Select Page

আন্ডার কনস্ট্রাকশনে দর্শকের গন্তব্য

আন্ডার কনস্ট্রাকশনে দর্শকের গন্তব্য

rubayet-uc1

রুবাইয়াত হোসেনেরআন্ডার কনস্ট্রাকশনে’ পাওয়া যাবে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে জীবনকে সমর্পণ করা কয়েকজন নারীকে। প্রধান চরিত্র রয়া। সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্যে তার উপস্থিতি। এমনকি যখন দালান-কোঠা নির্মাণের দৃশ্য দেখানো হয় বা গৃহকর্মী দূর থেকে লিফটম্যানের সঙ্গে ইশারায় কথা বলে— তখনও। একটি শহরের নানান টুকরো দৃশ্যের সমান্তরালে রয়ার চলাচল। অর্থপূর্ণ দৃশ্যমানতা। মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতার অংশ, আবার একাও। বাক বিনিময়ও সংক্ষিপ্ত ও সংযত। যা হয়ত নীরবতার মাঝে জীবনের অর্থময় হয়ে উঠার কথা বলে। যা এখনও ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’।
রুবাইয়াতের দ্বিতীয় নির্মাণ নিয়ে ইতোমধ্যে যৎসামান্য আলোচনা হয়েছে। সামনেও নিশ্চয় হবে। সেখানে থাকবে সিনেমা কেমন হলো, অদৌ হলো কি-না— এমন জ্ঞানগর্ভ, মৃদৃ ও লঘু কথাবার্তা। আপাতত তেমন আলোচনা নয়। তার বদলে ছোট ছোট কয়েকটি বিষয়ে নজর রাখব। যা ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ দেখার পর দর্শককে ভাবাতে পারে।

ধারণা হিসেবে ‘বাস্তব’ কী বস্তু? এই সম্পর্কিত পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব অবিরল। দৈনন্দিন যাপনের ভেতর থেকে বলা যায়, বাস্তব হল যার মধ্যে আমি মূর্তমান। যেখানে আমার স্বপ্ন-কল্পনাও নানান দাবি তোলে। অনবরত দেখা- জোড়া দেওয়া চলমান ছবির মতো। স্থির নয়, জীবন্ত। যার ভেতরকার সত্ত্বা অনবরত ঘাঁই মারে। যাকে যাপনের মধ্য দিয়ে হয়তো খানিকটা অনুধাবন করি। কিন্তু ধরতে পারা যায় কি? হয়ত পুরোপুরি নয়, বোঝা যেতে পারে। বা যা কিছু বাস্তব বলা হচ্ছে— তা আসলে দৈবচয়িত। সিনেমা যেহেতু বাস্তবের মতো (নির্বাচিত) ইমেজের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, তাই জীবনের মতো, অনুভূতির মতো অক্ষরের শৃঙ্খলায় তাকে ধরা কঠিন। তাই সে চেষ্টাও নাই। টুকরো উদাহরণ মাত্র।

১২ বছর ধরে থিয়েটারে ‘রক্ত করবী’র নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করছেন রয়া। দলের সিদ্ধান্তে চরিত্রটি ছাড়তে হবে নতুন একজনের কাছে। শেষ শো সমাপ্তিতে রয়া বাসায় ফেরার পথে ফুল বিক্রেতা কিশোরী ডাকে, ‘আন্টি’। গৃহকর্মী ময়নাকে রয়া জিজ্ঞেস করে, ‘আন্টি আন্টি’ লাগছে কি-না। খুব সাধারণ উক্তি। কিন্তু প্রেক্ষাপট মিলিয়ে উজ্জ্বল একটি দৃশ্য বা মানসিক অবস্থা। খুবই রিয়েল, তাই না! আর নন্দিনী প্রসঙ্গে ইমতিয়াজকে রয়া বলে, ‘চরিত্রটি রিয়েল না। বাস্তবে মানুষ এমন হয় না।’

এবার আসা যাক রয়ার মায়ের কাছে। যার কাছে মেয়ের জীবনযাপন বাস্তবসম্মত না। কারণ স্বামীর টাকায় ফুটানি করে বলে বাস্তবতাকে রয়া বুঝে না। যতই পশ্চাৎপদ মনে হোক তিনি নিজ উপার্জনে প্রাণ ধারণ করেন। আর ময়না! রয়া তাকে গৃহকর্মীর মতো করে দেখে না। তার থাকার ব্যবস্থা ভালো, পড়াশোনারও সুযোগ আছে। কিন্তু ময়নার কাছে বাস্তবতা হল, সে কাজের মানুষ! রয়া তার রূপান্তরে ‘বাস্তব’ কারণ হিসেবে যা নির্ণয় করুন না কেন— ময়না তার অভিজ্ঞতার জগতকে বড় করে দেখছে। তার কাছে এটাই বাস্তব। এর ব্যত্যয় ঘটার উপায় নেই। বরং অনুঘটক হিসেবে সে লিফটম্যানের সঙ্গে প্রেম করে হাজির হয় বস্তিতে, কাজ নেয় গার্মেন্টেসে। তাকে দেখে রয়া ভাবে, নন্দিনী হল পোশাক শিল্পের কর্মী। সুন্দরী, উর্বরা কোনো নারী নয়। এই বাস্তবতা কোন বস্তু!

