Select Page

আদিম রিপুর কথা বলে ‘আদিম’

আদিম রিপুর কথা বলে ‘আদিম’

যুবরাজ শামীম পরিচালিত ‘আদিম‘ সিনেমাটি টঙ্গী রেলস্টেশনের বস্তিতে টিকে থাকা সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের গল্প বলে। আদিম রিপুর প্রতিটা উপাদান যে বস্তিতে উপস্থিত। যে সমাজে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধুমাত্র chaos আর chaos.
গল্পের মূল দুই চরিত্র কালা আর সোহাগী। দুজনের এই ছোট্ট সংসারের শান্তি নেই স্বামীর মাদকাসক্তির জন্য। সংসারের মায়ার জালে জড়ানোর চেয়ে অপরাধের জালে জড়িয়ে যাওয়া ‘কালা’র কাছে বেশি সহজতর আর সুখকর মনে হয়। দারিদ্র‍্যের যাঁতাকলে পিষ্ট কালা মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সাথে মিলেমিশে চুরি করা আর দিনশেষে মাদকের আখড়ায় পড়ে থাকা। আর সংসার নামের গাড়িটাকে টেনে নেয়ার দায়িত্ব যেন শুধুমাত্র সোহাগীর; আবার নিজের সেই কাজটা করার পরেও সেই কীনা হয় সবচেয়ে নিগৃহীত।

তাদের এই জীবনে হুট করে আবির্ভাব ঘটে ‘ল্যাংড়া’ নামের চরিত্রের। ভাই হিসেবে আশ্রয় দেয়া, তার কাছ থেকে খাবারের বিনিময়ে মাসে ভালো পরিমাণ টাকা পাওয়া- এসবের জন্য ‘কালা’ বেশ সুখেই দিনাতিপাত করছিল। কিন্তু মানুষের আদিম প্রবৃত্তি যখন জেগে উঠে, প্রবৃত্তি যখন পরকীয়ার দিকে ধাবিত হয়, তখনই শুরু হয় আদিম রিপুর খেলা আর সেই খেলার অন্তিম পরিণাম হয় ভয়াবহ।

আদিম সিনেমায় পরিচালক যুবরাজ শামীম আলাদা করে কোন ‘গল্প’ বলেন নাই, বস্তিবাসীদের জীবনে যা ঘটে, যা নিত্যনৈমিত্তিক তাদের জীবনে সেটাকেই ক্যামেরায় তুলে এনেছেন আর সেটাই এই সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। এই সিনেমার জন্য তিনি টংগীর বস্তিতে সাত মাস থেকেছিলেন, আলাদা একটি গল্প নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন শুটিং করবেন বলে। সাতমাস পরে তিনি আবিষ্কার করলেন, এই বস্তিবাসীদের জন্য আলাদা করে কোন গল্প বলার দরকার নেই; এখানের প্রায় প্রতিটা ঘরে ঘরে যে গল্প প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে, সেটাকেই সৎভাবে বলে গেলে একটি সৎ সিনেমা দাঁড়িয়ে যাবে আর সেটাই হয়েছে।

শুরুর ১৫-২০ মিনিটে কিছুটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল, সিনেমাটা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে বা পরিচালক আসলে কী দেখাতে চাচ্ছেন? আরেকটা সো কল্ড বস্তিবাসীদের অপরাধ চক্র বা মাদকের আখড়ার টিপিক্যাল গল্প না তো? সেই সন্দেহ দূরীভূত হয় আদিম প্রবৃত্তির গল্প শুরুর পর থেকেই; এরপরে শেষ পর্যন্ত সিনেমাটা এক নি:শ্বাসে দেখা যায়।

মাদক, ছিনতাই, গালিগালাজ, নিজের অক্ষমতা প্রকাশের অনীহা, সন্দেহ আর সেই সন্দেহের দানা থেকে তৈরি হওয়া ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, পরকীয়া, খানিকটা সুখের আশায় প্রায় অপরিচিত একজন মানুষের সাথে ঘর পালানো, কাউকে নিজের জায়গা ছেড়ে না দেয়া এমনকি সেটা কুকুরের মত প্রাণী হলেও, অর্থের জন্য ছলনা, লালসা- এমন খুব কম আদিম প্রবৃত্তিই আছে যা এই সিনেমায় উঠে আসেনি।

সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক সম্পূর্ণ অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে এমন চমৎকার অভিনয় বের করে আনা, কোন আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক না রেখে এম্বিয়েন্স সাউন্ডের সাহায্যেই পুরো সিনেমা শেষ করা যেখানে রেলস্টেশনের কোলাহল থেকে শুরু করে ডিপজলের বলা সিনেমার সংলাপ- সবই আছে। প্রোডাকশন ডিজাইন খুবই চমৎকার, আসল বস্তিতে শুট করার কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছে বোধ করি। আমীর হামজার হ্যান্ডহেল্ড শটে বেশিরভাগ দৃশ্য হয়েছে অনেক বেশি রিয়েলিস্টিক। বস্তিবাসীরা নিজেদের জীবনের যাবতীয় অনুভূতি খালি গলায় গাওয়া গান গেয়েই প্রকাশ করে আর এই সিনেমাতেও তেমনটা রাখা হয়েছে; আলাদা করে কোন সংগীতআয়োজন করা হয়নি। যদিও একটি গানের লিরিক্স রাইটার হিসেবে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নাম দেখে একই সাথে বিস্মিত আর দু:খ পেয়েছি। কী এক রত্ন যে হারিয়েছি আমরা তা আবারও মনে পড়ে গেলো!

সিনেমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক, বিভিন্ন মেটাফোরের ব্যবহার। স্টেশনে আসা ট্রেন আর স্টেশন ছেড়ে যাওয়া ট্রেন দিয়ে জীবনের বহমানতা, মানব সভ্যতার সবচেয়ে আদিম সঙ্গী যে প্রাণীকে বলা হয় সেই কুকুর দিয়ে আবারও আদিম জীবনযাত্রার দিকে ইঙ্গিত দেয়া কিংবা সদ্য কিনে আনা লাফাতে থাকা মাছ দিয়ে fish out of the water পরিস্থিতি বুঝানো- সব জায়গাতেই পরিচালক সফল।

আদিম সিনেমাটি আরও অনেক কিছু বলে বা বলার চেষ্টা করে টঙ্গীর এই নাম না জানা বস্তিবাসীদের মাধ্যমে। আদিম প্রবৃত্তি তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকলেও, এটা শুধুমাত্র এই নিম্নবর্গের শ্রেণীতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং হতে পারে এদেরকে সামনে রেখে ডিরেক্টর সমাজের প্রতিটা শ্রেণীর আদিম প্রবৃত্তি; সেটা হোক লালসা কিংবা বিশ্বাসঘাতকতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। খারাপ লাগে এই ভেবে, এতকিছুর মাঝেও একজন নারীর দিনশেষে সেভাবে কোন মূল্য থাকে না; তার নিজের ইচ্ছে বা পছন্দ অপছন্দের কোন মূল্যায়ন হয় না; সন্দেহের তীর সবসময়ই তার দিকে থাকে আর পুরুষের শত অপরাধ সহজেই এড়িয়ে যাওয়া হয় আর এরপরেও দিনশেষে কোন নারী নিজের মত জীবন বেছে নেয়ার চেষ্টা করলেও সেখানেও বেশিরভাগ সময় সে স্বীকার হয় বিশ্বাসঘাতকতার, মিথ্যার, ছলনার। ল্যাংড়ার পূর্বের জীবন সম্পর্কে সোহাগির না জানাটা সেটিই নির্দেশ করে। আদিম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দেখায়, মানুষ সব ভুলে গেলেও অপমানিত হওয়ার জ্বালা ভুলে না আর এর প্রতিশোধ সে কোন না কোনভাবে নিয়েই থাকে। ল্যাংড়ার অন্তিম পরিণতি তাই-ই নির্দেশ করে।

আদিম দেখতে দেখতে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের কথা, সিনেমার শেষে ক্রেডিটলাইনে মানিকের নাম দেখে আরও নিশ্চিত হলার পরিচালকের পছন্দের ব্যাপারে।
চোখে লাগার মত খুব ছোটখাটো বিষয় হচ্ছে, অপেশাদার অভিনেতাদের কিছু ছোটখাটো ভুল। মৃত লাশের চোখ হালকা কেঁপে ওঠা কিংবা বউ পেটানোর সময় ব্যাপারটা একটু কম রিয়েলিস্টিক লাগা। যদিও এক ঘন্টা ২৫ মিনিটের সিনেমার ক্রিস্পি এডিটিং সব পুষিয়ে দিয়েছে দিনশেষে।

আদিমের মত সিনেমা আমাদের এখানে কালেভদ্রে হয়। আদিম একটি ডিরেক্টর’স সিনেমা। পরিচালক যুবরাজ শামীম সাহস করে নিজের গল্পটা বলে ফেলেছেন নিজের মত করে। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সিনেমার নির্মাণ শেষ করেছেন, মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরষ্কার পেয়েছেন। কোন গিমিক না থাকা, স্টার না থাকা এই সিনেমা কতদিন সীমিত সংখ্যক হলে চলবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই তবে দিনশেষে এটি একটি সৎ সিনেমা হয়েছে, যার ভীষণ প্রয়োজন আছে।

ভালো সিনেমা, সৎ সিনেমা দেখতে চাইলে আদিম দেখা উচিত আপনার। দর্শক হিসেবে আপনার উৎসাহ, আপনার কাঁটাছেড়া, আপনার বিস্তারিত মন্তব্যই এই ধরনের সিনেমার নির্মাণ বাড়াবে, সাথে বাড়বে সৎ পরিচালকের পরিমাণ। আদিম সিনেমার পুরো টিমকে ধন্যবাদ এমন একটি সিনেমার জন্য।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

অভিনেতা, শিক্ষক, লেখক ও উদ্যোক্তা

মন্তব্য করুন