Select Page

অায়নাবাজি : সর্বজনীন বাস্তবতার সিনেমা

অায়নাবাজি : সর্বজনীন বাস্তবতার সিনেমা

aynabaji-poster-with-chanchal-chowdhury-nabila-by-amitabh-rezaরবীন্দ্রনাথের প্রতি ঋণ স্বীকার করে প্রথমেই নির্মাতা তার দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘অায়না’ বিষয়টা নিয়ে রবিঠাকুরের ছড়াটা এমন –

‘আয়না দেখেই চমকে বলে,
মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে,
বেশিদিন আর বাঁচব না তো
ভাবছে বসে একা সে।
ডাক্তারেরা লুটল কড়ি,
খাওয়ায় জোলাপ, খাওয়ায় বড়ি,
অবশেষে বাঁচল না সেই
বয়স যখন একাশি।’ (অায়না দেখেই চমকে বলে)

এ অায়না ব্যক্তির অাত্মবিশ্লেষণের দর্পণ। অায়না নিয়ে রবিঠাকুর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসেও বলেছেন। হতে পারে নির্মাতা কোনো এক অমূ্ল্য রবিরচনা থেকে ঋণস্বীকার করেছেন। বলা ভালো এটা নির্মাতার সততা।

‘অায়নাবাজি’ বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় নির্মিত হলেও এরকম গল্প সব দেশে সব কালে হয়ে থাকে। সর্বজনীন এ অাবেদনটি ‘অায়নাবাজি’-তে অাছে। সামগ্রিক বিশ্লেষণ কোনো কিছুরই সম্ভব না তবে একটা চেষ্টা দাঁড় করানো যায়। সে চেষ্টার প্রতিফলন বর্তমান লেখাটিতে মিলবে স্তরে স্তরে :

* আয়নাবাজ = ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র
******************************
‘অায়নাবাজি’ শব্দটি খেয়াল করলে ‘অায়নাবাজ’ শব্দটি অাগে অাসে। স্পষ্টই একজন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে।অায়নাবাজ বৈশিষ্ট্যের চরিত্রটি সিনেমায় চঞ্চল চৌধুরী ধারণ করেছে। তার চারপাশের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে নিজের প্রতিভাকে সে কাজে লাগাচ্ছে। সেখানে চালাকি অাছে, আবেগ অাছে, বাস্তবতা অাছে। ব্যক্তির এ ভ্রমণ ‘অায়নাবাজি’-তে পরিণত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ইমেজে।সিনেমার ওয়েবসাইটের তথ্যমতে ঢাকা শহরের অন্ধকার জগতের গল্প এটি। যে গল্পে অায়না নামের ব্যক্তিটি পরিবর্তনশীল থাকে তার কাজ করার জন্য।অায়না বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যক্তি যে তার সমাজে ছড়িয়ে থাকে।

* অস্তিত্ব ও অায়নাবাজি
*********************
অনেক মতবাদ অাছে জীবন নিয়ে। সবচেয়ে বড় মতবাদ অস্তিত্ববাদ-ই। অস্তিত্ব রক্ষার থেকে বড় কিছু পৃথিবীতে অার কিছু নেই। অাপনার পেটে ভাত না থাকলে কেউ অাপনাকে যেচে খাওয়াবে না। তাই অস্তিত্ব বাঁচাতে শরাফত করিম অায়নাকে নিতে হয়েছে অন্য উপায়।সবই তার নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। এ লড়াইতে সে সফল শেষ পর্যন্ত।

* interchange characteristic :
****************************
এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে দ্রুত অভিযোজন ঘটিয়ে অায়না তার বাঁক নিয়েছে। চঞ্চল চৌধুরী বাঁক নেয়ার কাজটি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তার পরিবর্তনের পর্যায়গুলো ছিল গোবেচারা ছেলে, প্রেমিক, পাগল, প্রশিক্ষক, নেতা, কয়েদি এ বৈশিষ্ট্যগুলো। সবগুলোকে ধারণ করতে তার পরিশ্রম করতে হয়েছে সর্বোচ্চভাবে।

