
হুমায়ূন আহমেদের চার সিনেমার বিশেষত্ব
মোট নয়টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এর মধ্যে তার পরিচালিত চারটি ছবির কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। ছবিগুলো ভিন্নভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।

শ্রাবণ মেঘের দিন
এ ছবিতে পরিবার, প্রেম, বিচ্ছেদ এসব থাকলেও লোকসংস্কৃতির গভীর একটা ছাপ সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মতি গায়েনের চরিত্রে জাহিদ হাসান লোকসংস্কৃতির উপাদান হয়ে উঠেছে। তার লিপে বারী সিদ্দিকীর ‘পূবালী বাতাসে’ কিংবা ‘ওগো ভাবীজান, নাও বাওয়া মর্দলোকের কাম’ গানগুলোতে সেই সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। জমিদার গোলাম মোস্তফার নাতনীরা লোকসংস্কৃতির চর্চা করে। যে জনগণের জীবন নিয়ে লোকসংস্কৃতির কাজ ছবির শেষে সেই মানুষদের কাতারেই গোলাম মোস্তফা চলে আসে বংশীয় অহংকারকে ছুঁড়ে ফেলে। হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ ছবিটিতে।
আগুনের পরশমনি
রবীন্দ্রসঙ্গীত হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ছিল। তাঁর বেশকিছু বইয়ের নামও রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে নেয়া। এ ছবির নামটিও বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে এটি তিনিই ব্যবহার করেছেন। ছবির গল্পেও মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে একটি পরিবারের উৎকণ্ঠার দিনলিপি দেখানো হয়েছে। একটি পরিবারই যেন তখনকার পুরো দেশের পরিবারের চিত্রকে তুলে ধরেছে। দরজায় ঠক ঠক করলেই যেন বুবের ভেতর কাঁপন ধরে যায় এমনকি দর্শকেরও। দেশ স্বাধীন হওয়া এ ছবিতে নেই তারপরেও ছবির শেষ দৃশ্যে মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান নূরের চরিত্রটি জানালায় হাত বাড়িয়ে আলো ছুঁয়ে দেখে এবং গান ভেসে আসে ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ সাথে পাখিদের ওড়াওড়ি দেখানো হয়। এই সূক্ষ্ম শৈল্পিক দৃশ্যের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার বার্তা দেয়া হয়। ভিন্ন দৃষ্টিতে নির্মিত হয়েছে এ ছবি।

দুই দুয়ারী
মানুষের মধ্যে যে বৈচিত্র্য তাকে আমরা কোনো না কোনোভাবে রহস্যের আবরণে বেঁধে ফেলতে পারি কিন্তু সে রহস্য সব মানুষ ধারণও করে না। কিছু মানুষ অনেকের থেকে আলাদা হয়ে সেই রহস্যের অংশ হয়ে যায়। এ ছবিতে রিয়াজ সেই ‘রহস্য মানব’। হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে সে শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে লেখা-‘হে নগরবাসী, কেউ কি আমাকে চেনেন?’ বলা হয় নিজেকে চেনা নাকি সবচেয়ে কঠিন এবং সে রহস্য সবচেয়ে বড়। রিয়াজ যে পরিবারটিতে আসে সেখানে তার মাধ্যমে অনেকের জীবনে পরিবর্তন আসে, চিন্তায় পরিবর্তন আসে। রিয়াজের লিপের সেই দার্শনিক গান-‘মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ’ ভাবাতে বাধ্য করে। গানের মধ্যে যে লাইনগুলো জীবনে আপাতদৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ জিনিস মনে হয় সেগুলোর মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সৌন্দর্য। যেমন-‘অতি তুচ্ছ পতঙ্গেরও অপূর্ব জীবন/হয়তো শিশিরকণারও আছে শুধু তার একান্ত একার আনন্দেরই ক্ষণ।’ রহস্য মানবের মনস্তাত্ত্বিক যাত্রার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ভেতরের রহস্য মানবকে দেখানোর যে ধারণা দিয়েছেন সেটিই এ ছবিকে বিশেষত্বপূর্ণ করেছে।
নয় নম্বর বিপদ সংকেত
সাদা চোখে এটি একটি কমেডি ছবি মনে হয় কিন্তু এর ভেতরে যে সূক্ষ্ম বার্তাটি দেয়া হয়েছে সেটি কয়জন খেয়াল করেছে! ছবির প্রধান চরিত্র রহমত আলীর মাধ্যমে শেষ বয়সে মানুষের জীবনে যে নিঃসঙ্গতার করাল গ্রাস নেমে আসে সেটি সূক্ষ্মভাবে দেখানো হয়েছে। শেষ বয়সে গিয়েও মানুষের হাসি, আনন্দময় জীবন কাটানোর অধিকার রয়েছে। রহমত আলীর সেই তৎপরতা পুরো ছবিতে বিদ্যমান ছিল। ছবির এ বার্তাটি কমেডির আড়ালে বিশেষত্ব দিয়েছে।