Select Page

আমাদের সিনেমা: বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী (পর্ব – ১)

Shabana in vaat de film by amzad hossainগোড়ার কথা:

আমাদের সিনেমা নিয়ে এখনো যাদের ফ্যাশনেবল ধারণা আছে। যেমন ধরুন- আমাদের সিনেমা বোরিং বা আমাদের সিনেমার ইন্টেরিয়র, এক্সটেরিয়র ডিজাইন ভালো হয় না, একইরকম সেট থাকে, একই বাড়িতে স্যুট হয় অনেক সিনেমার, বৈচিত্র্য থাকে না, দেখা যায় না বা ধারণ করা যায় না ইত্যাদি। হ্যাঁ, এগুলোর অনেককিছুই একই থাকে কিন্তু অনেককিছুর পরেও একটা জিনিস থেকে যায় আর তা হল ‘ন্যাচারালিটি’। ‘ন্যাচারালিটি’ শুধু আমাদের নয় বিশ্বের সব দেশের সিনেমার জন্যই সত্য যেটি ছিল গত শতাব্দীর ঘটনা। এটা কোনো একক বিষয নয় নানাভাবে ন্যাচারালিটি আসতে পারে। বিশ্বের অন্য সব সিনেমার মত আমাদেরও সিনেমায় ছিল ন্যাচারালিটি। আমাদের ‘মুখ ও মুখোশ’ থেকে শুরু করে সত্তর বা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বা পরবর্তী থেকে আশি, নব্বই পর্যন্ত ন্যাচারালিটি ছিল। নব্বইয়ের শেষের দিকে ছন্দপতন দেখা দিলেও দুহাজার পরবর্তী সময়ে আবারো একটা ভালো সময় ছিল। এখন যা আছে তা হল একটা বড় শূন্যতার পরে গড়ে নেবার সময় তাই এ সময়টাকে বিশ্লেষণ করতে আরো সময় দরকার। বলা ভালো আমাদের পরের প্রজন্ম এ সময়টা সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে। ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। তো আগের যে সময়টা সম্পর্কে বলছি সেসময়টা আমাদের গর্বের সময় আর বিশ্বের সব সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেই গর্ব করার মত একটা ইতিহাস থাকে। আমাদেরও আছে, সেসব সিনেমা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ভালো ভালো ধারণাগুলোকে বিনি সুতোর মালার মত করে গেঁথে সেইসব তথাকথিত আধুনিক ফ্যাশনেবল ধারণাকে বদলাতেই এই আয়োজন – জানি এ কাজটা একার কাজ না তবে অনেকের কাজটা মাঝে মাঝে একা করলে অনেকে সাহস পায়। হয়তো এর মাধ্যমে আরো কেউ কলমটা ধরবে। আর মনে রাখতে হবে সেই কথাটা যে আমাদের সিনেমা মূলত আমাদেরই সিনেমা যেখানে অন্য কোনো দেশের অধিকার নেই। অবশ্যই তাকে আলাদা করতে জানতে হবে। আপনার দেশের সিনেমা নিয়ে আপনার গর্বটা থাকবে ঠিক সেভাবে যেখানে আপনার গর্বের জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। থেমে গেলে চলবে না। বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী দেয়া যাবে না কারণ যুদ্ধ করার মত সমস্ত কিছুই আপনার দেশের সিনেমা আপনাকে দিয়েছে।

আজকের বিষয়: ‘ন্যাচারালিটি’

