অস্তিত্ব-অমিত সম্ভাবনার অপমৃত্যু
সমকালীন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে অনন্য মামুন সম্ভবত সবচে বিতর্কিত চরিত্র, সবচে রঙিনও বটে। অনন্য মামুনকে আমরা অনেক ধরণের কাজ করতে দেখি। কখনো তিনি অনন্ত জলিলের সাথে স্বাগতম জানান, আবার পর মূহুর্তে শুধু যৌথ প্রযোজনাকে চাইতে থাকেন। (প্রথমে মামুনকে একচোট গালমন্দ করে) সবাই যখন যৌথ প্রযোজনায় মন দিয়েছে, তখন তিনি দুই নায়িকার “গুণ্ডামি” নিয়ে নারী নির্ভর একটা ছবি বানিয়ে ফেলেন। এরপর লো-প্রোফাইলে শোনান ভালোবাসার গল্প। মামুন এমনই অনন্য।
তো যখন শুনলাম, মামুন অটিজমের মতো একটা ডিফরেন্ট ইস্যু নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন; মোটেও অবাক হইনি। অস্তিত্বের গল্প তিশাকে ঘিরে। ছবির প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত তাই আমরা তিশাকে দেখতে পাই। তিশা তার বাবা, মা, ছোটভাই আর দাদীকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে থাকে (যদিও একবার দেখলাম, তিশা বাসায় বসে ছবি আঁকছে আর পিছনে হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও)। তিশাকে মা সুচরিতা কখনো স্কুলে পাঠাননি। কিন্তু একসময় তিশার ভাই জোভান আর তার বান্ধবী সৌমি মিলে মাকে রাজি করায়। তিশাকে ভর্তি করানো হয় এক স্পেশাল স্কুলে।
এই স্কুল চালায় আরিফিন শুভ। আর স্কুলটাকে যে কোন মূল্যে বন্ধ করতে চায় স্থানীয় মাস্তান ডন। অটিস্টিক শিশুদের মাঝে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু স্পেশাল অ্যাবিলিটিরও দেখা মিলে (যেমন Rain Man-এর ডাস্টিন হফম্যান ছিলেন অস্বাভাবিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী কিংবা My Name Is Khan এর শাহরুখের ছিল ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটস, মেশিন সম্পর্কে জ্ঞান। এমনকি কিছু ফ্যান থিওরিতে শার্লক থেকে শেল্ডন কুপারকেও অটিস্টিক বলে মত দেওয়া হয়েছে)। প্রথম দিনেই শুভ আবিষ্কার করে তিশা খুব ভালো দৌড়াতে পারে। শুভ তিশাকে প্রস্তুত করতে থাকে স্পেশাল অলিম্পিকের বাছাই পর্বের জন্য। আর অন্যদিকে ডন প্রস্তুতি নিতে থাকে স্কুলটি উঠিয়ে দেবার।
অস্তিত্বের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন কার্লোস সালেহ, অনন্য মামুন ও সোমেশ্বর অলি। গল্পটা জনরাওয়াইজ কামিং অফ এজ রোম্যান্স থেকে স্পোর্টস ড্রামা সবই কাভার করেছে। প্রথমেই এমন একটা গল্প নিয়ে ছবি তৈরী করার জন্য সাধুবাদ। অটিজম এখনো আমাদের দেশে অজানা এক বিষয়। এই বিষয়টা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করার প্রয়াস ছবিতে স্পষ্ট। সময়ের দাবিও ছিল। কারণ বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা (আনুমানিক) তিন লাখেরও বেশি। ছবিতে আমরা দেখি, শিক্ষিত ও অবস্থাসম্পন্ন পরিবার হওয়া সত্ত্বেও তিশাকে স্কুলে দেওয়া হয়নি। ভাই জোভানও তার বোনের অবস্থা ক্লাসের কাউকে জানায় না। সবাই ভাষা দিবসে শহীদ মিনার যাচ্ছে, অথচ তিশাকে রেখে যাচ্ছে বাসায়। এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুরা এখনো যে পরিবারিকভাবেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সমাজের ভিলেন রূপে আসতে তো আরো দেরি আছে।
