Select Page

অন্তর্দহনের সেলুলয়েড

অন্তর্দহনের সেলুলয়েড

১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দহন’ সিনেমার পোস্টার, নামলিপি ও দুই নায়িকা ববিতা-ডলি আনোয়ারের পেপার কাটিং।

দহন
পরিচালক – শেখ নিয়ামত  আলী
অভিনয় – হুমায়ুন ফরীদি, ববিতা,  আসাদুজ্জামান নূর, বুলবুল  আহমেদ, রওশন জামিল,  আবুল খায়ের, ডলি  আনোয়ার,  আহসান আলী সিডনি, প্রবীর মিত্র, ফখরুল হাসান বৈরাগী, শর্মিলী  আহমেদ,  আশীষ কুমার লোহ প্রমুখ।
মুক্তি – ২৭ নভেম্বর ১৯৮৫

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীনতার  আগের থেকে  আরো বেশি সংগ্রামী জীবন কাটাতে হয়েছে মানুষকে। স্বাধীন দেশে কর্মসংস্থান যখন খুব কম ছিল পরিবারগুলো একটা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল। পরিবারকে বাঁচাতে কেউ সৎ থেকে কাজ পেত না  আর কেউ অসৎপথে প্রতিষ্ঠা পেত। কেউ  আগে থেকে বংশীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে তখন একটা ঘোলাটে অবস্থা চলছিল। একজন ব্যক্তির নিজের জগৎ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, প্রেম সবকিছু একটা গোলকধাঁধার ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে ভেতরে ভেতরে দহন সৃষ্টি করত। ‘দহন’ সেই ব্যক্তিমানুষের ছবি যার জগতটা বড় নিঃসঙ্গ।

শেখ নিয়ামত  আলী-র এ ছবিটি মুক্তির পর চলচ্চিত্র সমালোচকরা বেশ নড়েচড়ে বসেছিলেন। একটা ‘textual film’ হিশাবে বিশ্লেষণ শুরু হয়েছিল। সমাজ ও সমকালকে এত কাছ থেকে দেখানো হয়েছে যে এর পরতে পরতে ছবির শক্তিশালী বক্তব্য লুকিয়ে ছিল। যে বক্তব্যগুলো রূঢ় বাস্তবতা যেমন দেখিয়েছিল তেমনি চপেটাঘাত করেছিল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।

মধ্যবিত্তের বেদনা থেকে একটা পরিবারের গল্প শুরু। সেখানে মূল চরিত্র মুনীর বা হুমায়ুন ফরীদি টিউশনি  আর ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করে জীবিকা চালায়। কোনোমতে টেনেটুনে চলে সংসার। চাকরির চেষ্টা করছে কিন্তু হচ্ছে না। মামা  আবুল খায়ের রাজনীতি করত একসময় পরে রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে পাগলের মতো  আচরণ করে। বোন ডলি  আনোয়ার ছবি  আঁকে। তার ছবি  আঁকার রং ঠিকমতো কিনে দিতে পারে না ভাই। বোনের সামনে দাঁড়াতেও লজ্জা করে ফরীদির। বন্ধু  আসাদুজ্জামান নূরের কাছে মাঝে মধ্যে ধার করে। টিউশনি করতে যায় ববিতার বাসায়। ববিতাকে সোশিওলজি পড়ায়। কিন্তু ববিতার সোশিওলজিতে মন নেই কারণ সে ফরীদিকে ভালোবাসে। অন্যমনস্ক দেখা যায় তাকে। ববিতার ভাই বুলবুল  আহমেদ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। তার স্ত্রী শর্মিলী  আহমেদ। তাদের কোনো সন্তান নেই।  আবুল খায়ের একসময় নিখোঁজ হয় রাজনীতির ভণ্ডামি কেন হয় উত্তর খুঁজে বেড়ায় রাজপথে, অলিতে গলিতে। ফখরুল হাসান বৈরাগী  আদম পাচারের সাথে জড়িত। ফরীদি তার বন্ধু। একবার ফরীদিকে কৌশলে ব্যবসায় ঢোকাতে চায় কিন্তু ফরীদি সব দেখে বুঝে সায় দেয় না। ববিতা-ফরীদির সম্পর্ক টেকে না ফরীদির বেকারত্ব  আর পরিবারের দায়িত্বের জন্য। ববিতার বিয়ের দিন ফরীদিকে দেখা যায় কাঁটাতারের বেড়ায় নিজেকে  আহত করছে। ডলি  আনোয়ারও  আহসান  আলি সিডনিকে ভালোবেসে পায় না। এছাড়া রয়েছে আরো কিছু বাস্তবতা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সব উঠে  আসে এক সেলুলয়েডে যেখানে দহনটা নিজের ও অনেকের।

