Select Page

আমাদের ছবিতে ছাত্র আন্দোলন

আমাদের ছবিতে ছাত্র আন্দোলন

ভারতীয় উপমহাদেশে পাল্টে যাওয়া রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে একসময়ের গৌরবমাখা শিক্ষা ব্যবস্থায় আস্তে আস্তে পচন ধরা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এ ছবিগুলোকে ক্যাম্পাস পলিটিক্স/স্টুডেন্ট পলিটিক্স বলা হয়।

বলিউড, টলিউড, ঢালিউড তিন ইন্ডাস্ট্রিতেই এ ধরনের ছবি নির্মিত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নির্মিত ছবিতে ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসনিক সমস্যা, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, সাধারণ ছাত্রের বিপ্লবী হয়ে ওঠা নিয়ে গল্প থাকে। ছবির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলে সচেতনতা তৈরি করাই নির্মাতাদের লক্ষ্য থাকে।

আমাদের ঢালিউডেও দূষিত ছাত্র রাজনীতির বলি হওয়া প্রেক্ষাপট নিয়ে ন্যায়ের শক্তিতে অন্যায়কে প্রতিহত করার ছাত্র আন্দোলনে বিপ্লবী গল্পে বেশকিছু ছবি নির্মিত হয়েছে। জানা যাক সেসব ছবির গল্প—

যন্ত্রণা (১৯৮৮) : কাজী হায়াৎ পরিচালিত আশির দশকে নির্মিত বাস্তবসম্মত অসাধারণ গল্পের ছবি। মান্না, দিলদার ও আরো দুজন অখ্যাত নায়ক নিয়ে ছবিটি নির্মিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর বিভিন্ন সেক্টরে চাকরির জন্য গেলে চারজনই বিভিন্নভাবে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত সব সেক্টরকে দেখে বেকার চারবন্ধু সিদ্ধান্ত নেয় চাকরির বদলে চাঁদাবাজি, মাস্তানি করবে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, চামচাদের শাস্তি দিতে থাকে তারা। এভাবে আরো অনেক অপরাধের সাথে তারা জড়িয়ে যায়। একসময় দেশদ্রোহিতার জেরে পড়ে যায় তারা। ফাঁসির আদেশ হয় তাদের। ছবির শেষ সংলাপ ছিল-’তবুও যন্ত্রণার শেষ হলো কি?’ অসাধারণ ছিল নির্মাণ।

চেতনা (১৯৯০) : ছটকু আহমেদ পরিচালিত ছবি। নব্বই দশকে বাণিজ্যিক ছবির রমরমা যে জোয়ার শুরু হয়েছিল তার মধ্যে এ ছবিটি ছিল অনুপ্রাণিত করার মতো। শিক্ষক আলমগীরকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে তার ছাত্ররা। ছাত্রদের মধ্যে ছিল অমিত হাসান, মিশা সওদাগর ও অন্যান্যরা। মিশাও নায়ক ছিল এ ছবিতে। একসময় আলমগীর খুন হয় এটিএম শামসুজ্জামানের হাতে। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুর খবর শুনে এটিএমের আধিপত্যের এলাকাকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে আসে অমিত, মিশা-রা। শুরু হয় অসাধারণ লড়াই। শিক্ষকের শেখানো শিক্ষা ধারণ করে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করা ছাত্রদের নিয়ে ছবিটি দেখিয়ে দেয় জাতির ভবিষ্যৎদের করণীয় কি।

ত্রাস (১৯৯২) : কাজী হায়াৎ পরিচালিত ছবি। মান্নার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অন্যতম প্রধান ছবি। কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটানো বখাটে ছাত্রদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। কবিতাকে অসম্মান করার সময় ভরা মাঠে মান্না শায়েস্তা করে কাবিলাকে। এর থেকে শুরু হয় একের পর এক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। ‘একতা শান্তি শৃঙ্খলা’ গানের চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইলেও সে পরিবেশ থাকে না। দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎ নেতা রাজিব, মিজু আহমেদ-দের বিরুদ্ধে মান্না-র অভিযান শুরু হয় এবং তাকে বরণ করে নিতে হয় ছাত্র রাজনীতির করুণ বাস্তবতা।

বিক্ষোভ (১৯৯৪) : মহম্মদ হান্নান পরিচালিত ছবি। ছাত্র রাজনীতির টোটালিটি তুলে ধরা নব্বই দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। কিভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু হয়, কিভাবে আধিপত্য তৈরি হয়, কিভাবে অসৎ নেতারা কলেজ ক্যাম্পাসে নিজেদের ক্যাডারদের পোষে, কিভাবে সাধারণ ছাত্ররা অসৎ নেতাদের টার্গেটে পরিণত হয়, কিভাবে সাধারণ ছাত্র বিপ্লবী হয়ে ওঠে সমস্ত বিষয়গুলো গোড়া থেকে তুলে আনা হয়েছে। অমর নায়ক সালমান শাহ-র উল্লেখযোগ্য ছবি। সালমান-শাবনূরের ‘একাত্তরের মা জননী’ ও ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়’ শুধুমাত্র এ ছবির জন্যই নয় বরং পুরো ঢালিউডের অন্যতম সেরা বিপ্লবী গান।