সিনেমার যে ব্যাপারগুলো ভালো লেগেছে তার মাঝে প্রথমেই আসবে ন্যারেটিভ চয়েজ। শুরুতে আমরা কিছু ফানি ও রোম্যান্টিক সিকোয়েন্স পেয়েছি। জোভান আর সৌমিকে ঘিরে ছিল এই দৃশ্যগুলো। কিন্তু একবার প্লটের ভিত্তি তৈরী করার পর, গল্প আর অন্য কোন দিকে তাকায়নি বা সেখানে ফিরে যায়নি। ভেঙ্কট গঙ্গাধারী’র ক্যামেরার কাজ চোখ জুড়িয়েছে। কালার কারেকশনে বেশিরভাগ সময় ভালো ছিলো (শুধু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে কনট্রাস্ট বা টেম্পারেচার বেশিই বাড়ানো। যেমন: কক্সবাজারে সন্ধ্যায় ট্রেনিঙের দৃশ্যটা)। সেট ডিজাইন দারুণ ছিল। বিশেষ করে গানগুলোতে খুব সাধারণ লোকেশন ও সেট ব্যবহার করেও নান্দনিকতা ধরে রেখেছেন। সংলাপ আলাদা করে প্রশংসার দাবীদার।
তিনটি ব্যাপার আমি খুব পজিটিভলি দেখেছি। এক দৌড়ের সময় প্রতিবার জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠাটা। “জাগো” বাদে এভাবে কখনো স্পোর্টসের সাথে জাতীয়তাবাদকে এক সূত্রে গাঁথতে দেখিনি। আর শুভর শিক্ষক হওয়াটাকে আলাদাভাবে এম্ফ্যাসিজ করাটাও ভালো লেগেছে। আমাদের সিনেমায় শিক্ষক মানে দুর্বল প্রবীর মিত্রের অত্যাচারিত হওয়া। যে শিক্ষক মেরুদণ্ড গড়তে পারেন, আবার শিক্ষা দেবার দরকার পড়লে তিনি অসভ্যদের মেরুদণ্ড ভাংতেও পারেন; এমন শিক্ষকের সংখ্যা আঙুলে গোণা যায় (এই মুহূর্তে মনে পড়ছে রাজ্জাকের ঢাকা-৮৬ সিনেমাটির নাম)। আর ছিল গল্পের প্রতি সততা। অটিস্টিক তিশাকে একটিবারের জন্য অশ্লীল বা আবেদনময়ী রূপে দেখানো হয়নি। বিশেষ করে দৌড়ের দৃশ্যগুলোর ফ্রেমিং অযথা অন্য কিছুর দিকে দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করেনি। তিশা অটিস্টিক মেয়ে, তাই স্বাভাবিকভাবেই একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। কিন্তু গল্পের কোন চরিত্রই তিশাকে “শরীর” হিসেবে দেখেনি, এমনকি ডনের ডেনে বন্দী থাকার পরও। অথচ বাংলা সিনেমায় সচরাচর আমরা এমনটিই দেখে এসেছি। ছবিকে আর কি দুষবো! আমাদের সমাজটাই তো এমন নোংরা, এতটা দূষিত!!
অস্তিত্বর সবচে দুর্বল দিক এর কাহিনী বিন্যাস। বা আরো স্পষ্ট করে বললে কাহিনীর অভাব। আড়াই ঘণ্টার ছবির মতো উপকরণ গল্পে ছিলো না। তার উপর স্ক্রীপ্ট একদমই অগোছালো, ক্ষেত্রবিশেষে গতিহীন। ছবির প্রথমার্ধ গল্প সেটআপ করতে অনেক বেশি নিয়ে ফেলেছে। আমরা স্রেফ নিত্যদিনকার কিছু ঘটনা দেখি, কিন্তু গল্প আর আগায় না। আর সেকারণেই দ্বিতীয়ার্ধে এক সাথে অনেক কিছু আনতে হয়েছে। আর এটা করতে গিয়েই গিয়েছে তালগোল পাকিয়ে। দ্বিতীয়ার্ধের জন্য পরিচালকের হাতে ছিল গাদাখানেক গান। তাই দরকার ছাড়াই, হুড়মুড় করে কিছু গান চলে এসেছে। অথচ সিকোয়েন্স আর ক্যারেক্টারদ্বয়ের কেমিস্ট্রি তখন মোটেও কোন গান ডিমান্ড করছিল না। আর আইটেম সংটা আসলে কোথায় থাকলে ভালো হতো, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। শুরুতে রাখলেই হয়তো ভালো হতো। কারণ, ছবির এমন আবেগী ফিনিশিঙের সাথে এমন ধুম-ধাড়াক্কা টাইপের গান যেত না। ফিনিশিঙের কথা যখন আসলোই, তখন এ বিষয়ে কিছু বলি। ছবিতে শুভর চরিত্রের দুটো ফিনিশিং-ই টানা যেত আর কোনটাই অযৌক্তিক হতো না। কিন্তু, ক্লাইম্যাক্সটা আরো ভালোভাবে হ্যান্ডেল করার দরকার ছিলো। যদিও এটা টিপিক্যাল ভিলেন-হিরোর গল্প না। তারপরও ভিলেনকে শুভর স্কুলের বিরোধীতা করার জন্য, আরো স্ট্রং মোটিভ দেওয়া যেত। স্কুলটি বন্ধ করার জন্য ডন যে কারণ বলছিলো, সেটি ছিল খুবই দুর্বল। অটিস্টিক শিশুদের কিছু বিহেভরিয়্যাল প্যাটার্ন আছে, যার অনেকগুলোই ছবিতে অনুপস্থিত। যেমন : একই কাজ বারবার করতে থাকা অথবা নয়েজ সেন্সিটিভিটি।
