Select Page

আজ-কাল-পরশুর শিল্পী সুবীর নন্দী

আজ-কাল-পরশুর শিল্পী সুবীর নন্দী

সুবীর নন্দী নামটাই যথেষ্ট।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সমানভাবে জনপ্রিয় একজন কিংবদন্তি শিল্পী। কণ্ঠ তাঁর সুমধুর। একবার শুনলে বারবার শুনতে মন চায় তাঁর গান। তিনি সব সময়ের শিল্পী, আজ-কাল-পরশুর।

‘এই দুনিয়ার রাস্তাঘাটে কত মানুষ ঘোরে ফেরে
কার গাড়ি যে কখন বন্ধ হবে রে
কেউ তো জানে না’
**
‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়
দুঃখ হারায় না
কেন স্বপ্ন ভেঙে যায়
মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখে না’
**
‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি
আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই’
**
‘চাঁদে কলঙ্ক আছে যেমন
ভালোবাসায় বদনাম আছে তেমন
তবে টলল কোথায় কবে প্রেমেরও আসন
প্রেমিকেরও মন’
**
‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝর্ণা বলো
ঐ পাহাড়টা বোবা বলে কিছু বলে না
তোমরা কেন বোঝো না যে
কারো বুকের দুঃখ দিয়ে কাব্য চলে না’
**
‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে
কিছুই আমার ভালো লাগে না’
**
‘সেই দুটি চোখ
আমার জীবনের বিশ্বাস’
**
আমি পথে পথে ঘুরি
আমার নাই যে কোনো ঠিকানা
আমার মনের মাঝে বসত কাহার
নিজেই জানি না রে আমি নিজেই জানি না’
**
‘তোমার চোখের ভাষা তুলিকা পারেনি আঁকতে
তোমার মৌনতা সঙ্গীত পারে না ধরতে
কবিতা কি করে বলো পারবে তোমার মন বুঝতে’

আধুনিক গানের ভাণ্ডারকে কী দিয়ে গেছেন সুবীর নন্দী এ গানগুলোই বলে দেয়।

জন্ম – ১৯/৩০ নভেম্বর ১৯৫৩, হবিগণ্ঞ্জ, সিলেট। ডাকনাম বাচ্চু। অনেক ডানপিটে ছিলেন ছোটবেলায়। পূজার সময় একবার বাগানের ফুল চুরি করতে যান কারণ মালীর কাছে ফুল চাইতেও দেয়নি তাই। কালীপূজায় পটকা ফুটিয়েছিলেন একবার পকেটের মধ্যে। ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল।

বাবার অনেক গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল। সেগুলোতে গান শুনতেন। দাদাভাই রোকনুজ্জামান খানের ‘কচি কাঁচার আসর’-এ যেতেন নিয়মিত। সিলেটের চা-বাগানের প্রকৃতিতে তাঁর উদ্দাম শৈশব-কৈশোর কেটেছিল।

হবিগণ্ঞ্জের ‘সুরবিতান ভবন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ওস্তাদ বাবর আলী খানের সরাসরি ছাত্র ছিলেন তিনি। প্রতিদিন তাঁকে সেখানে দেখে একদিন গুরু কাছে ডেকে নেন। জানতে পারেন গানের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা আছে। গান তুলে দেন নিজ দায়িত্বে এবং সুবীর নন্দী তা গেয়েও শোনান। এরপর থেকে ওস্তাদের প্রিয় ছাত্রে পরিণত হন। গুরু বলতেন গান গাওয়ার আগে বসা শিখতে হবে। গুরুর কাছে গান গাওয়ার সময় কিভাবে বসতে হবে শিখেছিলেন।

হবিগণ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। বৃন্দাবন সরকারি কলেজের সব অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিতেন।

চাকরি করতেন জনতা ব্যাংকে। চাকরি করার ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি হচ্ছে সংসার, সন্তানদের প্রতি নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য গানের পাশাপাশি চাকরি করা দরকার। ছাত্রজীবনে দারিদ্র্যের মধ্যেও দিন কেটেছে তাঁর তাই জীবন সম্পর্কে ছিলেন সচেতন।

তৃতীয় শ্রেণি থেকেই গান গাইতেন। ১৯৬৭ সালে সিলেট বেতারে গান করা শুরু করেন। প্রথমদিকে তিনি নজরুল সঙ্গীত চর্চা করতেন। বেসিকই ছিল নজরুল সঙ্গীত কিন্তু তাঁর কণ্ঠে এ গান সমালোচিত হতে থাকে। পরে অনেকের পরামর্শে আধুনিক গানে মনোনিবেশ করেন।

