অসাধারণ এক চিত্রসম্পাদক মজিবুর রহমান দুলু
প্রতিদিনই তো আপনাদের সিনে পর্দার সামনে ও পেছনে থাকা অনেক মানুষদের গল্প শুনিয়েছি যাদের নাম আপনারা অনেকেই জানেন। আজ যার কথা আপনাদের জানাবো তিনি পর্দার আড়ালে থাকা জীবন্ত কিংবদন্তী অথচ সেই মানুষটার কর্মজীবন সম্পর্কে কেউ কখনও জানতেও চায়নি এবং কেউ জানাতেও চায়নি।
একটি চলচ্চিত্রের পেছনে কত মানুষের যে শ্রম ও মেধার প্রয়োজন হয় যা যারা সিনেমা নির্মাণ করেন বা করেছেন তারাই বলতে পারবেন। দর্শক ও ভক্তরা শুধু পরিচালক, নায়ক-নায়িকা ও অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের কথা বলে অথচ একটা সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ অংশ হলো ‘সম্পাদনা’ যার উপরে সিনেমার গল্প ও চিত্রনাট্যটা জমজমাট হওয়ার অনেক অবদান থাকে। আজ আপনাদের বাংলা চলচ্চিত্রের একজন অসাধারণ ও তিন প্রজন্মের অন্যতম সেরা এক চিত্রসম্পাদকের কথা বলবো।
‘সম্পাদনা – মজিবুর রহমান দুলু’ বাংলা সিনেমার ৭০-৯০ দশকের দর্শকরা এই লেখাটি/নামটি ঠিক কত শত সিনেমার টাইটেলে দেখেছিলেন তা হিসাব করে বলতে পারবেন না কিন্তু টাইটেলে দেখতে দেখতে মুজিবুর রহমান দুলু নামটি মুখস্থ করে ফেলেছে ও চিনে ফেলেছে।
যদিও দুলুকে টেলিভিশনের পর্দায় বা পত্র পত্রিকায় কেউ কখনও দেখেছে বলে মনে বলতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে আমরা সেইসময়ের দর্শকরা মজিবুর রহমান দুলুর চেহারা দেখিনি শুধু সিনেমার টাইটেলে নামটি পড়তে পড়তে মনে রেখেছি।
৬০ এর দশকের চিত্রসম্পাদক এনামুল হকের খালাতো ভাই দুলু সিনেমা দেখতে দেখতে সিনেমায় কাজ করার আগ্রহী হয়ে উঠেন। খালাতো ভাই এনামুল হকের হাত ধরেই মাত্র ১২ বছর বয়সেই সহকারী হিসেবে চিত্রসম্পাদনার কাজ শুরু করেন। সহকারী হিসেবে প্রথম কাজ করেন ‘আগুন নিয়ে খেলা’ সিনেমায় যার পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘সিনে ওয়ার্কশপ’ এর ৪ জন পরিচালক যারা হলেন আমজাদ হোসেন, রহিম নেওয়াজ, নুরুল হক বাচ্চু ও বাবুল চৌধুরী।
সিনেমার টাইটেলে জহির রায়হান নামটি ছোট করে শুধু ‘দুলু’ লিখে দিলেন। সেই শুরু মুজিবুর রহমান দুলুর এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জহির রায়হানের বিখ্যাত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’তেও সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ সিনেমা দিয়ে সহকারী থেকে পুর্ন চিত্রসম্পাদক হয়ে আসেন।
প্রথম সিনেমাই সুপারহিট, এরপর দুলুর সম্পাদনায় দ্বিতীয় সিনেমা এজে মিন্টুর ‘মিন্টু আমার নাম’, তৃতীয় সিনেমা ‘সুজন সখী’ ও চতুর্থ সিনেমা ‘প্রাণসজনী’ মুক্তি পায় যার একটানা ৪টি সিনেমাই সুপার-ডুপার হিট হয়। নজরে পড়ে যান অন্য পরিচালকদের যার ফলে একে একে মুক্তি পেতে থাকে ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘সুন্দরী’, ‘বাঁধনহারা’, ‘জিঞ্জির’, ‘অশিক্ষিত’, ‘মান সম্মান’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’, ‘তিন কন্যা’, ‘সবুজ সাথী’, ‘ভাত দে’, ‘নীতিবান’ এর মতো সব ব্লকব্লাস্টার সিনেমা। এর মাঝে ‘ভাত দে’ সিনেমার জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে ফেলেন যা পরবর্তীতে আরও ছয়বার (তিন কন্যা, পিতা মাতা সন্তান, ইতিহাস, মেঘলা আকাশ, শ্বশুড় বাড়ি জিন্দাবাদ ও অবুঝ বউ) অর্জন করেছিলেন।
‘মাস্টার মেকার’ এ জে মিন্টুর সবগুলো সিনেমার প্রধান সম্পাদক মুজিবুর রহমান দুলু। এহতেশাম, আমজাদ হোসেন, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, জহিরুল হক, দিলীপ বিশ্বাস, শিবলী সাদিক, নারায়ণ ঘোষ মিতা, ফখরুল হাসান বৈরাগী, মমতাজ আলী, ইবনে মিজান, এসএম শফি, আলমগীর কবির, আজমল হুদা মিঠু, মাসুদ পারভেজ, দেওয়ান নজরুল, চাষী নজরুল ইসলাম, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোস্তফা আনোয়ার, দিলীপ সোম, সুভাষ সোম, মোস্তফা মেহমুদ, কামাল আহমেদ, আজিজুর রহমান, আজিজুর রহমান বুলি, অশোক ঘোষ, আলমগীর কুমকুম, শহীদুল ইসলাম খোকন, কাজী হায়াৎ-সহ কাজ করেছেন বাংলাদেশের সব জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান পরিচালকদের সাথে। শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন এহতেশামের ছোট ভাই মোস্তাফিজের কোন সিনেমায় তিনি কাজ করেননি।
দুলু সম্পাদক হিসেবে ৩০০টি সিনেমার কাজ করেছেন। ৮০ ও ৯০ দশকের অনেক প্রভাবশালী প্রযোজক ও পরিচালকরা সিনেমার সম্পাদনার টেবিলে বসলে মজিবুর রহমান দুলুর উপর কথা বলতেন না। দুলু একেকটি সিনেমাকে তাঁর মতো করে প্রাণবন্ত করে তুলতেন। কলকাতার ৯টি সিনেমাতেও দুলু কাজ করেন যার প্রথমটি ছিলো এ জে মিন্টুর ‘সত্য মিথ্যা’ সিনেমাটি। ৭০-৯০ দশকের সব যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় কাজ করেছেন দুলু । ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’, ‘দেশ বিদেশ’, ‘ফুলশয্যা’, ‘মিসলংকা’, ‘বিরোধ’ এর মতো আরও অনেক যৌথ প্রযোজনার সিনেমার সম্পাদক ছিলেন মজিবুর রহমান দুলু।
এমন একজন সম্পাদক জীবিত আছেন অথচ আজকের ডিজিটাল সিনেমার তথাকথিত মেধাবীদের জিজ্ঞেস করলে অনেকেই হয়তো মজিবুর রহমান দুলুর নামটিই বলতে পারবে না।