আকাশচুম্বী প্রত্যাশার কতটা পূরণ করেছে ‘সাবরিনা’?
‘সাবরিনা’ যেহেতু বানিয়েছেন আশফাক নিপুণ, স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল বেশি। সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় বেশকিছু নাম যদি যুক্ত থাকে তাহলে প্রত্যাশার আকাশচুম্বী জায়গায় পৌঁছাতে না পারাটাই অনেক সময় খুব স্বাভাবিক। এবং হইচই-এর ওয়েব সিরিজটিতে নিপুণ আমাদের হতাশ করেননি। যেমনটা ভারতীয় এ প্ল্যাটফর্মে সাড়া ফেলে দেন ‘মহানগর’ দিয়ে।
‘সাবরিনা’ মেহজাবিন চৌধুরীর প্রথম ওয়েব সিরিজ, তাই আগ্রহের মাত্রা যোগ হয়েছে বহুগুণ। তবে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে সমাজের চেনা-অচেনা গল্প তুলে ধরা হয়েছে একই নামের দুই নারীর দৃষ্টিকোন থেকে। যেখানে নিপুণ সফল হয়েছেন পুরোপুরি।
অনেক লম্বা সময় ধরে চলে আসা নিয়ম-অনিয়মের মেলবন্ধন নিয়ে আমাদের সমাজ, দেশ অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলে আসছে তাই নিপুণ তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে। একটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের মধ্য দিয়ে যে গল্প শুরু হয় তা আস্তে আস্তে ডাক্তার, সাবলেট থাকা মধ্যবিত্ত পরিবার, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, সাংবাদিক, এমএলএম ব্যবসা, ভূমিদস্যু, রাজনৈতিক ক্ষমতা, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, জবর দখল, টেকনোলজি, নানা প্রটোকল এমনকি ক্রস ফায়ার ইস্যু পর্যন্ত নিয়ে গেছে আমাদের।
রাজনৈতিক গল্প আমাদের নির্মাতারা এড়িয়ে যান, এই এড়িয়ে যাবার কারণ যে নাই সেটা যেমন সত্য তেমনি যতটা সৎ সাহস আর স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তিনি ‘সাবরিনা’ বানিয়েছেন তা সামনের দিনে অন্য নির্মাতা এবং গল্পকারদের নতুন ভাবনা-চিন্তার খোরাক জাগাবে সেটাও সত্য। সুন্দর গল্প, যুগোপযোগী চিত্রনাট্য, চোখ জুড়ানো সিনেমাটোগ্রাফি, মানানসই কালার গ্রেডিং, প্লটের সঙ্গে মিল খাওয়া বিজিএম, কিছু অসাধারণ সুন্দর সংলাপ সঙ্গে মেকআপ এবং কস্টিউম ডিপার্টমেন্টের অনবদ্য কন্ট্রিবিউশান মিলিয়ে ‘সাবরিনা’ দারুণ নান্দনিক।
অভিনেতা হিসেবে সিরিজে যাদের দেখা মিলেছে তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন সময়ে মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে ডিবি অফিসার হিসেবে ডা. এজাজ এবং ফারুক আহমেদের অভিনয় নিয়ে যতটা আগ্রহ ছিলো তা পূরণ হয়নি। হাসান মাসুদ চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। রুনা খান বরাবরই ভালো অভিনয় করেন এবারও তার ব্যতিক্রমী ঘটেনি। বেবি চরিত্রে তিনি সাবলীলভাবে উতরে গেছেন।
ইয়াশ রোহান যতটা দরকার ছিল ঠিক ততটাই করেছেন না; অনেক ভালো না মন্দ। মনির খান শিমুল ও নাদের চৌধুরী চরিত্র অনুযায়ী মানানসই। ইন্তেখাব দিনার ওটিটি যুগে এসে একের পর এক চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন। আশফাক নিপুণের পরিচালনায় আরও একবার প্রমাণ করলেন, তার দেওয়ার আছে অনেক কিছু। শাওন খল চরিত্রে রীতিমতো চমকে দিয়েছেন। গল্প ও চিত্রনাট্য অনুযায়ী বিশ্বাসযোগ্য ও অনবদ্য অভিনয়।
নাজিয়া হক অর্ষা এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। ভিকটিম সাবরিনা চরিত্রে তার লুক তো বটেই; তার অভিনয়ের প্রশংসা যতই করা হোক না কেন সেটা কম হবে। এই চরিত্রে আর কাউকে কল্পনা করা যাচ্ছে না। এবং সবার শেষে বলতে বা লিখতেই হয় ‘সাবরিনা’ সিরিজের তুরুপের তাস মেহজাবিন চৌধুরীকে নিয়ে। ডা. সাবরিনা চরিত্রে প্রমাণ করলেন, কেন তিনি সময়ের সেরা অভিনেত্রী! নন মেকআপ লুক, চাহনি, কস্টিউম, ভিকটিম সাবরিনার জন্য মায়া এবং একই সঙ্গে ন্যায় বিচার চাওয়া, কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব আবার নিজের সবটুকু নিয়ে জ্বলে উঠা; সব মিলিয়ে এমন এক মেহজাবীনকে দেখতে পাওয়াটাই তো একটা ট্রিট।
ধুমধাড়াক্কা মারপিট, অশ্লীল গালাগালি, অহেতুক যৌনতা ছাড়াও ‘ওয়েব সিরিজ’ বানানো যায় সেটা আশফাক নিপুণ জানিয়ে দিলেন আবারও। থ্রিলার বা সাসপেন্স প্লটেও সমাজ, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরা যায় তার বাস্তব উদাহরণ এই আট এপিসোডের ‘সাবরিনা’।
এই সময়ে এসে দর্শক গতিময়তা পছন্দ করে বেশি। তাই হয়তো কিছুটা স্লো মোশনে দৃশ্যপট বা গল্পের এগিয়ে যাওয়াটা অনেকের কাছে বিরক্তি এনে দিতেও পারে। এ ছাড়া মিলনাত্মক বা বিয়োগান্তক পরিণতি দেখে দেখে অভ্যস্ত আমাদের মন বা চোখ এই সিরিজের শেষটা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারবে না। তবে সবকিছু সিলেবাস অনুযায়ী কমন পড়বে এমনটাও তো জরুরি না। প্রথম দুই এপিসোড যতটা টানটান পরের কিছু এপিসোডে সেটায় ছন্দপতন ঘটালেও বিরক্তি আনেনি। কিছু কিছু দৃশ্যে তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হয়েছে বলেও মনে হলো। তবে তা গল্পের গতিরোধ করে নাই সেটাই স্বান্তনা।
খুব লক্ষ্য করে দেখলে বাতাবি লেবু, তেলের বদলে পানির মতো কিছু বিষয় সিরিয়াস এই কনটেন্টে মাঝে মাঝে হাসির খোরাক বা রিলিজ যোগায়। তবে দ্বিতীয় সিজনের জন্য সাসপেন্স ধরে রাখার উপাদান নির্মাতা সফলভাবে তুলে রেখেছেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। গল্প যেহেতু ভালো এবং সেটা ঠিকঠাকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাই পরের সিজনের জন্য অপেক্ষার পালা দীর্ঘ না হোক সেটাই কামনা।