গোবেচারা চঞ্চল তার নিজের এলাকাতে গণ্ডির মধ্যে সবার সামনে সামাজিক সম্পর্ক রাখে যাতে তাকে সবাই বিশ্বাস করে। বিশ্বাসটা তার দরকার।পুরির দোকানদার, মাছওয়ালা এদের সাথে তার সম্পর্ক ভালো। স্কুল প্রশিক্ষক হিশেবে তার ভূমিকা চমৎকার। ভূমিকায় ছেলেমেয়েদের রিহার্সেল দেয়ার কাজটি সে ভালোবেসেই করে।ছেলেমেয়েদেরকে স্বপ্ন দেখায় সে। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটা, পাখির কিচিরমমিচির ইত্যাদি থেকে সে স্বপ্ন দেখায়। প্রেমিক চঞ্চল তার নিজগুণেই নাবিলার (হৃদি) কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। মূলত সরলতা অার সামাজিক ভূমিকা এ দুটি গুণ নাবিলাকে অাকৃষ্ট করে। নারী সবসময় এ ধরনের গুণ থেকে পুরুষের প্রতি অাকৃষ্ট হয় এবং এটা মানবিকও বটে। খুনি অাসামী বা পাগলের ভূমিকাটি অারো একটি পরিচিত বিষয় সমাজের, নেতা হিশেবে চঞ্চল দ্বৈত ভূমিকায় দুই ধরনের ইমেজে হাজির ছিল এবং সেটা চ্যালেন্জিং, কয়েদি চঞ্চল বুদ্ধি , মেধা বা কূটকৌশলের জোরে একটা স্বাধীন সত্তা। এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে শিফট করার ধরণ খুবই কঠিন ছিল। চঞ্চল চৌধুরী অভিনয়ের জায়গায় সুইচ অন/অফ করে খুব দ্রুত তার অভিযোজন করেছে।

* পুঁজিবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতা
*****************************
সমাজবাস্তবতা রাজনীতির মধ্যেই পড়ে। এরিস্টটল তাঁর ‘পলিটিকস’ গ্রন্থে বলেছেন ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব’। এ রাজনীতি ঘরে-বাইরে সবখানে হয়।চঞ্চলের চরিত্রটি সিনেমায় রাজনৈতিক। বাঁক অনেক কিন্তু পুঁজিবাদী রাজনীতি তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। চঞ্চলের কাজ যখন হয় নিজে অন্যের হয়ে জেল খাটা সেটাতে টাকার অঙ্ক ফ্যাক্টর হিশেবে কাজ করে। হলিউড স্টুডিও থেকে গাউসুল অালম শাওনের কাছে অাসা প্রস্তাবটি চঞ্চলের কাছে যায়।সেখান থেকে লুৎফর রহমান জর্জের (কুদ্দুস) হয়ে জেল খাটে। একজন অাপাদমস্তক সুবিধাবাদী ব্যক্তির ভূমিকায় জর্জ ছিল পুঁজিবাদী। তার কাজ ছিল নারীলোভী হওয়া তাই টাকার জোরে মামলার রায় নিজের পক্ষে নিয়ে গলির মোড়ে তৃষাকে (তানিশা) ভয় দেখায়।পার্টি করে। এই সুবিধাবাদী ভূমিকায় নেতা নিজাম সাঈদও ছিল। টাকার লোভ এবং বাস্তব জীবনে অভিনয়ের নেশা থেকে অায়নাকে উৎসাহিত করে আবার জেল খেটে দেবার কথা বলে।জেলে যাবার পরে দাবার গুঁটি উল্টে দেয় নেতা। রাজনীতিতে এসব ঘটে।একজনের হয়ে অারেকজনের জেল খাটা সামান্য বিষয় রাজনীতিতে। স্থানীয় এক গল্পে বড়ভাই নেতা ছিল এরকম। পরে মেয়ে বিষয়ক ঝামেলায় পড়লে মামলা হয় এবং ছয় মাসের জেল হয়।পরে নিজের ছোটভাইকে দিয়ে জেল খাটায় কারণ ছোটভাই তার কাছে ঋণে জর্জরিত ছিল। বড় রুই-কাতলা এভাবেই ছোট মাছকে খায় যাকে রাজনীতিতে বলে মাৎসন্যায়। এ নিয়ম সব দেশে সব কালে ঘটে।সিনেমায় একটা বিশেষ জায়গায় এর প্রমাণ মিলবে।সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধ্বে অায়না ও নিজাম সাঈদের সামনাসামনি দেখাতে নিজাম যখন অায়নাকে রাজি করাতে পারছিল না তখন বলে- ‘সবকিছু একদিক থেকে দেখছেন কেন?কার্ল মার্কস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে কি বলেছিলেন, সবকিছুরই বিপরীত প্রতিক্রিয়া অাছে।অন্যদিক থেকে দেখার চেষ্টা করুন। ‘অায়না তখন রাজি হয়। মার্কসের লড়াই ছিল পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। তারও অাগে নিজাম তার ব্যক্তিগত গল্প বলে যেখানে সে খুন করেও বলে সেটা ছিল তার অাদর্শ রক্ষার লড়াই। এ অাদর্শের উদাহরণে টানে হিটলার, মুসোলিনীদের কথা। এ প্রসঙ্গে হিটলারের একটা গল্প তোলা যায়।বিপরীত শক্তির বিরুদ্ধে রণসজ্জা প্রস্তুতের সময় হিটলার প্রশিক্ষণ দেয়। এক পর্যায়ে ছাদের ওপর থেকে এক সৈন্য পা পিছলে যায় ভুল করে এবং নিচে পড়ে যেতে থাকে।হিটলার প্রথমে সৈন্যটির হাত টেনে ধরলেও পরে ছেড়ে দেয়। তাকে বাঁচানোটা দরকার মনে করেনি। যার অাদর্শ ছিল ‘war is peace’ তার মানবিকতা না থাকাটাই বাস্তবতা।হিটলার জাতীয়তাবাদী ছিল সেটা তার নিজের একনায়ক অাদর্শে। এর প্রমাণ মিলবে তাঁর ‘মাইন ক্যাম্ফ’ আত্মজীবনীতে।নিজাম সাঈদ তার মতো করে স্কুল শিক্ষককে খুন করাটা তার রাজনৈতিক অাদর্শ ভাবেন। একইভাবে দেশে-বিদেশে যত খুন হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সবগুলোই তাদের দলীয় অাদর্শের নীতিতে হচ্ছে। এ বাস্তবতা টাকার খেলা।কেননা খুনেরও বাজেট থাকে।