আজকের প্রতিবাদ (১৯৯৪) : চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ছবি। শিক্ষিঙ্গনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রের প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে নির্মিত অসাধারণ ছবি। তখনকার নবাগত দোদুল-লাজুক জুটিকে নিয়ে ছবিটি নির্মিত। ছবির মধ্যে শক্ত কিছু সংলাপ আছে।

হুলিয়া (১৯৯৫) : জীবন রহমান পরিচালিত ছবি। ওমর সানী কলেজের বোকা ছাত্র। অনেককিছু বোঝে না। আদর্শবান শিক্ষক প্রবীর মিত্রকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানোর পর তার আত্মীয় সানীর উপর অত্যাচার নেমে আসে। সানীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে শাহনাজ। ঘটনা বাড়তে থাকে রাজনীতির মারপ্যাঁচে। একসময় বোকা সানী বাস্তবতার চাপে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।

ঘায়েল (১৯৯৫) : নূর হোসেন বলাই পরিচালিত ছবি। বাস্তবসম্মত গল্প। রাজিবের ছেলে ওমর সানী কলেজে রাজনীতির সাথে যুক্ত। সততার পরিণাম কি হয় তার শিকার বাবা ছেলে দুজনই হতে থাকে। বন্ধুর সাথে চটপটি খেতে বসা সানী কলেজ ক্যাডারদের আক্রমণে বন্ধুকে হারায়। বন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে সানীর নতুন মিশন শুরু হয় এবং মাঝপথে রাজিব নিজেও পড়ে যায় আইনি দুর্নীতির ভেতরে। বাবা ছেলে একই পথে ঘায়েল করতে থাকে শত্রুদের।

মুক্তির সংগ্রাম (১৯৯৫) : উত্তম আকাশ পরিচালিত ছবি। ওমর সানী সাধারণ ছাত্র থেকে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে রাজনৈতিক বাস্তবতায় পড়ে। পরিবার, বন্ধু, প্রেমিকা সবাই রাজনীতির শিকার হতে থাকে। ক্যাম্পাসের ক্যাডারদের মধ্যে থেকে শুরু হয় রেষারেষি। তারপর প্রতিবাদ। অসৎ সাদেক বাচ্চুর চক্রকে শেষ করতে থাকে।

প্রিয় তুমি (১৯৯৫) : হাফিজ উদ্দিন পরিচালিত ছবি। ছাত্র আন্দোলন খুব বেশি এ ছবিতে না থাকলেও কিছুটা ছিল গল্পে। কলেজ ক্যাম্পাসে নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি এবং সৎ ছাত্র ওমর সানীর জয়ের বিষয়টা এ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘জিতে গেছি জিতে গেছি ইলেকশন’ গানটি ছবিতে সৎ ছাত্রের নেতৃত্ব দেবার বিজয়। মৌসুমী ছিল সানীর সহযোদ্ধা।

পাগলা বাবুল (১৯৯৭) : কাজী হায়াৎ পরিচালিত ছবি। মাসুদ শেখ কলেজের নিরীহ ছাত্র। পরিস্থিতির চাপে তাকে পড়তে হয় নোংরা ছাত্র রাজনীতিতে। তাকে দিয়ে বোমা মারার কাজ করানো হয়। একসময় অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে গিয়ে তার স্বাভাবিক জীবন পাল্টে যায়। সাধারণ ছাত্র রাজনীতির দুষ্টচক্র বুঝে দমন করতে থাকে এর শত্রুদের। ছবির নির্মাণ অনবদ্য।

অধিকার চাই (১৯৯৮) : ওয়াকিল আহমেদ পরিচালিত ছবি। এ ছবিতেও ওমর সানী সাধারণ এবং বোকা টাইপের ছাত্র। ক্লাসে মনোযোগী। বন্ধুত্ব ও প্রেম হয় শাবনূরের সাথে। কলেজের বখাটে মিশা সওদাগর সানীর বাবা বুলবুল আহমেদ ও শাবনূরের বোনকে হত্যা করে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থে। সানী প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কলেজ ক্যাম্পাসে মিশাকে হত্যা করে। এরপর হুমায়ুন ফরীদির আধিপত্যের শিকার হয় দুজনই। সানী ও শাবনূর লড়তে থাকে সাধারণ ছাত্রের অধিকারের জন্য।