শেখ নিয়ামত  আলী-র সিনেমাটিক অবজারভেশন হাই লেভেলের। হুমায়ুন ফরীদির কথক চরিত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের চালচিত্র তুলে ধরেছেন একেবারে গোড়া থেকে। দেশে দুই শ্রেণির বসবাস তখন মোটের উপর। প্রথম শ্রেণি ছিল অবহেলিত  আর দ্বিতীয় শ্রেণি পুঁজিবাদী সুবিধাভোগী। এ দুই শ্রেণির মধ্যে মধ্যবিত্তকে একেবারে গোড়া থেকে সবচেয়ে বেশি মনে মনে বিষাক্ত বাস্তবতা হজম করতে হয়েছিল। কারণ নিম্নবিত্ত দিন  আনে দিন খায়  আর উচ্চবিত্ত  আছে অর্জিত সম্পদকে  আরো বাড়ানোর ধান্দাবাজিতে। মাঝখানে পড়ে মধ্যবিত্ত বাস্তবতার ঠোকর খেতে খেতে শেষ হয়ে যাবে তবু  আত্মসম্মান বিসর্জন দেবে না।  আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার লড়াইতে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হুমায়ুন ফরীদি। ফরীদির কিছু অবজারভেশন শহুরে জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা সামাজিক বাস্তবতাকে দেখায়। যেমন –

১. মেসার্স পাণ্ডবের কনস্ট্রাকশন কাজের অবস্থা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ফরীদি। একদিকে মধ্যবিত্ত জ্বলেপুড়ে মরছে অন্যদিকে নতুন নতুন হাইরাইজ বিল্ডিং উঠছে। সমাজে দুই শ্রেণির অসম অবস্থান এ দৃশ্যটির অর্থ।

২. ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একটা ছেলেকে ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খেতে দেখে ফরীদি। নিম্নবিত্তের করুণ অবস্থা দেখে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার থেকে করুণ বাস্তবতায় অনেকে  আছে এটা বোঝায় দৃশ্যটি।

৩. ফরীদি রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে দালাল  আশীষ কুমার লোহকে দেখে ঝাড়ু দেয়া একটা মেয়েকে টাকা সাঁধছে। টাকা নিয়ে সাবান কিনতে বলে। উদ্দেশ্য যে  আলাদা সেটা বুঝতে পারে মেয়েটি। পরে দেখা যায় মেয়েটি প্রতিবাদ করে কারণ এর  আগে সে ঠকেছে। চলে গেলে  আশীষ কুমার রাস্তায় থাকা প্রিন্সেস ডায়নার ছবিতে চুমু খেতে গিয়ে থু থু দেয়। সামাজিক ব্যাধির চিত্র এটা।

৪. রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে দেখে রিকশাওয়ালার সাথে যাত্রীর কথা কাটাকাটি চলে। এক পর্যায়ে ছোটলোক বলে চড় মারে রিকশাওয়ালাকে তারপর যাত্রীটি বলে-‘যা দেব তাই নিবি।’ এ কথাটি ফরীদি শোনে এবং সেটা একটা বাস্তবতা হয়ে যায়। নিম্নবিত্তরা মার খাওয়াতে বেশিরভাগ অভ্যস্ত কারণ পেশীশক্তির সাথে তারা পারে না।