* বহুমুখী ডিরেকশন স্টাইল
************************
‘অায়নাবাজি’ তার এক্সপেরিমেন্টে একসাথে অনেক কাজ করে ফেলছে।সিনেমাটির স্পেসিফিক জেনর নির্ধারণ কঠিন। দেখার পর অনেক অ্যাঙ্গেল থেকে ভাবা যেতে পারে। যখন নায়কের দাপুটে বিচরণ লক্ষ করব ‘হিরোইজম বেইসড থ্রিলার’ মনে হবে। যখন গল্পকেই সিনেমার একমাত্র চালিকাশক্তি ভাবব মনে হবে ‘স্টোরি বেইসড সিনেমা’, যখন কমেডির প্রভাব লক্ষ করব ‘ডার্ক কমেডি’ মনে হবে, যখন মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বড় অাকারে নায়ক, নায়িকা, অন্য সব চরিত্রের মাধ্যমে যাবে মোটাদাগে ‘সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট’ মনে হবে। সব মিলিয়ে সিনেমাটি মানুষ ও পরিবেশের সুনির্দিষ্ট বাস্তব দিক নিয়ে নির্মিত যার বহুমুখী ডালপালা অাছে। সব মিলিয়ে ‘multipurpose human environmental experiment’ বলাই ভালো।এতে ্করে বহুমুখী দিকটি সহজেই বলা যায়।

পাশাপাশি নির্মাণেও অফট্র্যাক ও বাণিজ্যিক দুই ধরনের স্টাইল অাছে। প্রথমদিকে যেভাবে সিনেমা এগিয়েছে অফট্র্যাকের বৈশিষ্ট্যই ছিল। অারেফিন শুভর উপস্থিতি অাসার পরে সিনেমার বাণিজ্যিক স্টাইল ধরা পড়ে। বিশেষ করে শেষের দিকে অারেফিন শুভর অ্যাক্টিভিটি সেটাই প্রমাণ করে। তার অভিনয়কেও পরিচালক বাণিজ্যিক ঘরানায় তুলে ধরেছেন। দুই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট একসাথে করাটা সোজা কাজ নয়।

* সরেজমিন তদন্ত
****************
সাংবাদিক পার্থ বড়ুয়ার বড় উপস্থিতি ‘অায়নাবাজি’-র সরেজমিন তদন্তের উৎস। পার্থ অপরাধী ধরার জন্য দিন নেই রাত নেই পরিশ্রম করেছে।চঞ্চলের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। তার সাথে মিশেছে। অপমান হবার পরেও তথ্য উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত তার শেকড় উদ্ধার করে এলাকাবাসী, প্রেমিকা নাবিলা সবার কাছেই চঞ্চলকে তার অাসল পরিচয়ে তুলে ধরেছে পার্থ। এর জন্য স্থান অনুযায়ী তাকে ঘুরতে হয়েছে।লালবাগ কেল্লা, পুরনো ঢাকা, পত্রিকা অফিস, নাবিলার বাসা, হাইওয়ে সবখানে তাকে ছুটতে হয়েছে। সরেজমিন তদন্তে সিনেমার বাস্তবসম্মত উপস্থাপনা অারো স্ট্রং হয়েছে।