বিপ্লবী জনতা (২০০১) : হাফিজ উদ্দিন পরিচালিত ছবি। অসাধারণ ছবি। এ ছবিতেও ছাত্র রাজনীতির টোটালিটি তুলে ধরা হয়েছে। হুমায়ুন ফরীদি ও রাজিবের নেতৃত্বে কলেজ ক্যাম্পাসে ফেরদৌস সাধারণ ছাত্রদের বিরক্ত করে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে। একসময় শিক্ষক সোহেল রানার মাধ্যমে কলেজে পরিবর্তন আসে। পূর্ণিমাকে মিশার হাত থেকে বাঁচানো এবং মাকে হারাবার পর ফেরদৌস সঠিক পথে ফিরে আসে। তারপর নিজেই নোংরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নোংরা ছাত্র রাজনীতির শিকার হওয়া ছাত্রের সঠিক পথে ফিরে আসা।

ইতিহাস (২০০২) : কাজী হায়াৎ পরিচালিত ছবি। কালজয়ী। সাধারণ ছাত্র কাজী মারুফ পরিস্থিতির শিকার হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎ পুলিশের হাতে পড়ে স্বাভাবিক জীবন হারায়। সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে নিজেই দমন করতে থাকে সমস্ত অসৎ লোকদের। বাস্তবসম্মত নির্মাণ।

সাহসী মানুষ চাই (২০০৩) : মহম্মদ হান্নান পরিচালিত ছবি। শাকিব খানের ক্যারিয়ারের প্রথমদিকের মানসম্মত ছবি। ক্যাম্পাস পলিটিক্সে সাধারণ ছাত্রদের উপর রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ছাত্রদের অত্যাচার, শিক্ষকের প্রতি অন্যায় এসবের বিরুদ্ধে একসময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে সাধারণ ছাত্র শাকিব খান। প্রতিশোধপর্ব চলে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

আজকের সমাজ (২০০৪) : নজরুল ইসলাম খান পরিচালিত বাস্তবসম্মত ছবি। কাজী হায়াতের গল্পে নির্মিত। শাকিব খানের প্রথমদিকের আরেকটি ভালো ছবি। সাধারণ ছাত্র শাকিব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে হলে সিট পাওয়া নিয়ে রাজনীতির চক্রে পড়ে। ছাত্রনেতার রুমে থাকে। সরকারি দলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে জড়ানোর সময় শাকিব সব সত্য বলে দিতে চাইলে তাকে ক্ষুর মা া হয়। এরপর আরেক গ্রুপের হাতে তাকে পড়তে হয়। পূর্ণিমাকে ঘিরে ছাত্রনেতার অসৎ উদ্দেশের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শাকিব হয়ে ওঠে ছাত্রনেতা ও অসৎ নেতার টার্গেট। শাকিব হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। গল্পে অনেক টাচি বিষয় উঠে আসে।

আমি বাঁচতে চাই (২০০৭) : নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত ছবি। বাস্তবসম্মত গল্প। মফস্বল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ছাত্রনেতাদের বেপরোয়া কর্মকান্ড দেখে সম্রাট। মদ এনে না দেয়াতে হলে এক সাধারণ ছাত্রকে মারধর করে তারা। ঘটনাচক্রে পড়ে বোমা হামলার অভিযোগে সম্রাটকে পুলিশ নির্যাতন করে। সম্রাট একসময় রাজনীতির প্রতি ঘৃণা নিয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে কিন্তু রাজনীতি তাকে ছাড়ে না। সাধারণ ছাত্র সম্রাট লোকাল পলিটিক্সের বিরুদ্ধে বিপ্লবী হয়ে ওঠে। ক্যাম্পাস থেকে লোকাল পলিটিক্সে মিশে দুই ধরনের বাস্তবতায় ছবিটি অসাধারণ হয়ে ওঠে।

অস্ত্র ছাড়ো কলম ধরো (২০১১) : রাজু চৌধুরী পরিচালিত ছবি। কাজী মারুফ কলেজের স্টুডেন্ট পলিটিক্সে অসৎ ছাত্রনেতাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। অসৎ নেতা মিশা সওদাগরের চোখ খুলে দেয় তারই তৈরি করা ফাঁদের থেকে বাঁচিয়ে। পূর্ণিমা মারুফকে ভুল বোঝে মারামারি করার কারণে তবে পরে ভুল ভাঙে মারুফের প্রতিবাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানার পরে। সাধারণ ছাত্র কখন সাহসী হয়ে ওঠে ছবিটি দেখায়।

ছবিগুলো বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে। গল্প এবং আবেদন একই। ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক বিষয়। ছবিগুলো আমাদেরকে চোখের সামনে পাল্টে যাওয়া শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বাস্তবতা তুলে ধরে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়। আজকের দিনে ঢালিউডে এ ধরনের ছবি নির্মাণ হতে দেখা যায় না। এমনকি বাস্তবতা এমন পর্যায়ে গেছে যে এ ধরনের ছবি নির্মিত হলে সেন্সর পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।


Leave a reply