Select Page

আউটসাইডার জালাল ও তার তিনটি গল্প

আউটসাইডার জালাল ও তার তিনটি গল্প

11986965_10156004916495442_2323524293145204396_nসিনেমা : জালালের গল্প

পরিচালক : আবু শাহেদ ইমন

অভিনয় : মোশাররফ করিম, মৌসুমী হামিদ, তেীকির আহমেদ, আরাফাত রহমান, মোহাম্মদ ইমন, শর্মীমালা, নূরে আলম নয়ন প্রমুখ

গল্পতে যে গল্প 

(স্পয়লার অ্যালার্ট: লেখক ছবিটির গল্প নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। কাহিনী অংশটুকু বাদ দিয়ে পড়তে চাইলে তৃতীয় গল্প শেষ হওয়ার পর থেকে পড়ুন। ধন্যবাদ। – মডারেটর)

আমরা ছোটবেলা থেকে অনেক বইতেই পড়েছি ‘এক যে ছিল রাজা’…‘এক যে ছিল রাজকুমার’ কিংবা ‘এক যে ছিল পরী’ এ জাতীয় গল্প। এরকম গল্পগুলোতে একটা আকর্ষণ থাকে। সে আকর্ষণ গল্পের ভেতরের গল্পকে ধীরে ধীরে ডালা সাজিয়ে আমাদের কাছে আনত। আমরা পড়তাম ,নিজের মধ্যে গল্পকে ছুঁয়ে দেখতাম। তারপর এক গোধূলি লগনে বা প্রিয় কোনো সময়ে কারো কাছে গল্পটা বলতাম। কেউ না কেউ তা শুনত মনোযোগ দিয়ে। তার কাছ থেকে ঐ গল্পটা আবার আরো কারো কাছে চলে যেত। এভাবে গল্পটা একদিন  সবার হয়ে যায়।

এক যে ছিল জালাল

সবার কাছে পেীঁছে দেবার মত গল্প ‘জালালের গল্প’। গল্পকে অন্যভাবে বলারও গল্প। ঐ যে বললাম ‘এক যে ছিল’ জাতীয় গল্প সে ধরনের গল্পই কথককে হাজির করে। মানে আড়াল থেকে কেউ আমাদের গল্পটা শোনাচ্ছে আর বলছে ‘এক যে ছিল জালাল’ যার গল্পটা এরকম।‘জালালের গল্প’টা আমাদেরকে বলে দিচ্ছে যে জালাল এ গল্পে প্রবলভাবে আছে আবার প্রবলভাবে নেই।

জাললের গল্প হয়ে যায় ৩টি যেখানে তার জীবনটা ভাগ হয় এভাবে-

১.শিশু জালাল

 ২. কিশোর জালাল

৩. যুবক জালাল

প্রথম গল্প

এই জালাল তার গল্পে নিজেই একটা গল্প। তার গল্পতে সে নিজেই অন্য জালাল। আউটসাইডার জালাল। গল্পে সে নিজেই সবচেয়ে বড় অসহায়, সবচেয়ে বড় ক্লাইমেক্স সে নিজেই, সবচেয়ে বড় টার্ন সে নিজেই আবার সবচেয়ে বড় বিস্ময় সে নিজেই । ঘটনাটা ঘটছে একটা ধর্মব্যবসাকে কেন্দ্র করে যেখানে একইসাথে একটা কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাকে আদর করছে তার মালিক আবার তাকে কাজে লাগাচ্ছে ব্যবসার জন্য । তার পা ধোয়া পানি দিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা ।পা ধোয়া পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে গ্রামবাসীদের সব রোগশোক বা জ্বালা-যন্ত্রণা। প্রথমে বাচ্চার মালিক ব্যবসা করতে না চাইলেও গ্রামবাসীই তাকে বাধ্য করেছে তা করতে ।ব্যাপারটা তাই গভীরে গিয়ে বলে যে কুসংস্কার বা ধর্ম নিয়ে ব্যবসাটা আসলে কখনো কখনো পরিস্থিতিকে মেনে গড়ে ওঠে। সে পরিস্থিতিকে মেনেই ঐ বাচ্চা হয়ে যায় ‘জালাল’ (তার মালিকের ছেলের ‘দুলাল’ নামের সাথে মিল রেখে)..অতঃপর তার গল্পটা শুরু হয় ওখানেই । ধর্মব্যবসার রাজনীতি খুব সূক্ষ্ম তা্ই এটিকে থামাতে গ্রামের মধ্যেই যখন গ্রাম্য রাজনীতি (ভিলেজ পলিটিক্স নামে খ্যাত) শুরু হলে সেই বাচ্চা ‘জালাল’কে ভাসিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত হয় সালিশের মাধ্যমে। তারপর সে ভেসে যায় পাতিলে করে নদীর ঢেউয়ে।