* নির্মাণ : অভিনয়, সংলাপ, কমেডি, গান, ক্যামেরার ভাষা
************************************
‘অায়নাবাজি’ অবশ্যই অভিনয়সমৃদ্ধ সিনেমা। এ সিনেমায় গৌণ চরিত্র বলে কিছু নেই।সব চরিত্রই গল্পকে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। চঞ্চল চৌধুরী সিনেমার নাম ভূমিকায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।তার এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে যাবার বিরল অভিনয়গুণ সিনেমাকে প্রাণ দিয়েছে। শরাফত করিম অায়না চরিত্রে তাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে তার পূর্বের সিনেমাগুলোর থেকে অনেক অনেক বেশি। এলাকার পুরি পছন্দ করা গোবেচারা অায়না, স্কুল প্রশিক্ষক, প্রেমিক, পাগল, নেতা, কয়েদি এসব চরিত্রকে শাসন করেছে চঞ্চল। তার চোখ কথা বলেছে। একটা সিকোয়েন্স না বললেই নয়।দ্বিতীয়ার্ধ্বে নেতা নিজাম সাঈদের মুখোমুখি হয়ে প্রথমে রাজি না হওয়া চঞ্চল পরে নিজামের আইডিওলজিতে নিজের অ্যাটাচমেন্ট খুঁজে পাওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে সুইচ অন/অফ করে অায়না থেকে নিজামের ক্যারেক্টারে ঢুকে যায়।অভূতপূর্ব অভিনয়। ‘অাপনি কি খেতে পছন্দ করেন’ বলে নিজামের স্টাইলে কথা বলতে থাকলে ‘alter-ego’-র প্রভাব শুরু হয়। চঞ্চলের অভিনয়ক্ষমতা যে বিরল সেটা এ সিকোয়েন্সে বোঝা যায়। জর্জের সাথে প্রথমবার দেখা করার পর তাকে যখন চার্জ করে বলে ‘পা নাড়ানো অাপনার বদঅভ্যাস’ বা ‘একটু হেঁটে দেখান তো’ তখনও inter-change-এর কোয়ালিটিটা চঞ্চলের প্রখর তা বোঝা যায়।বাজারে মাছ কিনতে যাওয়া আয়না মাছওয়ালাকে কথায় ভোলানো, পার্থকে নিয়ে মজা করা, প্রেমিক হিশেবে মিশে যাওয়া, কয়েদির নেতার মতো কূটনৈতিক জ্ঞান দেখানো যা তাকে স্বাধীন করেছিল এসব অভিনয়ক্ষমতা চঞ্চল নিজের সেরাটা দিয়ে দেখিয়েছে। মঞ্চের প্রকৃত শিল্পীরা অভিনয়ের মঞ্চ কাঁপায় চঞ্চল তারই উদাহরণ। কুদ্দুস চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নারীলোভী, পুঁজিবাদী সুবিধাবাদী চরিত্রে জর্জ প্রফেশনাল অভিনয় করেছে।স্ল্যাং বলার ভঙ্গি তার অভিনয়ের স্ট্রং দিক ছিল। পুরুষাঙ্গে হাত দিয়ে নিজের ভোগবাদী বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। পুরুষতন্ত্রকে অাঘাত করার মোক্ষম উপাদান ছিল জর্জের ক্যারেক্টারটি। গাউসুল অালম শাওন ইন্টারেস্টিং। তার হলিউড স্টুডিওর কর্মকান্ড এবং নিখুঁত কমেডির ধাঁচে অপরাধজগতের অন্ধকার দিকটি অালাদাভাবে দর্শককে অানন্দ দিয়েছে। ইফফাত তৃষার ইনোসেন্ট এক্সপ্রেশনগুলো অসাধারণ।জর্জের সাথে পেরে না ওঠা অসহায় একটা মেয়ের ভূমিকায় সে মিশে যায়। অারেফিন শুভ দ্বিতীয়ার্ধ্বে হাজির হয় হিরোইজম নিয়ে।স্টোরি টেলিং এ তখন অালাদা মাত্রা অাসে। বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনয়গুণ অ্যাপ্লাই করার ক্ষেত্রে শুভর ক্যারেক্টারটি ইউটার্ন ছিল।শিশুশিল্পী শরিফুল ‘ইমেইল’ বহন করে দর্শককে ছোট ছোট সংলাপে মজা দিয়েছে। কম্পিউটারের সামনে তার টাইপ করার মুহূর্তটিতে দারুণ এক্সপ্রেশন দেখা যায়। নায়িকা নাবিলা হিশেবে অনেকেই নাবিলাকে বিশ্লেষণ করেছে। নাবিলা নিজে ‘অায়নাবাজি’-তে তার চরিত্রের বিশ্লেষণে সাক্ষাৎকারে বলেছে ‘অামি নায়িকা মেটেরিয়াল না’-এটা তার নিজস্ব বক্তব্য। তবে সিনেমার উপস্থিতিতে তার চরিত্রটি নায়িকা+অভিনেত্রী দুই ধরনের ইমেজকেই তুলে ধরেছে। কনফিডেন্সিয়াল সিন হিশেবে যে ‘চুমু’ দৃশ্যের কথা উঠেছে নাবিলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিনয় করেছে। এ সময় তার বডি ল্যাংগুয়েজ নায়িকাকেন্দ্রিক ছিল অাবার অভিনেত্রীর জায়গায় প্রফেশনালিজম দেখা গেছে স্টেশনে চঞ্চলের জন্য অপেক্ষা করা বা বাবার মৃত্যুর পরে চোখে কালোশিরা পড়া শোকার্তের ভূমিকায়। নাবিলা তার প্রথম সিনেমা হিশেবে নিজের ডেডিকেশন দিয়ে সেই অভিনয়টাই করেছে যা তার বড় ক্যারিয়ারের হাতছানি দেয়। পার্থ বড়ুয়ার অভিনয়েও প্রফেশনালিজম ছিল। সাংবাদিক চরিত্রটি সে ডিজার্ভ করে। বৃন্দাবন দাস জেলখানার গার্ডের ভূমিকায় অসাধারণ। চঞ্চলের সাথে তার রাজনৈতিক সংলাপ বিনিময় অাকর্ষণীয় ছিল। দুজনের মধ্যে inter-change এর সময়টা সিনেমার অন্যতম অাকর্ষণ। অন্যান্য চরিত্রগুলো সবাই নিজেদের ফুটিয়ে তুলেছে।