থাকে রয়ার বান্ধবী। স্বল্প কয়েকটি দৃশ্যে। যিনি পিএইচডি থিসিস ক্যানসেল করেন মা হওয়ার জন্য। অথচ স্বামীকে কিছু বাদ দিতে হয় না। বাবা হওয়ার সময় তিনি ছিলেন ল্যাবে। আর এ ‘আদর্শ নারী’ এখন তিন মাসের মধ্যেই শরীরকে আগের শেপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় রত। তিনি আবার বছরব্যাপী ‘রক্ত করবী’ ট্যুর সম্পর্কে রয়াকে উৎসাহ দেন। বাস্তবতা এই বস্তুও!

ব্যাকগ্রাউন্ডে কী আছে? একটা শহর। ঢাকা। প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে। তার আসল পরিণতি কী?— কেউ জানে না। ছোট ছোট দৃশ্যে এ শহরের গড়ে উঠা, মানুষকে জানান দেন রুবাইয়াত। ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ চলমান। মানুষ বা একটি শহর বা ‘রক্তকবরী’ নাটক— সবখানেই দেখি। ‘রক্তকরবী’ লেখা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়ে। তার বিমূর্ত বয়ান অভিজ্ঞতার আরও কাছাকাছি এসে থামে। হয়তো ভবিষ্যতে অন্য রূপ নিয়ে হাজির হবে। বক্তব্য একই থাকছে। পাল্টে যাচ্ছে জীর্ণ বস্ত্রের মতো শরীর। তার আদলটা রয়া খুলে দিচ্ছেন। নতুন পোশাকে। রয়াও নতুন পোশাক পরছেন। ধারণার বিস্তারে এই যে নতুন দশায় প্রবেশ— তা কি রয়ার মাঝে নেই? আছে। মজার বিষয় হল, সিনেমার বয়ানটি এতো বেশি সম্ভাবনাময় ও উন্মুক্ত, সেখানে যে জিনিস নেই তার মূর্ত হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। এভাবে বাস্তবতা অনেক, আবার এক। আর যা ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’, তাই ওই মুহূর্তগুলো মিলিয়ে বাস্তব।

রয়া নিজেকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। হাজির আছে দরকারি ভয়, শঙ্কা। রয়ার মা বা ময়নার ক্ষেত্রে আপদগুলো তেমন নয়। তারা প্রস্তুত। কারণ নিয়তি মেনে নিয়েছেন। রয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন।

এখানে দেখা যায়, ফুলবাড়িয়ার কয়লা খনির সঙ্গে ক্লাসিক নাটককে মিলিয়ে লেখালেখি করেন রয়া। কিন্তু প্রথাগত বয়ান বাদ দেওয়ায় সমালোচনার কারণে সে লেখালেখি বেশি দূর এগুতে পারেনি। তারপরও রয়া নিজের পথ তৈরি করতে চান। ইমতিয়াজ, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও ময়না তার অভিমুখ তৈরিতে কাজে লাগে। সেখানে রয়া নিজেকে আবিষ্কার করেন নতুনভাবে।

সংকটে থাকা নারীর এ জার্নি একা একা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কি! বৃহত্তর পরিসরে হাজির হওয়া আমাদের চাওয়া না চাওয়ার ওপর নির্ভর না। বরং এ সব মিলিয়েই নির্দিষ্ট সময়-পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট চিন্তা হাজির হয়। দৃশ্যমান হয়। আবার রয়া যখন বলেন ‘নন্দিনী রিয়েল না। নিজের জন্য কিছু চায় না এমন মানুষ অবাস্তব’। এর সাপেক্ষেই রয়া নিজেকে আবিষ্কার করেছে। হয়তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার দরকার। এর অভিমুখ নির্ধারণ করা যাচ্ছিল না। নির্ধারণ করতে না পারার মধ্য দিয়েই নির্মিত হচ্ছে গন্তব্য। সত্য হল, এর সবই রয়ার দৃষ্টিতে দেখছি।

