আমার জিরো ডিগ্রি দর্শন
কাহিনী সংক্ষেপ- ভালোবাসায় প্রতারিত দুইজন মানুষের( জয়া আহসান ও মাহফুজ আহমেদ) প্রতিশোধ গ্রহণের কাহিনী। (বেশি সংক্ষেপে বলে ফেললাম? কেন বলব না? লিখেই তো রাখসি- কাহিনী “সংক্ষেপ” :P)
ভাল দিকের কথা বলি শুরুতে। বাংলাদেশে “সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার” জিনিসটা কয়টা হইসে এটা কাওকে জিজ্ঞেস করলে সে হা করে আধা ঘণ্টা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায় থাকবে। নব্বই দশকে শহিদুল ইসলাম খোকন হুমায়ূন ফরিদিকে নিয়ে “বিশ্বপ্রেমিক” নামে একটা বানিয়েছিলেন, যেখানে ফরিদি মেয়েদের মেরে তাদের গলার তিল কেটে সেই তিলের মালা বানাতেন! (ah, good old days!) জিরো ডিগ্রীর গল্প ভাল, এফডিসির বস্তাপচা আর নকল গল্পের ভিড়ে এই গল্প অনেক আরাম দেয়, চোখের আর মনের দুইটাই। ক্যামেরার দারুণ কাজ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল প্রথম দিক থেকেই মনোযোগ আকর্ষণ করে। ব্যাকগ্রাইন্ড মিউজিক থেকে শুরু করে টেকনিক্যাল সবকিছুতেই ছবিটিকে বেশ সমৃদ্ধ বলা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ মনে হয় অভিনয়ে- জয়া আর মাহফুজ নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। নিজের ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় বসে থাকা হতবিহবল মাহফুজের এক্সপ্রেশন যেন হলের দর্শকদেরও চুপ হয়ে যেতে বাধ্য করে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন মনে হয় জয়া- একই সাথে রূপের ঝলক আর দুর্দান্ত অভিনয়, গুরুজির বাসায় ঢাকের তালে জয়ার নাচ, নানচাকু হাতে নিয়ে তার এক্সপ্রেশন, শেষের দিকে মাহফুজের সাথে সাইকো হাসি হাসার এক্সপ্রেশন- প্রসংসা যত করব কম হয়ে যায়। ছোটখাটো চরিত্রের সবাই ভাল। তবে অবাক করেছেন রুহি- পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন জয়া আর মাহফুজের সাথে। গান ভাল সিনেমার,অনেকদিন পরে গুরু জেমসের গান শুনে কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ছবির সবচেয়ে অবাক করা দিক হল দৃশ্যের সাথে সাদৃশ্য রেখে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার- এই জিনিসটায় সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি। অনিমেষ আইচের পরিচালনা বেশ ভাল।
তারিক আনাম খান আর ইরেশ জাকের কে পুরাই “অযথা” মনে হয়েছে সিনেমাতে, তাদেরকে সেভাবে ব্যবহার করা হয়নি। সিনেমার গান ভাল হলেও সেগুলোর ব্যপ্তি ৪৫ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের মত- জেমসের গান এক মিনিট শুনে কি আত্মা ভরে? সিনেমার দুর্বল দিকের কথা বললে মেজর পয়েন্ট হল এর দ্বিতীয়ভাগ, প্রথমভাগ দারুণ আগালেও দ্বিতীয়ভাগে সিনেমা গতি হারায়। গল্প আরও গভীর হওয়া উচিত ছিল দ্বিতীয়ভাগে, তারপরেও উপভোগ্য। রাফ অ্যান্ড টাফ মাহফুজের সাথে তার পেটের ভুঁড়িটা বেশ বেখাপ্পা লাগে। ছোটখাটো কিছু লুপহোল আছে।
সিনেমাতে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন জীবনের বেশিরভাগ সময় মানুষকে হাসিয়ে আসা অভিনেতা, যাকে অনেকে “ভাঁড়” বলেন, সেই টেলিসামাদ- অবাক করা ব্যাপার হল মাত্র কয়েক মিনিটের অভিনয় করা চরিত্রে তিনি দারুণ সফল। যদিও খারাপ লেগেছে এটা দেখে যে তার ভয়েস ডাবিং করেছেন আরেকজন। এটা করার কারণ আছে, কারণটা বেশ কষ্টের- গুণী এই অভিনেতার বাম পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়েছে, ডাক্তার তার পায়ের দুটি আঙ্গুল কেটে ফেলেছেন, বর্তমানে নিজের বাসায় আছেন তিনি। তার ছেলের সাথে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়েছিল আমার, তার কাছ থেকেই সব জানলাম। আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার নাই।
সিনেমাতে নারী আর পুরুষ- দুইজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অপর লিঙ্গের খারাপ দিকগুলো দেখানো হয়েছে, ভ্যালেন্টাইনস ডের আগে এই ধরনের কিছু দেখানোর পিছনে কি পরিচালকের গোপন কোন উদ্দেশ্য আছে? জাতি জানতে চায় 😉 কাপলরা সিনেমাটি দেখে আবার ঝগড়া লাগায় দিয়েন না নিজেদের মাঝে 😛
জিরো ডিগ্রি আরও দুর্দান্ত হতে পারত, সেটা না হলেও দারুণ একটা থ্রিলার হয়েছে। শুধু জয়া-মাহফুজের অভিনয়ের জন্য সিনেমাটি মাস্ট সি। এই সিনেমার জন্য মাহফুজ দুই বছর ক্যামেরার সামনে আসেন নি। একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিকুয়েন্স করতে গিয়ে জয়া আহসান আহত হয়ে বেশ কিছু সময় হাসপাতালে ছিলেন- তাদের এই কষ্ট সার্থক হবে যদি আমরা হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখি। অবশ্য হলে যাওয়ার কথা আর কি বলব- যেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এত খারাপ- সেই দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে আগাবে? সিনেমা নিয়ে এত চিন্তার সময় কার আছে, যেখানে জীবন “পেট্রোলবোমার” কাছে জিম্মি!