অসাধারণ সব ছবির ভিড়ে ‘লালু মাস্তান’ ছিল আলাদা
‘লালু মাস্তান’— কোন মাস্তানের গল্প নয় কিংবা ছবির হিরোর মাস্তান হওয়ার কোন গল্প নয়, এমনকি মাস্তানি ভরা দৃশ্যের কোন ছবিও নয়।
১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অনেক অসাধারণ ছবির ভিড়ে মুক্তি পাওয়া ‘লালু মাস্তান’ নিয়ে একটি মজার তথ্য আছে, যা পোস্টের শেষভাগে বলবো। তার আগে স্মৃতি থেকে ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি যুগের পরিচালক এ জে মিন্টু, যার নামটি পোস্টারে থাকলে কিংবা রেডিও-টিভির বিজ্ঞাপনে শুনলে দর্শকদের আর কিছু চিন্তা করা লাগতো না। সিনেমার নায়ক-নায়িকা কে কিংবা সিনেমাটি দেখবো কি দেখবো না তা নিয়ে দ্বিধার কিছু থাকতো না। কারণ দর্শকদের কাছে এ জে মিন্টু পরিচিত ছিলেন ‘মাস্টার মেকার’ নামে। এ ছাড়া মিন্টু ও সানফ্লাওয়ার মুভিজ একই সূত্রে গাঁথা। এটি ছিল মিন্টুর প্রযোজনা সংস্থা অর্থাৎ তিনি শুধু সফল পরিচাকই ছিলেন না, ছিলেন সফল প্রযোজকও।
সিলেটের মনিকা সিনেমা হলে পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম ‘লালু মাস্তান’। সিনেমার পর্দা উঠতে পুরো হলে পিনপতন নীরবতা। শুরুতে কিশোর রাজুর (জসিমের) জন্মদিন উৎসব পালন করতে দেখি আজিম ও আনোয়ারাকে। এরপর দেখা যায়, আজিমের দুই কলিগ আহমেদ শরিফ ও মাহবুব খান গুইয়ের ষড়যন্ত্র। একদিন জসিমকে নিয়ে আজিম ফ্যাক্টরিতে যায়, একটি মেশিন ঠিক করার সময় পূর্ব পরিকল্পনা মতে আহমেদ শরিফের লোক জসিমকে ভুল সুইচে টিপ দিতে বলে। এরপর পিতৃহত্যার দায় মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বেরোয় জসিম এবং শেষ পর্যন্ত আশ্রয় পায় ভিক্ষুক আনোয়ার হোসেনের কাছে।
আনোয়ার হোসেন অনেক কষ্ট করে জসিমকে লেখাপড়া শেখায়। কিন্তু জসিম কোথাও কোন চাকরি পায় না তদবির না থাকার রণে। বিনা চিকিৎসায় মারা যায় আনোয়ার হোসেন। জসিম চাকরির পেছনে না ছুটে চটপটির দোকান দেয় এবং অন্য একটি বস্তিতে আশ্রয় নেয়। ওই একই বস্তিতে থাকে শাবানা।
শাবানা প্রথমে জসিমকে গুন্ডা-মাস্তান মনে করে কিন্তু বিপদে বস্তিবাসীর সাহায্য এগিয়ে এলে সেই ভুল ভাঙে। বস্তিবাসীর কাছে জসিম প্রিয় লালু ভাই। আহমেদ শরীফের লোকজন যখন বস্তি দখল করতে আসে তখন লালু রুখে দাঁড়ায়। এই রুখে দাঁড়ানোর ফলে আহমেদ শরীফের লোকেরা পুলিশ দিয়ে লালুকে গ্রেপ্তার করায় ‘লালু মাস্তান’ হিসেবে। জসিম তখন বস্তির সবার কাছে বলে, ‘তোমরা বলো আমি মাস্তান নই— কিন্তু কেউই ভয়ে কথা বলে না।
জসিমকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে আহমেদ শরীফ নিজের কাজে লাগায়। একসময় পুলিশ অফিসার প্রবীর মিত্রের ছেলেকে অপহরণ করে খুন করতে চাওয়ায় জসিম বাধা দেয়, এতে আহমেদ শরীফের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং জসিম প্রবীর মিত্রের ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যায়। পথিমধ্যে আহমেদ শরীফের লোকজন ধাওয়া করলে সংঘর্ষ হয়, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জসিমকে মৃত ভেবে গুন্ডারা পালিয়ে যায়। প্রবীর মিত্র তার ছেলেকে ফিরে পায়। চারদিকে খবর রটানো হয় জসিম মারা গেছে।
জসিমকে আইজি শওকত আকবর আশ্রয় দিয়ে পুলিশে চাকরি দেয়। জসিম ছদ্মবেশে আবার আহমেদ শরীফের দলে যোগ দেয়। এভাবে একের পর এক ঘটনায় টান টান উত্তেজনায় সিনেমাটি এগিয়ে যায় এবং সবশেষে মা আনোয়ারা ও জসিমের মিলনের মধ্য দিয়ে সিনেমাটি শেষ হয়।
জমজমাট এই সিনেমার ‘শূন্য এ হাতে হাত রেখে’ গানটি আজও গুনগুন করে উঠি প্রায় সময়। যা লিখেছিলেন মনিরুজ্জামান মনির, সুর করেছিলেন আলম খান এবং গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমিন।
‘লালু মাস্তান’ অন্য দশটি মাশালাদার সিনেমার মতোই তবুও দর্শকদের কাছে ব্যতিক্রম লেগেছে। কারণ সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন এ জে মিন্টু।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম সিনেমাটি নিয়ে একটি মজার তথ্য আছে। ১৯৮৭ সালে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, দায়ী কে, অপেক্ষা, সারেন্ডার, সন্ধি, হারানো সুর, সেতুবন্ধন, সহযাত্রীর মতো দারুণ দারুণ সব চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিন্টু ‘লালু মাস্তান’ সিনেমার জন্য প্রথমবার পান শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার।
আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ‘লালু মাস্তান’-এর কাহিনিকার ছিলেন আরেক প্রযোজক-পরিচালক মোতালেব হোসেন, যিনি কখনো জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেননি। মিন্টুর ‘সত্য মিথ্যা’র মতো সফল ও জাতীয় পুরস্কার পাওয়া চলচ্চিত্রের কাহিনিকারও তিনি।
‘লালু মাস্তান’ সে বছর আর কোন শাখাতেই পুরস্কার লাভ করেনি। এতে বোঝা যায়, মিন্টুর পরিচালনার দক্ষতা অন্য সবার চেয়ে আলাদা। এরপর আরও তিনবার শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও দুবার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার পেয়ে প্রমাণ করেছিলেন কেন তিনি ‘মাস্টার মেকার’ ।
মালেক আফসারী, সোহানুর রহমান সোহান, শাহ আলম কিরণ, মনোয়ার খোকনের মতো সফল পরিচালকদের গুরুই নন মিন্টু, রেডিও-টিভিতে সিনেমার বিজ্ঞাপনের সেরা কণ্ঠ নাজমুল হোসেনেরও গুরু ছিলেন। খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে, আরও অনেক মেধাবীদের গুরু ছিলেন তিনি। যে কিনা একরাশ ক্ষোভ ও অভিমানে এক সময় চলচ্চিত্র অঙ্গন ছেড়ে যান।