অলরাউন্ডার আলীরাজ
আলীরাজ..
নামটা সিলেক্টিভ। একটা ভারিক্কি স্বাদ আছে। নায়করাজ রাজ্জাকের হাত ধরে আগমন। আলীর পরে নায়করাজের ‘রাজ’ যোগ করে একটা সুন্দর নাম দেয়া হয় তাঁর। তাঁর সময়টা ছিল এদেশের চলচ্চিত্রের উত্তরণের সময়। তখন একাধারে দেশের ছবিতে সব ধরনের ছবির জয় হচ্ছিল একের পর এক।
তাঁর জন্ম ১৫ মার্চ ১৯৫৭ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায়।
আলীরাজের পুরো অভিনয় জীবন বিশ্লেষণ করা নেহায়েৎ সহজ হবে না। তার ক্যারিয়ার বড়। চড়াই-উৎরাই প্রত্যেক তারকার থাকে তারও ছিল। তবে তাকে বিশ্লেষণের জন্য অতীতে যে ধরনের লেখা চোখে পড়েছে রাজ্জাকের সূত্র ধরে বা তিনি এনেছেন তাই অভিনয়টা শক্তিমান ছিল এমন ধারণা চালু ছিল। কিন্তু তা মোটাদাগে ভুলকে দেখায় বড় করে। নায়করাজ রাজ্জাক তাঁকে এনেছেন সেটা তার প্লাস পয়েন্ট কিন্তু অভিনয়ের সংগ্রামটা তাকেই করতে হয়েছে। তিনি সেখানে সফল। নাটক দিয়ে কাজ শুরু করেন অভিনয়ে তখন তাঁর নাম ছিল ডব্লিউ আনোয়ার। তাঁর অভিনয় ক্যারিয়ার এখনো চলছে এবং ইন্ডাস্ট্রির বড় একটা সময় তিনি পাশে ছিলেন। যখন শিল্পী সংকট চরম আকার ধারণ করল সে সময়টা তিনি ছায়ার মত থাকলেন।তার ক্যারিয়ারকে তাই এভাবে একটা ক্লাসিফিকেশনে রাখা যায় –
* রাজ্জাক আমল
* নব্বই দশকের স্বর্ণসময়
* একুশ শতকের প্রথমার্ধ্ব
* শাকিব আমল
* ডিজিটাল আমল
তাঁর অভিনীত ছবি সমূহ :
১।সৎ ভাই ২।প্রাণের মানুষ ৩।গোলাপী এখন বিলাতে ৪।আমি তোমারি ৫।কাজের মেয়ে ৬।স্বামী নিয়ে যুদ্ধ ৭।দবির সাহেবের সংসার ৮।আশিকী ৯।অগ্নি ১০।সেয়ানা পাগল ১১।অচেনা ১২।বড়ভাই জিন্দাবাদ ১৩।পাহারাদার ১৪।সম্মান ১৫।চাচ্চু ১৬।দাদীমা ১৭।পিতার আসন ১৮।এক বুক জ্বালা ১৯।স্বামীর সংসার ২০।পোড়ামন ২১।ভালোবাসার রঙ ২২।ডেনজার ২৩।কুলির সর্দার ২৪।ক্ষমতার দাপট ২৫।নগ্ন হামলা ২৬।মা বড় না বউ বড় ২৭।ছেলেকার ২৮।শাদী মোবারক ২৯।সন্তান আমার অহংকার ৩০।আমাদের ছোটসাহেব ৩১।সন্তানের মত সন্তান ৩২।অসিরন কেন ঢাকায় ৩৩।আমার দেশ আমার প্রেম ৩৪।রাজনীতি ৩৫।বাংলার কমান্ডো ৩৬।দারোয়ানের ছেলে ৩৭।পালাবি কোথায় ৩৮।বন্ধু তুমি আমার ৩৯।সবার উপরে তুমি ৪০।নিঃশ্বাস আমার তুমি ৪১।পদ্মা মেঘনা যমুনা ৪২।এখনো অনেক রাত ৪৩।ভালোবাসলেই ঘর বাধা যায় না ৪৪।ছুঁয়ে দিলে মন ৪৫।রোমিও বনাম জুলিয়েট ৪৬।ভালোবাসা আজকাল ৪৭।লাভার নাম্বার ওয়ান ৪৮।বস নাম্বার ওয়ান ৪৯।নাম্বার ওয়ান শাকিব খান ৫০।জীবন মরনের সাথী ৫১।