দ্বিতীয় গল্প

এ গল্পতে জালার কিশোর ।যার ঘরে সে থাকে সেখানে বাবার বিয়ের বাতিক আছে। সে বাবা আবার বিয়ে করে শুধু সন্তানের জন্য। দিন যত যায় সন্তানের কোনো লক্ষণ না দেখা গেলে পরে আনা হয় ওঝাকে । ওঝার ভোগ্যপণ্য হয় সেই বধূটি যা বেদনা দেয় গল্পে। জানালার ফাঁক দিয়ে জালাল দেখে যায় সেই ভোগ। তারপর তাকেই লক্ষ্য বানিয়ে ওঝার টেকনিকে জালালকে আবার ভাসিয়ে দেয়া হয় বস্তাবন্দী করে।

তৃতীয় গল্প

জালাল এবার যুবক। তার জায়গা ইটের ভাটায় । ইটের ভাটার মালিক তারও মালিক যে একজন নারীলোভীও। ভোগের জন্য আনা মেয়েটিকে ভোগশেষে যখন সন্তান পেটে এলে তাকে আর মানল না। পরিস্থিতি মেনে নিয়ে বাচ্চা জন্ম নেয়ার পরেই মেয়েটা মারা যায় ।মাঝখানে জালাল সন্দেহে থাকে মালিকের । তারপর প্রমাণ লোপাট করতে বাচ্চাকে ভাসাতে বলে মালিক। বাচ্চাকে ভাসিয়ে দিতে গেলে জালালের নজরে পড়ে। জালাল এবার বাচ্চার সাথে তার ভাব-ভালোবাসার মায়াকে কাটাতে না পেরে বাঁচাতে চায় নদীর পানিতে সেই পাতিলে ভাসা নতুন শিশুকে । তারপর সাঁতার না জানা জালাল নিজেই ভেসে যায় পানিতে। মৃত্যু না দেখালেও মৃত্যুই সত্য জালালের গল্পে।

ভাবছেন এত ঘটা করে আবার গল্পগুলো কেন বলতে গেলাম। একটা উদ্দেশ্য তো আছে বটেই। ফরাসি ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কাম্যু তার বিখ্যাত ‘আউটসাইডার’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন কীভাবে একটা লোক নিজেই তার অস্তিত্বের কাছে আউটসাইডার হয়ে যায়।মায়ের মৃত্যুকে স্মরণ করতে না পেরে খামখেয়ালি করে খুন করা সে নায়কটি একময় ফাঁসিতে ঝোলে যে আসলে নিজেকে খুঁজতেই এসব করেছে। নিজের অস্তিত্ব খুঁজতে নিজেই এভাবে হারানো এক লোক হয়ে যায় সে। লোকটির নাম মার্সেল। আর এ সিনেমায় যে লোকটি নিজের অস্তিত্বের কাছে হারিয়ে গেছে, যেন খুঁজে পাচ্ছে না সে নিজেকেই সে লোকটি ‘জালাল’।

আউটসাইডার জালাল ও তার অস্তিত্বের গল্প

জালালের অস্তিত্ব অনেকভাগে ভাগ হয়েছে ধর্মব্যবসার পণ্য হওয়া জালাল, অসহায় শৈশবের জালাল, প্রেমিক জালাল, দায়িত্ববান জালাল, স্নেহশীল জালাল, মৃত্যুকামী জালাল….

