Select Page

অন্তর জ্বালা ও মালেক আফসারী

অন্তর জ্বালা ও মালেক আফসারী

মালেক আফসারীকে হয়ত এ প্রজন্মের সিনেমার দর্শকদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কারন সালমান শাহ্‌ এর মৃত্যুর পরের প্রজন্মের একটা অংশ সম্পূর্ণ রকম প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ হয়ে পড়ে তবে নায়ক মান্না সালমান পরবর্তী প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ দর্শকদের কিছু অংশ প্রেক্ষাগৃহে টানতে পেরেছে কিন্তু তাদের অধিকাংশই সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণী আর এভাবেই সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীকে নিয়ে নায়ক মান্নার একটা ক্লাস গড়ে উঠেছে। মালেক আফসারীর অন্তর জ্বালার ট্রেইলার দেখেই মনে হয়েছিল তিনি দুই শ্রেণীর দর্শকদেরই প্রেক্ষাগৃহে টানতে চেয়েছেন।

মান্নার নাম ব্যাবহার করে সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীকে যারা সিনেমা হলগুলোকে এতদিন বাচিয়ে রেখেছে আর নির্মাণ শৈলী দিয়ে উচ্চবিত্তকে যারা এখন আস্তে আস্তে সিনেমা হলে আসছেন তবে সিনেপ্লেক্স ছাড়া সাধারণ কোন সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে লজ্জা পাচ্ছেন বা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখছেন কিংবা বাংলা সিনেমার কোন পোস্টার নিয়ে সেলফি দিচ্ছেন এগুলোকে তাদের ক্লাসের পরিপন্থী মনে করছেন। আর এরকম একটা নান্দনিক চিন্তার সফল চিত্রায়ন মালেক আফসারীর মত গুণী একজন নির্মাতার পক্ষেই সম্ভব। তবে এতে তিনি কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছেন সেটা সময় বলবে কিন্তু শুরুর বাজি তিনি ঠিকই জিতেছেন। “অন্তর জ্বালা” এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া সিনেমা যার সংখ্যাটা ১৭৫। এর আগে এই রেকর্ডটি ছিল শাকিব খান অভিনীত “রাজা বাবু” সিনেমার যার প্রেক্ষাগৃহ সংখ্যা ছিল ১৬৫। এই সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার জন্য দেশে ১৭ টি বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রেক্ষাগৃহ আবার চালু হচ্ছে এই খবর ও পাওয়া যাচ্ছে। তাই গুণী নির্মাতা মালেক আফসারীর “অন্তর জ্বালা”র শুরুটা রাজকীয়ইই বলা চলে। (সব শেষ খবর হলো সিনেমাটি হল পায় ১১২টি – বিএমডিবি)

প্রশ্ন থাকতে পারে, কেন মালেক আফসারীকে গুণী বলছি? একটি গানের কথা মনে আছে – “একটু হেসে বলনা বুবু কেমন হবে, এক গাড়িতে পরিবারের সবাই রবে”? হ্যা, এটা সালমান শাহ অভিনীত “এই ঘর এই সংসার” সিনেমার গান যা আজ অবদি মালেক আফসারীর মাস্টার পিস বলে বিবেচনা করা হয়। হ্যা, এই সিনেমাটা কলকাতায় ও রিমেক হয়। শুধু এটাই নয় ১৯৮৩ সালে তার তার প্রথম নির্মাণ “ঘরের বউ” সিনেমাটাও অভাবনীয় বাণিজ্যিক সাফল্যের পর কলকাতায় রিমেক হয়। ১৯৮৯ সালে তার “ক্ষতিপূরণ” সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা নায়ক হিসেবে আলমগীর ও গায়ক হিসেবে এন্ড্রূকিশোর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেন। সম্ভবত তিনিই গতানুগতিক বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া পরিচালক যিনি প্রায় ১৫ লাখ করে নেন প্রতি সিনেমায়। তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কালো অধ্যায় শুরু হয় ১৯৯৮ সালের পর থেকে। নিজেকে পুরুপুরি অশ্লীলতার চাদরে মুড়িয়ে ফেলেন তিনি। তাই আস্তে আস্তে এই প্রজন্মের কাছে মালেক আফসারীর মত একজন গুণী নির্মাতার নাম মুছে যেতে থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়াসই হয়ত “অন্তর জ্বালা”।

ক্রিকেটে একটা কথা আছে, Form is temporary but class is permanent”. হ্যা মালেক আফসারী তার অন্তর জ্বালা সিনেমা দিয়ে আবার তার জাত চিনিয়েছেন। প্রথম থেকেই প্রচন্ড সাসপেন্স দিয়ে শুরু করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সেটা ধরে রেখেছেন। সিনেমার স্পেসের পরিমিত ব্যাবহার কিভাবে করতে হয় তার জন্য বাংলা সিনেমায় এটা একটা মাস্টার ফিল্ম। গতির দোলায় মন দুলছিলো পুরো সিনেমা হল জুড়ে।