সংলাপ ছিল ‘অায়নাবাজি’-র স্ট্রং পলিসি।পরিচালকের বক্তব্য তুলে ধরতে সংলাপ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ‘অায়নাবাজি’তে সেটাই ঘটেছে।স্ল্যাং বা রুচিশীল দুই ধরনের সংলাপই ছিল। স্যাটায়ারকে তুলে ধরে ‘comedy relief’ দেয়ার কাজটি করেছে সংলাপ। রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরতে চঞ্চলের মুখে কিছু সংলাপ সেনসেটিভ ছিল। ১.’রাজনীতি তো সবচেয়ে বড় অভিনয়।দেশ হলো মঞ্চ, সামনে হাজার হাজার জনতা’- এ সংলাপে বৃন্দাবন দাসের সাথে কথা বলাটা টাচি ছিল। ২.পার্থর সাথে সেলুনে কথা বলার সময় পার্থ যখন বলে ‘এই শহরে আপনার মতো ক্রিমিনাল’ মাঝখানে চঞ্চল বলে ‘অার একটাও নাই, অামি অায়না একজনই’ এ সংলাপটি তার চ্যালেঞ্জিং রোলকে তুলে ধরে। ৩.’চারপাশ বদলে যায়, থেমে যায় সময়। সবার জন্য সব সত্য অামার জন্য শুধুই অভিনয়’ এ সংলাপটি সমাজের সেইসব বাস্তব চরিত্রের জন্য যারা অায়নার মতো সবাই। ব্যঙ্গ করা হয়েছে সমাজব্যবস্থাকে। পপুলারিটি পেয়েছে কিছু সংলাপ যেমন-১.’বোঝো নাই ব্যাপারটা?’ ২.’মজা লাগে ভোর হলে পরেই চরিত্র বদলায়। এক ক্যারেক্টার থেকে অার এক ক্যারেক্টারে শিফট হলেই সব হাওয়া’