rubayet-uc4

সিনেমায় রয়ার আবির্ভাব যেখানটায়, তার আগে রয়া বলে কিছু ছিল কী? তার কথা মতো- ১২ বছর ‘রক্ত করবী’তে অভিনয়, লেখালেখির জার্নি। মা প্রসঙ্গে অন্য নারীর প্রেমে বাবার ঘর ছাড়া জানতে পারি। ময়নার মতে, রয়াকে স্বামী অবহেলা করে নাই। এমন ছিটেফোঁটা প্রমাণাদি ছাড়া রয়া বলে কিছু ছিল কি-না আমরা জানি না। রয়া ও তার স্বামীর নিস্পৃহ বাক্য বিনিময়— অপরিচয়ের দেয়াল তুলে দেয়। তার মানসিক পরিগঠনের বিবরণ মাথায় আসে আবার আসে না। রয়ার নিজেকে চিনে নিতে না পারার বিভ্রম ভর করে আমাদের মাথায়। তাই আচানক নির্মিত হতে থাকা শহরে রয়ার আবির্ভাব। হয়তো অন্য একজন ছিল রয়া নামে, তার পুনর্জীবন লাভ হয়েছে। যেখানে সবকিছু রয়াময়। রয়া ছাড়া কোনো দৃশ্য নাই। যে মুহূর্তে চোখের আড়াল হন, তখন যা ঘটে— আসলে তাও রয়ার চোখে বা চিন্তায় ঘটা যেন! জগৎ সংসারকে রয়ার চোখে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত যেন রুবাইয়াত।

এতো নিশ্চিত ছেড়ে দেওয়া, অনিশ্চিত চরিত্রের হাতে! দৃশ্যকল্প, বাকভঙ্গি ও চিন্তার পরিপক্ক একটা ছাপ এখানে লক্ষ্য করা যায়। প্রতীকি ও অন্তরঙ্গ। রয়া কেন স্বামীকে সাপ ভাবছে আর ইমতিয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হচ্ছে— সহজে ধাক্কা দিতে পারে। ছোট ছোট অভিব্যক্তি বা বাক্যে তা হাজির। তারপরও মনে হতে পারে পুরুষ চরিত্রগুলোকে আরেকটু স্পেস দেওয়া দরকার ছিল।

রয়া কী সামাজিক, নৈতিক বা দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন? ময়নার প্রতি, পোশাক শ্রমিকের প্রতি। মা বা স্বামীর প্রতি। তা জানা যায় না। কেউ জানাতে চায়নি বলেই কী? না-কি সিনেমার অন্য চরিত্রগুলো রয়াকে যেভাবে বুঝতে পারে না। এটা প্রশংসাযোগ্য। কার্য-কারণের ফেরে পড়তে হয় না আমাদের। সিনেমার শেষ দৃশ্যটি জ্য পল সার্ত্রের দায়িত্ব সম্পর্কিত ডিলেমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সার্ত্রের কাছে উদাহরণটি ছিল, অসুস্থ মায়ের সেবা অথবা দেশের জন্য যুদ্ধ। আর রয়ার ক্ষেত্রে তা অসুস্থ মায়ের সেবা অথবা নিজের ক্যারিয়ার। সেখানে সার্ত্রে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। তবে দুটোই সঠিক। আর এখানে রয়া তার শিল্প সত্ত্বাকে বেছে নিয়েছে।

হয়ত ‌‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’র পর দর্শকের জন্য গুরুতর ভাবনা হবে রয়ার সত্ত্বাকে ধরতে চাওয়া। এমন চরিত্র নিশ্চয় এ কালে বিরল নয়। যার সমান্তরালে ভাঙা-গড়ার একটা নগরকে ধরা যায়। তার অর্থহীনতা, অর্থপূর্ণতা, বিপন্নতা ও বিপন্নতার নির্বাসন সেলুলয়েডে ধরা পড়েছে সুনির্মাণে। যার প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি চরিত্রের নিঃশ্বাস, যেমন বৃষ্টি, শহরটা কেমন হবে সবই নির্মাতার পরিকল্পনা মতো— দর্শকের বাড়তি কল্পনার সুযোগ নেই। তারা চাইলেও আড়াল থেকে কোনো দৃশ্য বা চরিত্রকে আলাদা করে বেছে নিতে পারে না। কিছুটা শ্বাসরুদ্ধকর সুনির্মাণ বলা যায়্। এটা হয়ত বাগান, কিন্তু কেউ চাইতে পারে বন।

শেষদিকে একটি কথা বলা যায়। বাংলাদেশে প্রথাগত ‌‘ভালো সিনেমা’, ‘ভালো সাহিত্য’ সম্পর্কিত কিছু ট্যাবু আছে। যা প্রধানত মুক্তিযুদ্ধ বা গ্রাম সম্পর্কিত চর্বিত চর্বন। অথবা পুরনো বয়ানের নতুন অভিমুখহীন পুনরুৎপাদন। রুবাইয়াত তার বাইরে কিছু করেছেন দ্বিতীয় সিনেমায়। যা আমাদের যাপনের কাছাকাছি। এটা স্বস্তির। রুবাইয়াত নিশ্চয় যুগপৎ প্রশংসা বা নিন্দার ভাগিদার হবেন। আশা করা যায়, তা সয়েই তিনি এগিয়ে যাবেন।

প্রথম প্রকাশ : পরিবর্তন ডটকম


Leave a reply