Select Page

হালদা : সচেতনতা, মূল্যবোধ, নদী ও নারীর গল্প

হালদা : সচেতনতা, মূল্যবোধ, নদী ও নারীর গল্প

হালদা এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট তিথিতে মা মাছেরা এই নদীতে ডিম ছাড়ে। হালদা পাড়ের জেলেরা এই নদীর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু ডিম পাড়াকালে এই হালদা নদী তীরবর্তী জেলেদের মাছ ধরা ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য কারণে নদীর উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এই বিষয়টিকে রূপকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘হালদা’ চলচ্চিত্রে। তৌকীর আহমেদ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ নদী ও নারী। এক দিকে নদীর উপর মানব সৃষ্ট বিরূপ প্রভাব, অন্যদিকে নারীর পুরুষের প্রভাব একে অপরের রূপক হিসেবে দেখানো হয়েছে এই ছবিতে।

জেলে মনু মিয়া সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতের খপ্পরে পড়ে তার মাছ ধরার ট্রলার হারায়, কিন্তু তার সহকারী বদিউজ্জামালের সাহসিকতায় প্রাণে বাঁচে সে। বেঁচে ফিরেও তার রেহাই নেই, মহাজনকে ট্রলারের টাকা পরিশোধ করতে হবে। মহাজনের টাকা পরিশোধ করতে থাকে সাহায্য করবে পাশের গ্রামের ধনী ও প্রভাবশালী নাদের চৌধুরী, কিন্তু শর্ত তার মেয়ে হাসুকে তার সাথে বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু মনু মিয়ার সহকারী বদির সাথে ততদিনে হাসুর ভাব হয়ে গেছে। তবুও পিতৃঋণ শোধ করতে নাদেরকে বিয়ে করে হাসু। একদিকে হালদা দূষিত হতে থাকে নানাবিধ মানব সৃষ্ট কারণে এবং ডিম পাড়ার তিথিতে মা মাছ ধরার কারণে হালদায় মাছের প্রজনন কমতে শুরু করে। অন্যদিকে হাসু হয়ে যায় পুরুষের খাঁচায় আবদ্ধ পাখি, যে পুরুষের অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরেও পা রাখতে পারবে না। সে হয়ে যায় সন্তান জন্মদানের যন্ত্র। কিন্তু সকল শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসে হাসু। শেষ দৃশ্যে তাকে দেখা যায় হালদার বুকে ভেসে বেড়াতে। সে তখন আর হালদার জলে ভাসা পদ্ম নয়, সে হালদারই আরেক রূপ। তাদের দুজনকে সকল প্রতিবন্ধকতা দূরে সরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একজনকে বাঁচতে হবে প্রকৃতির স্বার্থে, অপরকে বাঁচতে হবে তার সন্তানকে বাঁচানোর স্বার্থে।

‘হালদা’র চরিত্রায়ন যথোপযুক্ত। অভিনয়সমৃদ্ধ এমন চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের নিজেদের সবটুকু ঢেলে দেওয়ার প্রয়াস থাকতে হয়। মনু মিয়া চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু জেলেদের প্রতিনিধি। তিনি জানেন ডিম দেওয়ার তিথিতে মাছ ধরাটা অপরাধ। তিনি তার অভিব্যক্তিতে তার সেই অপরাধবোধ ফুটিয়ে তুলেছেন। মনু মিয়ার সহকারী বদি চরিত্রে অভিনয় করেন মোশাররফ করিম। এতিম একাকী এক যুবক আশ্রয় পান মনু মিয়ার বাড়িতে। তাকে দেখা যায় এক প্রেমিক সত্তা হিসেবে, যে হালদার বুকে তার প্রিয়তমাকে নিয়ে ছোট্ট সুখের ঘর বাঁধতে চায়। ধনী ও প্রভাবশালী কিন্তু নিঃসন্তান নাদের চরিত্রে জাহিদ হাসান তার খল রূপ প্রদর্শন করেছেন দক্ষতার সাথে।

নারীকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্রে প্রধান নারী চরিত্রে রয়েছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, রুনা খান ও দিলারা জামান। প্রবীণ দিলারা জামান এখনো তার অভিনয়ের প্রতি দায়িত্বশীল। নাদের প্রথম স্ত্রী চরিত্রে রুনা খান তার ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং কীভাবে তার অবস্থান ঠিক রাখতে হয় তা জানেন। সবশেষে, এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাসুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিশা। জেলে পরিবারের চপল কন্যা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে এবং গল্পের দাঁড় বাইতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল। তিশাকে এই চরিত্রের জন্য নির্বাচন করেন পরিচালক তৌকীরের স্ত্রী বিপাশা হায়াত। তাকে ধন্যবাদ সঠিক কাস্টিংয়ের জন্য।

একসাথে হালদার বুকে ভেসে চলা নৌকা, নদীর ঢেউ ও আকাশকে অনবদ্যভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে। খুব ভোরে মাছ ধরার দৃশ্য, হাসু ও বদির মাঝ নদীতে নৌকা বেয়ে চলা এই বিষয়গুলো নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন চিত্রগ্রাহক। বৃষ্টি ও বজ্রপাতের দৃশ্যে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসের ব্যবহার সঙ্গতিপূর্ণ। পিন্টু ঘোষের সুর মুগ্ধ করে রেখেছে সারাক্ষণ। পিন্টু ঘোষ ও সুকন্যা মজুমদারের কণ্ঠে অনন্য সুরের ‘গম গম লার’ গানটি চলচ্চিত্রের শেষ অবধি কানে বাজতে থাকে। পোশাক ও মেকাপেও পেশাদারীত্বের ছাপ পাওয়া যায়।

চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এই ভাষা না জানা মানুষদের বুঝতে সমস্যা হবে। তবে সেই অঞ্চলের প্রকৃত রূপ তুলে ধরতে এই ভাষার ব্যবহারের বিকল্পও ছিল না। চলচ্চিত্রে মা মাছ ধরে পাপবোধে ব্যথিত বাবা যখন তার কন্যাকে এই কথা জানায় তখন কন্যার আকস্মিক যে অতিনাটকীয় অভিব্যক্তি দেখানো হয়েছে, সত্যিকার অর্থে জেলে কন্যারা এই বিষয়ে সচেতন কিনা তা জানা নেই। তবে যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা মঙ্গলজনক।

‘হালদা’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নান্দনিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র। এটি এই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে এতে বেশ কিছু লোকাচার তুলে ধরা হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় দৃশ্যে গ্রামের কিশোরী ও যুবতীদের মধ্যে প্রচলিত একটি প্রথা ব্যাঙের বিয়ে। কবিগান আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। পাশাপাশি রয়েছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু কুসংস্কার। সন্তান জন্মদানে অক্ষমতাকে শুধুমাত্র নারীর একার দোষ হিসেবে দেখা। এছাড়া দেখানো হয়েছে যে নারী একটা সময় পর তার নিজের নাম-পরিচয়ও হারিয়ে ফেলে। তখন সে কারও মা, কারও বধূ, কারও পুত্রবধূ। জাতীয় সমস্যাও ওঠে এসেছে। মা মাছ ধরার ফলে মৎস্য প্রজনন কমে যাচ্ছে, বালু তোলার ড্রেজিং মেশিনে কাটা পড়ছে মা মাছ, কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদী, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে নদী পাড়ের মৎস্যজীবীদের উপর। রয়েছে নদী দূষণ বিরোধী আন্দোলন, প্রভাবশালী মহল তাদের প্রভাব খাটিয়ে সেই আন্দোলনকে তুচ্ছ করে দেখা।

আমাদের দেশের খুব কম সংখ্যক চলচ্চিত্রই সামাজিক জীবনের জন্য পরিপূর্ণ বার্তা বহন করতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘হালদা’ সফল। সফল তৌকীর আহমেদ, তার গল্প বলার ধরনে। এই বার্তা শুধু হালদা নয়, সকল নদীর ক্ষেত্রে যেমনি সত্য, তেমনি সত্য নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিকোণ প্রসঙ্গে। নিঃসন্দেহে এটি এই বছরের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্র : হালদা

পরিচালক : তৌকীর আহমেদ

শ্রেষ্ঠাংশে : জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ফজলুর রহমান বাবু, রুনা খান

সঙ্গীত : পিন্টু ঘোষ

চিত্রগ্রাহক : এনামুল হক সোহেল

সম্পাদক : অমিত দেবনাথ

আমার রেটিং : ৪.৫/৫


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

ব্লগার ও ডেটাবেজ এডিটর: বিএমডিবি

মন্তব্য করুন