কে আমি ৫২।সাবধান সন্ত্রাসী ৫৩।এরই নাম দোস্তী ৫৪।এই ঘর এই সংসার ৫৫।চোরের বউ ৫৬।সহযাত্রী ৫৭।বেনাম বাদশা ৫৮।তুখোড় ৫৯।তুই আমার ৬০।সত্যিকারের মানুষ ৬১।আড়াল ৬২।ধূমকেতু ৬৩।পুড়ে যায় মন ৬৪।চুপি চুপি প্রেম ৬৫।দুই পৃথিবী ৬৬।আই ডোন্ট কেয়ার ৬৭।পুত্র এখন পয়সাওয়ালা ৬৮।কি প্রেম দেখাইলা ৬৯।চিনি বিবি ৭০।কঠিন প্রতিশোধ ৭১।সেরা নায়ক ৭২।অনেক সাধের ময়না ৭৩।জোর করে ভালবাসা হয় না ৭৪।নিষ্পাপ মুন্না ৭৫।স্বামী ভাগ্য ৭৬।মাই নেম ইজ সুলতান ৭৭।মাটির ঠিকানা ৭৮।হায় প্রেম হায় ভালোবাসা ৭৯।প্রেমে পড়েছি ৮০।টাকার চেয়ে প্রেম বড় ৮১।প্রেমিক পুরুষ ৮২।আমার স্বপ্ন আমার সংসার ৮৩।বিয়ে বাড়ী ৮৪।বলোনা কবুল ৮৫।চিরদিন আমি তোমার ৮৬।মন যেখানে হৃদয় সেখানে ৮৭।জন্ম তোমার জন্য ৮৮।আদরের ছোট ভাই ৮৯।পাগলা দিওয়ানা ৯০।বাবা আমার বাবা ৯১।এ চোখে শুধু তুমি ৯২।তুমি আমার প্রেম ৯৩।মা আমার স্বর্গ ৯৪।ময়দান ৯৫।ওদের ধর ৯৬।ডন ৯৭।১০ নাম্বার মহা বিপদ সংকেত ৯৮।জানোয়ার ৯৯।অন্ধকার জীবন ১০০।হুংকার ১০১।শেষ আঘাত ১০২।আজকের দাপট ১০৩।গণ দুশমন ১০৪।দেশ দুশমন ১০৫।গোলামীর জিঞ্জির ১০৬।সুখের আগুন ১০৭।দিন মজুর ১০৮।জ্বলন্ত আগুন ১০৯।দংশন ১১০।রাঙামন ১১১।চার অক্ষরে ভালোবাসা ১১২।ভয়ংকর নারী ১১৩।জানেনা এ মন ১১৪।মুন্না মাস্তান ১১৫।এক মন এক প্রাণ ১১৬।অবাধ্য সন্তান ১১৭।জ্যান্ত কবর ১১৮।ইবলিশ ১১৯।বাঁশিওয়ালা ১২০।স্পট ডেড ১২১।১ নাম্বার আসামী ১২২।মায়ের হাতের বালা ১২৩।রাজু আমার ভাই ১২৪।জিরো জিরো সেভেন ১২৫।জোছনার প্রেম ১২৬।বাজার ১২৭।দুরন্ত প্রেমিক ১২৮।আজকের শয়তান ১২৯।ইনকিলাব ১৩০।কৈফিয়ত ১৩১।বেনাম বাদশা ১৩২।আমার জান ১৩৩।গৌরব ১৩৪।টোকাইর হাতে অস্ত্র কেন ১৩৫।গুটিবাজ ১৩৬।তের পান্ডা এক গুন্ডা ১৩৭।হট লাইন ১৩৮।চশমখোর ১৩৯।জ্যান্ত লাশ ১৪০।ভুল সবই ভুল ১৪১।মায়ের জন্য মরতে পারি ১৪২।সর্দার ১৪৩।লাল বেনারসী ১৪৪।লাষ্ট টার্গেট ১৪৫।অন্তর জ্বালা ১৪৬।চক্রান্ত ১৪৭। মূর্খ মানব ১৪৮। বিয়ের প্রস্তাব
সেকালের আলীরাজ ডিজিটাল সিনেমায় পাল্টে গিয়ে আলাদা ইমেজে দর্শকের সামনে হাজির হয়েছে। শাকিব আমলে বাবার চরিত্রই তাকে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। যেমন – ‘খোদার পরে মা। ‘ডিজিটালে নিজেকে পাল্টে খলনায়ক হয়েছে।