অস্তিত্ব আসলে তিশার ছবি। তাকে ঘিরে গল্প এগিয়েছে, তিশার কাজ করার স্পেসও বেশি ছিল। বেশ ভালো অভিনয় করেছেন তিনি। শুভর আসলে এই ছবিতে কাজ করার বেশি জায়গা ছিলো না। তবে সব পুষিয়ে দিয়েছেন ছবির শেষ দৃশ্যে এসে। আলাদা ভাবে “রোম্যান্টিক শুভ”-এর ইমপ্রুভমেন্ট বেশ চোখে পড়ে। যেমন রোম্যান্টিক লুক দেওয়া বা এক্সপ্রেশন্স ধরে রাখা, এসব শুভর অভিনয়কে আরো শক্তিশালী করেছে। রুবিনার প্রথম ছবি এর বেশি ভালোবাসা যায় না দেখেছিলাম। এর পর তার আর কোন ছবিই দেখার আগ্রহ (কিংবা সাহস) হয়নি। সেই রুবিনাকে কখনোও এতটা সুন্দরী, এতটা গোছানো দেখিনি। নতুন হিসেবে জোভান আর সৌমি খারাপ ছিলেন না। ডন এই ছবিতে যতটা না ভিলেন, তার চে বেশি কমিক রিলিফ। এই সিনেমায় সত্যিকারের কিছু অটিস্টিক শিশুও অভিনয় করেছে। তাদের কাছ থেকে কাজ বের করা কিন্তু সহজসাধ্য নয়।
অস্তিত্বের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন আকাশ, ইবরার টিপু, প্রীতম হাসান ও নাভেদ পারভেজ। আরিফ রোহানের কোরিওগ্রাফি চোখ জুড়িয়েছে। মুসাফিরের পর আবারও নাভেদ পারভেজের গান ভালো লেগেছে। “তোর নামে লিখেছি” আর “আয় না বলনা” গান দুটো অনেকবার শোনার মতো। আইটেম সংটার “শুভ/তিশা এসেছে আজ তোদের নাচাতে” লাইনটার সুর, দবির সাহেবের সংসার সিনেমার আইটেম সঙের “কি জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইসে” লাইনটার সুরের সাথে মিলে যায়। আইটেম সঙটায় তিশা আর শুভ তাদের সিনেমার ক্যারেক্টার ভেঙে নিজ নিজ পরিচয়ে এসেছেন। ছবির মাঝে হঠাৎ করে এমনটা হলে একটু খটকা লাগতেই পারে। তবে এক্ষেত্রে, সিনেমা রিয়ালিজম আর ইল্যুশনের মধ্যবর্তী যে জগৎ তৈরী করে, সেটাকেও বিবেচনায় আনতে হবে। যেমন : টারান্টিনোর সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে, পাল্প ফিকশনের ক্যারেক্টারগুলো যখন সিনেমা হলে যায়; তখন তারা কিল বিল দেখে। অনন্য মামুনের ছবিতে ডন মাতাল অবস্থায়, টিভিতে শুভ-তিশাকে নাচতে দেখলে দোষ কি!
অস্তিত্ব ছিল অতি সম্ভাবনাময় একটি ছবি, সুনির্মিতও বটে। কারণ বাংলাদেশে এমন কনসেপ্টের ছবি আর দেখা যায়নি। ছবিতে খুব সুন্দর একটা বক্তব্য ছিলো। অটিস্টিক শিশুরা আর দশটা সাধারণ শিশুর মতোই সমঅধিকারের হকদার। তাদেরকে ঘরে বন্দী করে নয়, বাঁচতে দিতে হবে বাইরের আলো-হাওয়ায়। একটু যত্ন আর শিক্ষা পেলে তারা নির্ভরশীল না থেকে, হতে পারে স্বাবলম্বী; খুলতে পারে নিজেদের সম্ভাবনার দুয়ার। কিন্তু সাম্প্রতিক আরো কিছু ছবির মতো, এখানেও আমরা দেখলাম কনসেপ্টটাকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া হয়নি। একটা গল্পের কনসেপ্ট অনেকটা চারাগাছের মতো। এর সূর্যের আলো লাগে, ছায়া লাগে, সার লাগে, পানি লাগে, গোঁড়ায় জন্মানো আগাছা তুলে ফেলতে হয়। এখন এই অপরিণত চারাগাছকে নার্সারী থেকে তুলে এনে, খুব সুন্দর টবে রাখলেই তো হবে না। এমন করলে গাছের জীবন চলে যাবে, সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটবে। যেমনটি হয়েছে মামুনের অস্তিত্বের সাথে।