গল্পের কাহিনী বিন্যাস প্রশংসার দাবিদার। বাংলা সিনেমায় সাধারনত ন্যারেটিভ স্টাইল খুব একটা দেখা যায় না যা এ সিনেমায় খুব ভালো করে উপস্থাপন করা হয়েছে। গ্রাম-বাংলার ভিজে মাটির গন্ধ অনেকদিন পর মনে হলো কেউ পাকা হাতে সেলুলয়েড বন্দি করতে সক্ষম হয়েছেন। এখনকার সিনেমাগুলোতে পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়ন এর গল্প খুব একটা চোখে পড়ে না যা “অন্তর জ্বালা”য় খুব ভালো ফুটে উঠেছে। সিনেমায় মূলত আলাল আর দুলাল নামে দুই ভাইয়ের গল্প সমান্তরাল গতিতে চলতে থাকে। তবে আলাল আর তার প্রেমিকা সোনামনির অংশটা যতটা যত্নসহ চিত্রিত করা হয়েছে দুলাল আর তার প্রেমিকার অংশটাতে ততটা যত্ন খুজে পাওয়া যায়নি। দুলালের এর অংশটাতে বারবার সুড়সুড়ি  দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করা হয়েছে যা নান্দনিকতা বিবর্জিত। সাথে যুক্ত হয়েছে যৌন সুড়সুড়ি  আনার চেষ্টা যা এই সিনেমার সবচেয়ে বিরক্তিকর অংশ ছিলো। বিশেষ করে “মধু হই হই বিষ খাওয়াইলি” গানটা অসম্ভব কুরুচিপূর্ণ ইংগিতে পরিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। মালেক আফসারী হয়ত সিনেমার দুলাল অংশটাতে নিজের উপর আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়েছেন তাই সস্তা যৌন সুড়সুড়ি আর জোর করে হাসানোর নীতি অবলম্বন করে প্রডিউসারকে মানিব্যাক গ্যারান্টি দিতে চেয়েছেন।

চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে বলতে গেলে বলতে হয় জায়েদ খানকে আলাল এর চরিত্রে যতটা ভাঙা হয়েছে পরী মনিকে সোনামনির চরিত্রে ততটাই মৌলিক রাখা হয়েছে। পরী মনির পোশাক তার চরিত্রের সঙ্গে একদম যাচ্ছিলো না। তার ক্লাসের চেয়ে বেশি ফিটফাট মনে হচ্ছিলো তাকে। এখানে হয়ত মালেক আফসারী রুচিবান দর্শকদের রুচির উপর আস্থা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ জায়েদ খানের চরিত্র ভেঙে তিনি প্রমান করেছেন যে তিনি চাইলে অনেক কিছু পারেন আর পরী মনিকে তার মত রেখে হয়ত বুঝিয়েছেন তার সীমাবদ্ধতাকে, মানে চলচ্চিত্রকার চাইলেও দর্শকের রুচির কথা ভেবে অনেক কিছুই করতে পারেন না। নায়িকা দেখতে বিশ্রী হলে দর্শক ছবি খাবে না এই ভয় পরী মনিকে ভাঙতে হয়ত বাধা দিয়েছে তার মন। তাই পরী মনি আর সোনা মনি হয়ে উঠতে পারেনি যেমনটা জায়েদ পেরেছেন আলাল হতে। তবে দুজনের অভিনয়ই প্রশংসার দাবিদার। দুলাল চরিত্রটা দিয়ে কমেডি করার চেষ্টা করা হয়েছে যেখানে আফসারী খুব একটা মুন্সীয়ানার পরিচয় দিতে পারেননি তবে তার প্রেমিকাকে দিয়ে যে মসলা চরিত্র করতে চেয়েছেন সেখানে তিনি সম্পূর্ণ সফল। খল চরিত্রে ইদানিং অমিত হাসান ফাটাফাটি করছেন এখানেও কম যাননি। কাঁপিয়ে অভিনয় করেছেন। আলালের বাবার চরিত্রটাকে একটু বেশি একরোখা আর অবাস্তব মনে হয়েছে।

ক্যামেরা, লাইটিং, ফ্রেমিং ও সেট ডিজাইন প্রশংসনীয় ছিলো। বিশেষ করে শুরুর দিকের গ্রামের পিচ্চিদের গানের অংশটা; শুরুর খুনের সিনটার সেট ডিজাইন ও লাইটিং; শেষ ফাইটিং এর সেট ডিজাইন ও লাইটিং, প্রেক্ষাগৃহের ছোট চতুষ্কোণাকার ছিদ্র দিয়ে জায়েদ খানের পরী মনিকে দেখার ফ্রেমিং, তাদের ইশারায় কথোপকথন; পরীমনির ৩৫ এম, এম ফিল্মের জামা পরা; জায়েদ খানকে ফাসিতে ঝুলানোর মুহূর্তের লাইটিং ও সাসপেন্স; মুসলিম জায়েদ খানের সাথে হিন্দু পরী মনির সম্পর্কের কারনে পরী মনির মায়ের থাপ্পরে গালে কালি মেখে যাওয়ার সিনটা ইত্যাদি ইত্যাদি। “ছোট ছোট কিছু আশা জমেছে এ মনে”- গানটা শ্রুতি মধুর হলেও দৃশ্যায়নের গ্রীন ক্রোমাটা ভালো হয়নি। একটু আলগা আলগা মনে হচ্ছিলো। দুলালের অংশে সিনেমাটা একদম পড়ে যাচ্ছিলো। যদিও কাহিনী সমান্তরাল গতিতে আগাচ্ছিলো তবে গতির সমতা থাকছিলো না দুলালের অংশে।

পরিশেষে, কিভাবে কমেডি, যৌনতা ও আবেগ মিশ্রিত পারিবারিক কাহিনী নিয়ে একটা পুরোপুরি বাণিজ্যিক মিক্স বানানো যায় যা থেকে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সবাই আনন্দ পেতে পারে – তার জন্য “অন্তর জ্বালা”একটি মাস্ট রিড ফিল্ম।


Leave a reply