৫. বাড়িতে রান্না হয় নি সবাই না খাওয়া তখন ফরীদির কানে  আসে পাশের বিল্ডিং থেকে ওয়েস্টার্ন মিউজিক ভেসে  আসছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথার চুল নাড়ে ফরীদি। সামাজিক বৈষম্যটা ঐ দৃশ্যে পাশাপাশি চলে  আসে।

৬. ফরীদি সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলতে চায় পড়ার টেবিলে। ডলি  আনোয়ার বাধা দেয়। লোকের জোর ছাড়া চাকরি হয় না জানায়। নূরের সাথে পরামর্শ করে ব্যবসা করার কথা চিন্তা করে। দুজনের কথার মধ্যে দেয়ালে দেখা যায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছবি। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ লাইনটি তখন এমনিতেই চাক্ষুষ সত্য হয়ে ওঠে।

৭. রাস্তায় বানরের নাচ দেখানো হচ্ছিল সেখানে মানুষের বিবর্তন নিয়ে কথা বলে লোকটি। ফরীদি দাঁড়িয়ে দেখে  আর ভাবে মানুষ তখন অনেক বদলে গেছে।

৮. ফখরুল হাসান বৈরাগী  আদম পাচারের সাথে জড়িত। ফরীদি তার সাথে ঘোরার সময় সব পরিষ্কার হয়। টের পায় অভাবের দেশে নিজের সমৃদ্ধির জন্য কাছের বন্ধুটাও অসৎ পথে চলে গেছে। যে কাজ ফরীদির কাছে খারাপ বৈরাগীর ভাষায় সেটা ছিল ‘প্রফিট্যাবল বিজনেস।’

৯. ফরীদি একটা লেখা নিয়ে পত্রিকায় যায়।  আগের লেখার বিল নেবার  আগে সম্পাদক তাকে ছাপ জানিয়ে দেয় বুদ্ধিবৃত্তিক লেখা লোকজন কম পড়ে। সেক্স, ভায়োলেন্স, ক্রাইম এসব টপিকে লিখলে লোকজন পড়ে ভালো। ফরীদি অস্বস্তি বোধ করে এবং বুঝতে পারে সম্পাদকদের নৈতিকতাও শেষ হয়ে গেছে ততদিনে।

১০. সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ আগ্নেয়গিরি’ কবিতা  আবৃত্তির সময় নিজের সাথে নিজের মানসিক যুদ্ধ চলে ফরীদির।

এভাবে হুমায়ুন ফরীদি স্বাধীন দেশ পরবর্তী নির্মম সামাজিক বাস্তবতার একটা স্বাক্ষী হয়ে ওঠে ছবিটি।

দহন (১৯৮৫)

ডলি  আনোয়ার ও সিডনি ভালোবাসার সম্পর্কে ছিল। সিডনি মত পরিবর্তন করে জানায় ভালোবাসলে বিয়ে করতে হবে এমন কথা নেই। পরে ডলি  আনোয়ারের ভাগ্য খারাপ হয়। সংসদ ভবনের পথে একা দাঁড়িয়ে কাঁদা ডলি  আনোয়ার নিজের উপর অবিচারের বিচার নীরবে চায় সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখানো হয় যা অসাধারণ।

আসাদুজ্জামান নূর তার মতো করে সচ্ছলতা  আদায় করে নেয়। হুমায়ুন ফরীদি তার বন্ধু। অভাবের দিনে তাকে সাহায্য করে এবং চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যবসা করার পরামর্শ দেয়। মূলধন সে দেবে জানায়। নূরের চরিত্রটি ছিল সমপর্যায়ের বন্ধুত্বে একে অপরকে বোঝার মতো একটি চরিত্র।