এ সবগুলোই একটা জালাল আর জালাল সবগুলোর সমষ্টি। জালাল নিজেকে খুঁজতে গিয়ে পেয়েছে সেটি বলাটা অন্যায় হবে। সে নিজেকে খুঁজতে যাবার যে একটা অভিযান শুরু করেছিল সেই আঙুলচোষা শিশু থেকে তার শুধু বয়ে যাওয়াই আছে । জালাল তার গল্পটা বলতে পেরেছে অন্য মানুষদের দিয়ে যে মানুষগুলো তাকে ব্যবহার করেছে। এর বেশি কিছু নয় । আর নদীতে বারবার ভাসিয়ে যাওয়া জালাল তাই শেষ দৃশ্যে এসে যখন ইটের ভাটার মালিক ও তার অব্যক্ত ভালোবাসা মালিকের ভোগ্য মেয়েটির সন্তানকে বাঁচাতে যায় তখন মর্মান্তিক সত্যটা আরো ধরা দেয় বড় আকারে। সে জালাল তখন সাঁতার না জানা এক অসহায় যুবক যাকে মৃত্যুই আপন করে নিল এবং সেই নতুন শিশুটির মতই তাকে মানতে হল যে সে শুধু ভাসতেই এসেছিল জীবনের ভেলায় তাই ভাসতে ভাসতেই তার জীবনটা শেষ হল..এ এক বেদনাবিধুর গল্প..

নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা

পরিচালক আবু শাহেদ ইমন বলতেই পারেন তাঁর নিজ হাতের কাঁচা ঘরের কথা যেখানে স্বল্প বাজেটের সিনেমাই একটা নতুন গল্পের স্বাদ দিতে পারে ।তিনি বলতেই পারেন বা দাবি করতেই পারেন যে তিনি কাঁচা ঘরকে খাসা করে গড়তে জানেন। জানাতে পারেন সিনেমাকে বদলাতে হবে ঠিক এভাবেই।

টেকনিক

তিনি সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন যেমন খালি চোখে দেখা ছবির মতই সুন্দর অনুভূতিতে তেমনি তিনি ক্যামেরাকে যেন শাসন করে গেছেন তার ক্যামেরাম্যানের হাতে । তার পিকগুলো বাস্তব। আমি আপনি বাস্তব তো রোজই দেখছি। খবরের কাগজ খুললেই ধর্ষণ, খুন, প্রতারণা, অবৈধ প্রেম, অবৈধ সন্তানের জন্ম দেয়া, ধর্মব্যবসা এসব দেখতে পাচ্ছি তাই এ সিনেমার বাস্তব অবস্থাগুলো এক একটা চোখে দেখা দৃশ্যের সমষ্টি ।