ইংরেজি `nature’ শব্দকে বাংলায় বলে ‘প্রকৃতি’। এর গঠনটা হয় ‘প্রকৃত+ই=প্রকৃতি’। তার মানে যা ‘প্রকৃত’ তাই ‘প্রকৃতি’। প্রকৃত জিনিসকে ধারণ করে বলেই তা ‘প্রকৃতি’। আপনি যখন নাগরিক ব্যস্ততা ছেড়ে দূরে কোথাও আলো-মাটি-হাওয়া-নদীভরা খোলা কোনো জায়গাকে খুঁজে নেন তখন আপনার লক্ষ্যটি থাকে মন ভরে কিছুদিন নিজের মত করে সময়টা কাটানো যাতে একটা মানসিক শান্তি বা স্বস্তি আসে। সে শান্তি বা স্বস্তিটি আপনি পাবেন প্রকৃতির কাছ থেকে। প্রকৃতিকে আবার ‘স্বভাব’ও বলা হয়। আপনি যখন দেখবেন আপনারই আশেপাশে খুব শান্ত ছেলেটাও আছে আবার খুব চঞ্চল ছেলেটাও আছে। খুব ভদ্র মেয়েটাও আছে আবার কুব উচ্ছৃঙ্খল মেয়েটাও আছে এদের সবারই একটা স্বভাবকে আপনি আমি দিনের পর দিন দেখার পরে অভ্যস্ততা তৈরি করি এবং আমাদের মনের মধ্যে সেই ছেলে বা মেয়েগুলোকে নিয়ে এক একটা ধারণা আসে যে কে কী রকম। এভাবে তাদের আচরণগুলো আমাদের কাছে সহজ, স্বাভাবিক লাগে। সেই ‘স্বভাব’ থেকে ‘স্বভাবিক’ এর যাত্রা। এভাবে আমরা কিছু অনুভূতিকেও আমাদের ‘স্বভাব’ ভাবি। কোন কথাটা কোন সময় বলা দরকার বা বলা উচিত নয় এসব আমাদের নখদর্পণে আসে। শিশুকে যেভাবে দেখে আনন্দ পাই ডাকাত বা খুনীকে দেখে তা পাই না, ভয় পাই। এভাবেই স্বভাবগুলো আরো পরিচিত বাস্তব লাগে আর তাই `nature’গুলো হয়ে যায় `naturality’। চোখের সামনে যা ঘটে তাকে আমরা বাস্তব ভাবি আবার কল্পনায় যা ঘটে তাকে বাস্তবের সাথে মিলিয়ে নিতে ভালোবাসি – এভাবেই চলছে।

অনেক সিনেমার নামই বলা যাবে, থাক অত বলে কাজ নেই, আপাতত ‘ভাত দে’ দিয়েই এ উদাহরণটা দেয়া যাক। শাবানার চুল কেটে দেবার যে সিকোয়েন্সটি আছে এ সিকোয়েন্সটি আপনাকে কাঁদাবে। ধরলাম আপনি খুব শক্ত লোক, আপনার চোখে সহজে জল আসে না কিন্তু আপনার মনে যে জলের ধারা বয় সেটা অবশ্যই সত্য। ক্ষুধায় কাতরানো শাবানা যখন চুরি করে ভাত খেতে যায় দুর্ভিক্ষের সময় ভাতের হাহাকারে চুরিটা তখন স্বাভাবিক হয়ে যায় (‘ন্যাচার’ অর্থে)। শাবানার এই চুরির দায়ে যখন তার মাথার চুল কাটা হচ্ছে শাবানা চিৎকার করছে ঘামভরা চোখেমুখে। তার এক একটা করুণ এক্সপ্রেশন আপনার মধ্যে যে বেদনাটা জাগাচ্ছে সেটা থেকেই আপনার মধ্যে কান্নাটা চলে আসে। বেদনা পেয়ে আমরা হয় কাঁদি নয়তো কষ্টটা বুকে চেপে রাখি এ দুটোর বাইরে আর কিছুই করার নেই। তখন শাবানার অভিনয় দেখে আপনার জীবন্ত মনে হচ্ছে আর আপনি ভাবছেন যেন এটা সাক্ষাৎ দেখতে পাচ্ছেন যাকে বললাম চোখের সামনে দেখা। এটাই (‘ন্যাচারালিটি’)। আপনি যখন দর্শক হয়ে কাঁদছেন তখন আপনিও আপনার স্বাভাবিক অনুভূতি থেকে কাঁদছেন এবং ওটা আপনার স্বভাব বা প্রকৃতি, তখন আপনিও ঐ ন্যাচারালিটির একজন সদস্য হয়ে গেলেন। শাবানার অভিনয় এবং পরিচালক আমজাদ হোসেন ‘ভাত দে’ সিনেমায় আপনাকে একজন দর্শক হিশেবে তাদের প্রাপ্যটা আদায় করে নিল আর আপনিও পেলেন আপনার পাওনাটা।

বি:দ্র:
আমি ‘আমাদের সিনেমা’ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি কারণ কলকাতাতেও বাংলা সিনেমা নির্মাণ হয়..তাদেরও নিজস্ব ইতিহাস ও গর্বের জায়গা আছে। তাই তাদের থেকে আমাদের পার্থক্য ও নিজস্বতাকে চিনতে, জানতে, চর্চা করতে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ‘আমাদের সিনেমা’ বলাটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরি মনে হয়।


Leave a reply