প্রেম ও সমাজকাঠামোকে এক কাতারে দেখানো হয়। ববিতাকে পড়াতে  আসে ফরীদি কিন্তু তার পড়ায় কোনো মন নেই। দেখা যায় সোশিওলজি বোঝাতে গিয়ে ববিতার কাছে বেড়াতে যাবার প্রস্তাব পায় ফরীদি। বেড়াতে গিয়ে ববিতা জানায় ফরীদিকে সে পছন্দ করে। ফরীদি সরাসরি জানায়-‘তোমার খুব সাহস।’ হাঁটতে হাঁটতে সামনে দিয়ে একটা খোঁড়া লোক হাঁটতে দেখলে তাকে নিয়ে টপিক বানায় ফরীদি। ফরীদির কাছে লোকটি একজন দুর্ভাগ্যবান  আর ববিতার কাছে লোকটি একজন প্রেমিক। দুজনের দুই রকম প্রেডিকশন দেখে বোঝা যায় তাদের মতাদর্শ। ববিতা ছিল উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি তাই হেয়ালিপনা তার স্বভাবে ছিল।

রাজনীতিকে সরাসরি  আক্রমণ করা হয়েছে ছবিতে। রাজনীতিকে সুবিধাভোগী রাজনীতিবদরা কিভাবে ব্যবহার করে সেটাকে তুলে ধরা হয় ধারালোভাবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যে স্থানটি ছিল রাজনীতিবিদদের ভাষণ দেবার স্থান। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে অসৎ রাজনীতিবিদদের উত্থান হয়েছিল যারা মিটিং মিছিল করত নিজেদের জন্য। ফরীদি ও বৈরাগী পাশের ব্রিজে  আলাপ করছিল :

বৈরাগী – লোকজন নেই  আর মিটিং করে কি হবে। এভাবে রাজনীতি হয় না।
ফরীদি – এদেশে  আবার রাজনীতি  আছে নাকি?

তারপর একটা মঞ্চে ভাষণের জন্য প্রস্তুতি নিতে দেখা যায় এক নেতাকে। সামনের লোকজন অধৈর্য হয়ে বলে-‘বললে বলেন না হলে চইলা যাই।’ তখন এক টাক মাথাওয়ালা লোককে চিরুনি দিয়ে মাথা  আঁচড়াতে দেখা যায়। এ দৃশ্যটি ছিল কড়াভাবে অসৎ নেতাদের লোক দেখানো রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা ধারালো প্রতিবাদ। পাশাপাশি  আবুল খায়ের নিখোঁজ হয়  আর রাস্তায় রাস্তায় নিজের ত্রিশ বছরের রাজনীতির ব্যর্থতা নিয়ে প্রতিবাদ জানায়। কুয়েত এয়ারলাইন্সের বিলবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-‘দেশের লোকজনকে তোমরা কি পেয়েছ? হাতের পুতুল?’  আবুল খায়ের এ ছবিতে ১৯৮৫ সালের শ্রেষ্ঠ সহশিল্পী হিশাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

হুমায়ুন ফরীদি পুরো ছবিতে ন্যাচারালি তাঁর অভিনয়জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছেন। কথক হয়ে নিজের চোখে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তিন প্রেক্ষিতে ব্যক্তির অন্তর্দহন দেখানো হয়েছে ফরীদির মাধ্যমে। ববিতাকে ফিরিয়ে দেবার পর যেদিন ববিতার বিয়ে হচ্ছিল ফরীদি খোলা জায়গায় দৌড়াতে থাকে। পেছনে ট্রেন চলছে। ফরীদি কাঁটাতার বেড়া ছিঁড়তে থাকে। ক্লান্ত হবার পরে একটু বিশ্রাম নিয়ে  আবার ছিঁড়তে থাকে। ফরীদির কাঁটাতারের বেড়া ভাঙা বা ছেঁড়ার মাধ্যমে অন্তর্দহন থেকে ব্যক্তির সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভাঙার চেষ্টাকে দেখানো হয়। এটা ছিল নির্মাতার চেতনা, দর্শন।

‘দহন’ ছবিটি সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছিল। সমালোচক ও সুধীমহলে খুব প্রশংসিত হয়। এটি ১৯৮৫ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। সে বছর বাচসাস পুরস্কারে বিভিন্ন শাখায় ১২টি পুরস্কার লাভ করে। চেকোশ্লোভিয়ার কার্লোভেরি চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি উৎসব কমিটির পুরস্কার লাভ করে।

সব মিলিয়ে মাস্টওয়াচ ছবি।


Leave a reply