অভিনয়

অভিনয়ে তিনি চারভাবে সাজিয়েছেন চরিত্রকে…১.মানুষ…২.পশুপাখি…৩.গাছপালা…৪.নদী…

পরিচালক একজন কারিগর যিনি তাঁর সিনেমাতে গড়তে পারেন সবকিছুই। তাঁর সিনেমার মানুষগুলো অন্যরকম জীবন্ত। তিনি অভিনেতা মোশাররফ করিমকে দিয়ে অভিনয়কে একইসাথে সিরিয়াস ও কমেডি দুই ধাঁচেই আদায় করে নিয়েছেন। মোশাররফ করিম যে কোনো ক্যারেক্টার করতে পারেন যেটা তার সহজ স্বাভাবিক প্রতিভা। উনি একহাতে সিগারেট ধরাতে গিয়ে ঠিক ঐ মুহূর্তেই হাসেন আবার মেীসুমী হামিদের পাশে বসে একই শটে মুহূর্তে হাসতেও পারেন আবার কাঁদতেও পারেন। এক বসায় প্রেমিকার সাথে চিয়ার্স করতে পারেন, প্রেমিকার পেটের সন্তানকে না মানলে যখন প্রেমিকা তার গলা চেপে ধরতে আসে ঠিক ঐ সময় বদলে যায় তার আচরণ। জালালকে বাস্তবজ্ঞান শেখাতে ইটের ভাটার ইট ছুঁইয়ে বাস্তবকে ‘শক্ত’ হিশেবে দেখান যার কাছে বর্তমানের অনেক সিনেমাই বাস্তবতা দেখানোতে ম্লান হয়ে যায়। তাঁর হাসি আর কান্নার মাঝে সুইচ অন অফ করার যে ক্ষমতা তাকে দেখতে  দুটি চোখ যত্ন করে সজাগ রাখতে হয় নয়তো অনেককিছুই আপনি মিস করতে পারেন অনায়াসে।মেীসুমী হামিদ তার অভিনয়ে রাগ, অভিমান, গর্ভবতী মেয়ের যন্ত্রণা সহ্য করা সবকিছুই জীবন্ত করেন। তেীকিরের অভিনয়ে সেই জমিদারি চালচলন যেন আগেকার একটা এতিহ্যই টের পাইয়ে দেয়।তেীকিরের বেী চরিত্রে শর্মীমালা বাধ্য বধূরূপে যেন একেবারে অসহায়। এ অবস্থা আজো বহুবিবাহর কথা মনে করায়। ওঝা পুরো সঙ সেজে থাকা একটা বাস্তব চরিত্র। সে জানে প্রতারণাটা কিভাবে করতে হয় আর নিজের ফায়দাটা লোটা যায়। ধর্বমব্যবসা করা জালালের বাবা নূরে আলম নয়ন ন্যাচারাল অভিনয়ে স্বচ্ছন্দ । জালালের অভিনয়ে ইমন ও আরাফাত কিশোর ও যুবকে নতুন প্রতিভা। ছেলেগুলোকে কাজে লাগালে আরো খাঁটি কিছু মিলবে। অভিনয়গুলোকে পরিচালক হাতে-কলমে আদায় করেছেন।

পরিচালক নিখুঁত অভিনয় থেকে রেহাই দেননি বসতবাড়ির পশুপাখিগুলোকেও । তাইতো ক্লোজশটে দেখানে বাড়ির কুকুরগুলো একজন আরেকজনের উপস্থিতি সহ্য না করে যেভাবে ঘেউ ঘেউ করে সে ডাক চোখে দেখা ঘেউ ঘেউ করা কুকুরকেই মনে করায় ।হাঁসগুলো বলি হবার সময় জীবন বাঁচাতে পালাতে চায় মানুষের মত করেই। পায়রাগুলো খোপ থেকে বের হয় আর চরে খেতে থাকে গাঁয়ের চরে খাওয়া পায়রার মতই ।

গাছপালাগুলো হাওয়ায় দুলে যেন বলে যায় তারা কতটা জীবন্ত আর তার অক্সিজেনে বেঁচে থাকা মানুষগুলো কতটা নিষ্ঠুর।

নদী সবচেয়ে বড় চরিত্র এ সিনেমার।নদীতেই জাললকে পাই প্রথমে,নদীতেই জালালকে ভাসানো হয় দুবার আবার নদীতেই স্নেহশীল জালাল তারই মত একটা শিশুকে বাঁচাতে নদীর মত অসীমে মিলিয়ে যায়…নদী তবে বড় চরিত্র না হয়ে যায় কোথায়!..এ চরিত্র জীবনের চরিত্র যেখানে মেলে ঐ সত্য যে জীবন কঠিন…

পরিচালকের প্রতি

হ্যাঁ আপনাকেই বলছি…এ তো মাত্র শুরু…পরের শিল্পতে এই শিল্পের পাল্টে যাওয়া গল্পের সিনেমা যেন পাই এ দায়টা আপনারই…আর দেখেশুনে কিছু একটা বলার জন্য আমি ও আমরা তো আছিই…


মন্তব্য করুন