হয়। চাঁদের মত বউ, এবাদত ও মন বসে না পড়ার টেবিলে একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০১৩ : বেশ কয়েক বছর ধরে আটকে থাকার পর গাজী মাহবুবের ‘শিরি ফরহাদ’ মুক্তি পায়। এই ছবিটিও ফ্লপের শিকার হয়। তবে রিয়াজ জাতীয় পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন।
নব্বই পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রে নকলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মৌলিক ছবির পরিমাণ কম, দূর্বল ছবিও আছে, সাহিত্যনির্ভর বা ভিন্নধর্মী সিনেমাও নেই। তবে সেই অবস্থায় সবচেয়ে সুস্থধারার ছবির মালিক তারাই। প্রত্যাশা রইলো, বাংলা চলচ্চিত্রে আবার তাদের সফল প্রত্যাবর্তন ঘটবে।