১৯৭৬ সালে প্রথম প্লেব্যাক করেন কিংবদন্তি পরিচালক খান আতাউর রহমানের ‘দিন যায় কথা থাকে’ ছবিতে। এ ছবিতে নায়ক ফারুকের লিপে ‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে’ গানটি মাতালের ঢঙে গাইতে হবে। তখন খানআতা তাঁকে বলেন গাইতে পারবেন কিনা, মাতাল দেখার অভিজ্ঞতা আছে কিনা। সুবীর নন্দী জানান চা-বাগানে মাতাল তিনি দেখেছেন। তখন রেকর্ডিং করা হয় গানটি এবং মানুষ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। খুব পান খেতেন। পান মুখে নিয়ে গান গাইতেন। ‘অংশীদার’ ছবির ‘তোমারই পরশে’ গানটি গাইতে গিয়ে ‘র’-এর উচ্চারণটা হত না পান মুখে থাকার কারণে। সুরকার সত্য সাহা খুব মন খারাপ করলেন রেকর্ডিং হবার সময়। একসময় রেগেও যান। পরে সহকারীকে পাঠিয়ে ব্রাশ আর টুথপেস্ট এনে দাঁত মেজে তারপর রেকর্ডিং করলে একবারেই টেক হয়ে গেল। ঐ যে পান খাওয়া ছেড়েছেন আর খাননি। গানটি পরে টলিউডে রিমেক হয় ‘আমাদের সংসার’ ছবিতে উদিত নারায়ণের কণ্ঠে ফেরদৌসের লিপে। উদিত নারায়ণেের সমস্যা হয়েছিল প্রথমে এবং মূল গানের সুবীর নন্দীর প্রশংসা করেন। ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’ গানটি রেকর্ডিং এর পর ‘দুর্বার’ অনুষ্ঠানে বারবার বাজানো হয়েছিল পাবলিক ডিমান্ডে।

‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটি প্রথম সুবীর নন্দী-র কণ্ঠেই জনপ্রিয় হয়। কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে-র গান নিয়মিত গাইতেন বলে মান্না দে স্নেহ করতেন সুবীর নন্দীকে। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়তার পেছনে নিজের গান ছাড়াও মান্না দে-র গান গাওয়াটা অন্যতম কারণ ছিল।
ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী আল্লারাখা, পণ্ডিত রবিশঙ্করকে তিনি গান শুনিয়েছিলেন। ৫০ পাউণ্ডের পুরস্কার পেয়েছিলেন আল্লারাখার কাছে।

কবি জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের বেশকিছু কবিতা গান আকারে গেয়েছেন তিনি। গানগুলো তাঁর কণ্ঠে ম্যাচিং হয়েছে অসাধারণভাবে।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ৫ বার – (মহানায়ক, শুভদা, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘের পর মেঘ, মহুয়া সুন্দরী)
বাচসাস পুরস্কার ৩ বার – ১৯৭৭, ১৯৮৫, ১৯৮৬
একুশে পদক পেয়েছেন ২০১৯ সালে।

চলচ্চিত্রে তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে। সেসব গানের মধ্যে উল্লেখযেগ্য কিছু :
হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে – মহানায়ক
আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয় – মহানায়ক
দিন যায় কথা থাকে – দিন যায় কথা থাকে
নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে – দিন যায় কথা থাকে
বন্ধু হতে চেয়ে তোমার – মাটির মানুষ
তুমি এমনই জাল পেতেছ – শুভদা
জীবনের গল্প এত ছোট নয় – রাম রহিম জন
তোমারই পরশে জীবন আমার – অংশীদার
বন্ধু তোর বরাত নিয়া – বন্ধু
আমার নায়ে পার হইতে – মাটির ঘর
কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো – উসিলা
মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত – অশিক্ষিত
ঐ রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে – কাজল লতা
ঝিলমিল ঝিলমিল করবে রাত – সন্ধি
দিনে দিনে এ দুনিয়াটা কত যে বদলে গেছে – সমর
এ দেহ হইলো শুধু আমার – কুসুমকলি
একটা চিঠি লিখে দাও – সন্ধান
পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন – মায়ের অধিকার
তোরে নিয়া আশা যত – মায়ের অধিকার
আমায় অনেক বড় ডিগ্রী দিছে মা – বিক্ষোভ
তুমি আমার মনের মানুষ – স্বপ্নের পৃথিবী
মামা ও মামা আমি তোমার ভাগিনা – স্নেহ
কোন ডালের পাখিরে তুই – আনন্দ অশ্রু
কি করে বলব তোমায় – আব্দুল্লাহ
আমার যা কিছু সবই তো – রাঙ্গা ভাবী
মেনেছি গো হার মেনেছি – গরম হাওয়া
তুমি সুতোয় বেঁধেছ শাপলার ফুল – হাজার বছর ধরে
ও আমার উড়ালপঙ্খী রে – চন্দ্রকথা
একটা ছিল সোনার কন্যা – শ্রাবণ মেঘের দিন
মন চায় বুক চিরিয়া – পাহারাদার
ভালোবাসি সকালে – মেঘের পরে মেঘ
আশা ছিল মনে মনে – হাজার বছর ধরে
এই অন্তরে পুষি যারে – জীবন সীমান্তে
এক সুন্দরীর প্রেমে – ভণ্ড প্রেমিক
চাঁদে যে গ্রহণ লাগে – তোমার জন্য ভালোবাসা
তুমি স্বপ্ন তুমি স্বর্গ – আকাশছোঁয়া ভালোবাসা
তাঁর চলচ্চিত্রের গানের মধ্যে কিছু আধুনিক গান যেগুলো পরে চলচ্চিত্রে কাজে লাগানো হয়েছিল।

কিংবদন্তির মৃত্যুস্রোতে সঙ্গীতের জগতে আমাদের অভিভাবকহীন করে দিয়ে অবশেষে সুবীর নন্দী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০১৯ সালের ৭ মে। এর আগে তিনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন চারবার এবং লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।

সুবীর নন্দীর মৃত্যু নেই। যে গর্বিত সঙ্গীতভুবন তিনি রেখে গেছেন তার নির্যাস বাঙালির মনে ও মননে থেকে যাবে সারাজীবন। তাঁর কাজের চর্চার মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন প্রতিদিন।


মন্তব্য করুন