কমেডি তুলে ধরতে সংলাপ ছিল অসাধারণ। শরিফুলের ‘ইমেইল’ নামের ছোট্ট সংলাপটি অনেক মজা দিয়েছে। চঞ্চল পার্থকে নাস্তানাবুদ করতে যে সংলাপগুলো বলে নিখুঁত হাসির যোগান দিয়েছে সেগুলো। যেমন-‘ফলোই তো করতেছেন একটু পৌঁছে দেন না বাসা পর্যন্ত’ কিংবা বিদেশী বন্ধুর সাথে কথা বলার সময় উজবেক ভাষার উদাহরণ দারুণ ছিল। মীরাক্কেল ট্যালেন্ট জামিলের নোয়াখালির ডায়ালেক্টে ‘কুদ্দুইচ্যা’ বা ‘অাপনের মাথা সুইসাইড খাইয়া গেছে’ এনজয় করেছে দর্শক।

সিনেমায় গান ছিল টাচি।জীবনমুখী গান সব।অর্ণবের ‘এই শহর অামার’ স্টিল লাইফের চিত্রকে জীবন্ত করেছে। ‘লাগ ভেলকি লাগ’ এনজয় এবং বাস্তব দুটোই তুলে ধরে। ‘অালু পেঁয়াজের কাব্য’ বাজারদরের মাধ্যমে রোমান্টিক ভিন্নধর্মী গান, ‘না বুঝি দুনিয়া’ অাধ্যাত্মিক ছিল এবং টাচি।

সিনেমায় ক্যামেরার ভাষা ছিল দেখার মতো। ড্রোন শট অনেক ছিল। ঢাকা শহরের জীবন্ত ভোর বা সন্ধ্যার সময়গুলো চোখ ভরিয়ে দেয়। দালানের সাথে ছাদ, নদী, অাকাশ ত্রিকোণ অ্যাঙ্গেলে চঞ্চলের দাঁড়ানোর শট অ্যামেজিং। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের বিরল পারফেক্ট ব্যবহারে ক্যামেরার ভাষা অারো সংবেদনশীল ছিল। চঞ্চল জর্জের কাজ করার পর বাথরুমে ঢুকে পরচুলা খুলে নিজের সাথে নিজের মানসিক যুদ্ধ চালানোর মুহূর্তে বা ঝাঁকুনিতে দুলতে থাকা শহরের রাস্তাঘাট, পার্থের মুভমেন্ট এসবে সিনেমাটোগ্রাফি দেখার মতো ছিল। তবে হাইওয়েকেন্দ্রিক শটের অাধিক্য একটু বেশি ছিল যা সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়ে।

সমাজবাস্তবতার মধ্যে অনেক বাস্তবতা থাকে। তার মধ্যে একটা সুনির্দিষ্ট গল্প নিয়ে ‘অায়নাবাজি’ দর্শকের সামনে এসেছে যার বহুমুখী দিক অাছে।বাস্তবসম্মত শিল্পের চাহিদা পূরণ করে দর্শক তৃপ্তিতে এ সিনেমা ঠিক ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে অাছে যেখানে টলিউডের মৌলিক গল্পের জোয়ারটা ঢালিউডে শুরু হতে পারে এ সিনেমার মাধ্যমে। ‘অায়নাবাজি’ সেই যাত্রার উদ্বোধন করল। দর্শক ‘অায়নাবাজি’-র মত সিনেমা দেখতে চায় এবং অমিতাভ রেজার মতো নির্মাতারা দর্শককে এ ধরনের সিনেমা দেখাতে চায়।

পুনশ্চ :
‘অায়নাবাজি’ স্মরণকালে দর্শক বিপ্লব ঘটানো সিনেমা। হাউজফুল শো-র জোয়ার এনে রেকর্ড গড়েছে সিনেমাটি। মৌলিক গল্পের সিনেমার এ সাফল্যে দর্শক মৌলিক সিনেমা দেখতে চায় এটা পরিষ্কার। তাই জোরপূর্বক কপির মিথ্যে উদাহরণ বা বিপক্ষ ভূমিকা নেয়া তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমার দর্শক ঠকানো নির্মাতাদের অপপ্রচার লক্ষ করা গেছে। অাশার খবর দর্শকই তার প্রতিবাদ করেছে এবং ঐ নির্মাতাদের অশনি সংকেত হিশেবে ‘অায়নাবাজি’ ভিত কাঁপিয়েছে। মৌলিক গল্পের সিনেমার এ ইউটার্ন অব্যাহত থাকুক।


Leave a reply