অন্তরালের এক গীতিকার বাপ্পী খান
এলআরবি ও আইয়ূব বাচ্চুকে স্মরণ করতে গেলে যে নামগুলো প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসবে তাদের অন্যতম বাপ্পী খান। এ মানুষটি সবসময় রয়ে গেলেন প্রচারের বাহিরে। সেই ৯০ দশক থেকে আজো পর্দার অন্তরালে। অথচ একটা প্রজন্ম, বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত তার কাছে ঋণী হয়ে আছে। আমরা যারা ৯০ দশকে বেড়ে উঠা এবং আজকের বর্তমান প্রজন্মও তার লেখা অনেক গান গুনগুন করে, শোনে কিন্তু বহু শ্রোতারা জানেই না যে সে গানগুলো কার লেখা তা। এই বাপ্পী ভাইয়ের লেখা কত দারুণ দারুণ গান শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম কৈশোর, তারুণ্য বেলায় যা আজো ভুলিনি।
এলআরবির প্রথম অ্যালবাম থেকেবাপ্পী খান নামটির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হই। সেই থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যান্ডটির এমন কোনো অ্যালবাম নেই যে বাপ্পী ভাইয়ের গান নেই। ব্যান্ড মিক্সড ও সলো অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চুর অনেক জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের গীতিকারও তিনি।
শুধু এলআরবি বা আইয়ুব বাচ্চু নয়, ফিলিংসের ‘জেল থেকে বলছি’, জেমসের ‘পালাবে কোথায়’, ‘দ্য কিউ’ ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘জন্ম’তে বাপ্পী খান মুগ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে রেশাদ ভাইয়ের ‘দ্য কিউ’ ব্যান্ড ও একক অ্যালবামগুলোয় তার লেখা গানগুলোর কথা না বললেই নয়। মাথা নষ্ট করা একেকটা গানের কথা যা অদ্ভুত। ‘অজন্তার সুখ দুঃখ’, ‘জন্ম’, ‘ঠিকানাবিহীন চিঠি’, ‘গ্রহান্তরী ভালোবাসা’, ‘স্বপনের চৌকাঠে’, ‘১২টি বছর’, ‘আমার ঘড়ির ঘণ্টাগুলো’র মতো অদ্ভুত সুন্দর কথার গানগুলো আজো শুনি, শুনতে হয়। রেশাদ ভাইয়ের গানগুলো বাপ্পী ভাইকে আমাদের কাছে আরও বেশি পরিচিতি ও ভক্ত বানিয়ে দেয়।
এলআরবির কালজয়ী অ্যালবাম ‘সুখ’ তো বলতে গেলে বাপ্পী খানের। অ্যালবামের টাইটেল সং ‘সুখ’সহ ‘গতকাল রাতে’, ‘ক্ষণিকের জন্য’, ‘আমি যে কার’, ‘মানুষ বনাম অমানুষ’, ‘অসুস্থ এক হাসপাতালে’, ‘যত বেশি আমি’, ‘ব্যাপারটা আমি বলবো কাকে’র মতো হার্ড ও সফটরক ধাঁচের দুর্দান্ত গানগুলো তার লেখা। এলআরবির দ্বিতীয় ডাবল অ্যালবাম ‘আমাদের?’ ও ‘বিস্ময়’-এও বাপ্পী ভাই আবারো দুর্দান্তরূপে হাজির ‘সাড়ে তিন হাত মাটি’, ‘আয়না এবং আমি’, ‘ভবের দেশে’, ‘প্রজাপতি’, ‘মন পুড়ে ছাই’, ‘স্মৃতি’র মতো গান দিয়ে।
ব্যান্ড সংগীতের সাত গিটারিস্ট নিয়ে আলী আফজল নিকোলাস ভাইয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত ব্যান্ড মিক্সড ‘টুগেদার’ অ্যালবামের প্রথম গান ‘এখন অনেক রাত’ শুনে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। বাপ্পী ভাইয়ের লেখা-কথায় বস এবির সুর ও কণ্ঠ রীতিমতো আমাদের মাথা নষ্ট করে দিলো। কতবার যে রিওয়াইন্ড করে শুনেছি তার হিসাব নেই। আবার সেই একই বাপ্পী খান ও আইয়ুব বাচ্চু ব্যান্ড মিক্সড ‘ঝড়’ অ্যালবামের প্রথম গান ‘তখনো জানতে বাকি’ দিয়ে মনে শীতল পরশ বুলিয়ে দিয়েছিলো।
বাপ্পী ভাই প্রচুর গান লিখেছেন। আর সেসব গান থেকে যদি শুধু এলআরবি ও আইয়ুব বাচ্চুর গান নিয়ে লেখি তাহলে একটা ছোটখাটো বই প্রকাশ করা লাগবে, এরকম ১০টি পোস্ট দিয়েও শেষ করা যাবে না; সেখানে অন্য শিল্পী বা ব্যান্ডের জন্য লেখা গানগুলোর কথা বাদই দিলাম। বাপ্পী ভাই আপনার কাছে আমরা বাংলা গানপাগল শ্রোতারা ঋণী এবং আপনাকে অনেক ভালোবাসি এ কথা কখনো বলা হয়নি।
বাপ্পী খানের লেখা উল্লেখযোগ্য গান: গতকাল রাতে, ক্ষণিকের জন্য, যত বেশি, সুখ, আমি যে কার, ব্যাপারটা, হাসপাতালে, মানুষ বনাম অমানুষ (সুখ, এলআরবি), দুঃখিনী, জারজ সন্তান (তবুও, এলআরবি), বেইলি রোড, হায় স্বাধীনতা, মাত্র ১০ দিন (ঘুমন্ত শহরে, এলআরবি), হৃদয়ের ভগবান (স্বপ্ন, এলআরবি), সাড়ে তিন হাত মাটি, ভালো লাগে না, প্রজাপতি, ভবের দেশে, আয়না এবং আমি (আমাদের?, এলআরবি), স্বপ্ন বদল, মন পুড়ে ছাই হয়, স্মৃতি, মেলামেশা (বিস্ময়!, এলআরবি), কতদিন দেখিনি তোমায় (অচেনা জীবন, এলআরবি), প্রতারক চোখ (ধ্বনি, আইয়ুব বাচ্চু), তখনো জানতে বাকি (ঝড়, আইয়ুব বাচ্চু), নীল মলাট, পাগল (চমক, এলআরবি), এখন অনেক রাত (টুগেদার, আইয়ুব বাচ্চু), আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে ‘লোকজন কমে গেছে’, যে মানুষটি (ধুন, এলআরবি), ইচ্ছের পালক, ঝড়ের রাতে, ঢাকার প্রেম, তোমাকে খুঁজি (জেল থেকে বলছি, ফিলিংস), সাদা অ্যাস্ট্রে, ভুলবো কেমন করে (পালাবে কোথায়, জেমস), জন্ম, অজন্তার সুখ-দুঃখ, ঠিকানাবিহীন চিঠি (জন্ম, দ্য কিউ), গ্রহান্তরী ভালোবাসা, স্বপনের চৌকাঠে (গ্রহান্তরী ভালোবাসা, রেশাদ), আমার ঘড়ির ঘণ্টাগুলো (ইচ্ছে করে, রেশাদ), বিবাগী রাতে (বিবাগী রাতে, নীলয় দাস), দেখা হবে না (দেখা হবে না, জুয়েল)-সহ আরো অনেক গান।
*গানের তালিকা সহযোগিতায় ও কৃতজ্ঞতায়: মো. ফেরদৌস ভাই (এলআরবি ও এবি) ও জাহাঙ্গীর আকরাম ভাই।