আলীরাজের প্রথম ছবি ‘সৎভাই।’ নায়করাজ রাজ্জাকের পরিচালনায় ছিল। প্রথম ছবিতেই স্বভাবসুলভ ন্যাচারাল অভিনয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দর্শকের। পারিবারিক দূরত্ব ও মিলনের গল্পে ছবিটি বাস্তবসম্মত। পরে ‘সন্তান যখন শত্রু’ নামে আবার নির্মিত হয় রাজ্জাকের পরিচালনায়। তাঁর ভূমিকায় ছিল ফেরদৌস।’ এখনো অনেক রাত’ ছবিটি তাঁর পুরো ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ। এ ছবিতে মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে তার অবস্থান ভিন্নমাত্রা আনে। আগুনের গাওয়া ‘ও আমার জন্মভূমি তুই স্বাধীন হবি কবে’ গানটিতে তার স্যাড এক্সপ্রেশন মনে রাখার মতো। ‘চারিদিকে শত্রু’ ছবিতে প্রতিবন্ধী আলীরাজের ক্যারেক্টারটি খুব টাফ জব ছিল তার জন্য এবং তিনি খুব ভালোভাবেই পেরেছেন সেটা ফুটিয়ে তুলতে। বিশেষ করে তাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করার সময় দৌড় দেয় আর প্রতিবন্ধীর মুভমেন্টগুলো তখন দেখার মত লাগে। অনেকেই হয়তো সহজ ভাববে ক্যারেক্টারটিকে কিন্তু মোটেই তা নয়। ‘বাঁশিওয়ালা’ ছবিতে কবিতার বিপরীতে ছিল। এ ছবিতে ‘ভালোবাসি বলে রে বন্ধু আমায় কাঁদালে’ গানে ছিল আলীরাজ। ‘পালাবি কোথায়’ ছবিতে চম্পার স্বামীর চরিত্রে অসাধারণ ছিল। ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে’ গানটা গায় আর রিকশা চালায়। ‘ভেজা চোখ’ ও ‘সহযাত্রী’ ছবিতে ছিল ইলিয়াস কাঞ্চনের বন্ধু। ‘ভেজা চোখ’ ছবির ‘তুই তো কাল চলে যাবি আমাকে ছেড়ে’ গানটিতে কাঞ্চন-আলীরাজ বন্ধুত্ব ক্লাসিক হয়ে গেছে। ‘বাংলার কমান্ডো’ ছবির কথা আর কী বলব! এ সিনেমায় ডাকাত হুমায়ুন ফরীদিকে ধরতে যায় ইন্সপেক্টর আলীরাজ কিন্তু ফাঁদে পড়ে যায়। শেষে ফরীদি স্যার বলে ‘ঐ জিব্বা আইনের কথা কয়?..ঐ জিব্বা আমার ভালো লাইগা গ্যাছে..ঐ জিব্বা আমার।’ তারপর জিহবা কেটে নেয়া হয় আলীরাজের। জিহবা কাটার সময় জিহবা বের করতে না চাইলে ফরীদির সাগরেদরা আলীরাজের গলায় চাপ দিতে থাকে, পরে বাধ্য হয়।মর্মান্তিক সে দৃশ্যটি!..’এই ঘর এই সংসার’ তার আর একটি গ্রেট সিনেমা। পারিবারিক বন্ধনের বিপরীতে দূরত্বটি তার স্ত্রী তমালিকার মাধ্যমেই আসে। বোন রোজী আফসারী সম্পত্তি ভাগের টাকা সিন্দুকে রেখে চাবি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে যাতে যখন খুশি টাকা তারা নিতে পারে। স্ত্রীর কথার চাপে চাবি নিতে যাওয়া রোজীর সামনে আলীরাজের স্যাড এক্সপ্রেশনটি তখন এত পাওয়ারফুল ছিল যে সেটি বাংলা ছবির অন্যতম সেরা এক্সপ্রেশন হয়ে যায়। ছবির ফিনিশিং-এ সালমানের গাড়ির পেছনের লকারে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে আলীরাজ উঠে পড়ে। টাচি ছিল। ‘আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে’ গানটিতে সালমান শাহ, রোজী সামাদ, বুলবুল আহমেদ তাদের সাথে আলীরাজও ছিল। ছবিতে তমালিকার সাথে ‘তেঁতুলপাতা’ গানটি জনপ্রিয়। শাকিব খানের আমলে শিল্পী সংকটের সময় আলীরাজ বাবার ক্যারেক্টারে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছেন। ডিজিটাল সময়ে ট্র্যাক পরিবর্তন করে তিনি ভিলেন হিশেবে এক্সপেরিমেন্টে নিজেকে নতুন করে চেনালেন। ‘অগ্নি’ সিনেমায় তার ভয়ঙ্কর অভিনয় অবশ্যই দর্শক মনে রাখবে। স্যুট-টাই পরা জেন্টেলম্যান লুকের খলনায়ক। পুরো ছবিতে ব্যক্তিত্ববান লুকের ছিল। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবিতে বংশ গৌরব রক্ষায় কড়া নিয়ম নীতির বাবা ক্যারেক্টারে তিনি অনবদ্য। পুরো ছবিতে মেপে মেপে অভিনয় করেছেন। ছবি অনেক আছে তবে ‘পাহারাদার’ সিনেমাটি একদম আলাদা মনে হয়েছে। হুমায়ুন ফরীদির মালিক চরিত্রে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল। ফরীদি ছিল তার গোলাম।যা বলত তাই করত। সিনেমায় রাজাসাহেব ছিল তার নাম। রাজাসাহেবের কথায় ফরীদি খুন পর্যন্ত করত। শেষের দিকে নিজের ছেলে শাকিল খানের প্রেমিকা পপিকে বাঁচাতে ফরীদি-ই এগিয়ে আসে কারণ জানতে পারে রাজাসাহেব তাকে ধর্ষণ করার জন্য নিয়ে এসেছে। ফরীদির পাশাপাশি নিজেও চাকুর আঘাতে মারা যাবার আগে ফরীদি বলে-‘এক ওপরওয়ালা ছাড়া কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ঠিক না। ‘আলীরাজ মারা যাবার আগে স্বীকার করে-‘তুই ঠিক বলেছিস। ‘সিনেমায় ফরীদি ও আলীরাজ দুজনের অভিনয় ছিল টক্কর দেয়া। ভদ্রলোকের গেটআপে আলীরাজ পুরো সিনেমায় খলনায়কের অসাধারণ পারফর্ম করেছে। কমেডি রোলে ‘দবির সাহেবের সংসার’ ছবিতে দর্শক হাসিয়েছিল দারুণ। এভাবে বৈচিত্র্যময় চরিত্রে বিচরণ ছিল তাঁর।
২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে ‘জান্নাত’ ছবিতে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
আলীরাজ সেকালে যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেগুলো থেকে বের হয়ে এখন নিজেকে নতুন করে প্রমাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ নতুনত্বই তাকে আলাদা করেছে শক্তিমান অভিনেতা হিশাবে। এভাবেই তার ক্যারিয়ার এখনো চলছে আগামী দিনের লক্ষ্যে। এর মধ্য থেকে একজন বহুমাত্রিক আলীরাজকে আমরা পাই।