আলফা : শিল্পের বাস্তবতা
শিল্পচর্চা করবেন অথচ তার বাস্তবতা ভোগ করবেন না তা কি হয়! শিল্প থেকে শিল্প তৈরি হয়, এক শিল্প যায় আরেক শিল্প আসে। জায়গা বদল হয়। জায়গা বদলের মাধ্যমে নতুন-পুরাতনে বাঁধে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের ফলে একদিকে বিশ্বায়নের সাথে পুরাতন ঐতিহ্য বিপরীতে অবস্থান নেয় আরেকদিকে মানবিকতার সাথে বাঁধে যান্ত্রিকতার গোলযোগ। এই চেতনা নিয়েই ছবি ‘আলফা।’
নাসির উদ্দিন ইউসুফ দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত নাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর দুই দুইটি মাস্টওয়াচ ছবি আছে ‘একাত্তরের যীশু, গেরিলা’ নামে। নতুন ছবি ‘আলফা’-কে (২০১৯) তিনি বলেছেন তাঁর ফুটপ্রিন্ট। নিরীক্ষাধর্মী ছবি যেখানে শিল্প ভেঙে শিল্প গড়েছেন আর মানবতার জন্য হাহাকার করেছেন। অসাধারণ ছবি। গ্রিক বর্ণমালার প্রথম অক্ষর ‘আলফা’ থেকে ছবির নাম রাখা হয়েছে ‘আলফা।’ এদিক থেকে ইতিহাস ও মিথের সম্পর্ক রেখেছে।
একটা সময় ছিল যখন রিকশা পেইন্টিং চলচ্চিত্রের একটা অনবদ্য শিল্প ছিল। প্রযোজকদের লাইন পড়ে যেত মুভি পেইন্টারদের কাছে। তারা রিকশার পেছনে নায়ক-নায়িকার ফেস এঁকে ছবির প্রচারণা চালাত। সেই শিল্পের এখন বিদায় ঘটেছে বলা যায়। বিশ্বায়নে এগিয়ে চলা নাগরিক জীবনে গাধার পিঠে বাক্স নিয়ে হাঁটছে এক পেইন্টার। দেখতে কেমন লাগে তাকে আধুনিকদের মাঝে। হুট করে গাড়ি থেকে মাথা উঁকিয়ে একজন বলে-‘ঐ ব্যাটা গাধার বাচ্চা সর এখান থেকে।’ পেইন্টিং দিতে গেলে মালিক বলে-‘সিনেমার বিলবোর্ডের খবর কি কিছু পাইতাছেন আইজক্যাল নাকি ডিজিটালে সব খায়া ফালাইছে!’ সংলাপটি করুণ বাস্তবতাকে তুলে ধরে। বিশ্বায়নের সাথে সেই পেইন্টার যাকে ‘আর্টিস্ট’ বলে লোকে তার একটা দ্বন্দ্ব বাঁধে মানসিকভাবে। এই দ্বন্দ্ব থেকে ছবি এগিয়ে যায়।
আধুনিকতার উপাদান যেমন – বিলবোর্ড, গাড়ি, আলোকসজ্জা এসবের দিকে তাকিয়ে থাকে আলফা চরিত্রটি। বিলবোর্ড লাগানো লোকটি আলফার দিকে তাকিয়ে থু থু ছিটায়। আলফা বোঝার চেষ্টা করে কী ঘটছে নগর জীবনে। সে কতটুকু পিছিয়ে আছে নির্ণয়ের চেষ্টা করে। বাউল গানের আসরে তাকে পাওয়া যায় না। সময়ের অজুহাত দিলে বাউল বলে-‘সময়রে এত ডরাইলে হবে না, সময়ের ঘাড়ে চড়ে বসতে হবে।’ একটা দোলাচলের মধ্য দিয়ে ‘আলফা’-র অস্তিত্ব চলে। তার পানির উপর ভাসমান বাড়িতে থাকা তাই সমাজে তার ভাসমান অবস্থান তুলে ধরে আধুনিকতা ও পুরাতনের দ্বন্দ্বে।
বিবর্তনের প্রভাব মানুষের জীবনে খুবই কঠিন সত্য। ছবিতে আলফাকে বিবর্তনের ধারায় দেখানো হয়েছে। সে নিজে পরিবর্তন না হলেও বিবর্তন দেখে গেছে সাথে ভেবেছেও। ‘মোজার্ট’ সঙ্গীতের সাথে আমাদের বাউল গানের তফাত সে পায়, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ভেসে আসে ‘কি জাদু করেছ বলো না’ গান। এগুলো সময়ের চাহিদায় ঘটে। অপেরার ধ্বনিতে আলফা নিজেও চলে যায় ফ্যান্টাসির জগতে। শিল্পীর মনকে বড় করে দেখানো হয়েছে।
নিরীক্ষার জায়গায় পরিচালক সুররিয়ালিজম বা পরাবস্তবতার সাথে বাস্তবতার তফাত তুলে ধরেছেন। অবচেতন মনের যে জায়গাটিতে সুররিয়ালিজমের বাস সেখানে আলফাকে তার রঙের জগতে একটা আপন পৃথিবী গড়তে দেখা গেছে। কল্পনার সে জগতের সাথে বাস্তবতার অনেক বড় তফাত। তাই বাস্তবে যখন সে গার্মেন্টস কোম্পানিতে আগুনে পুড়ে মানুষ মরতে দেখে সেই রঙকেই উপাদান বানায় প্রতিবাদের। শিল্পের প্রতিবাদ চলে রং দিয়ে। অভিনব ছিল এ আইডিয়াটি।
ছবির গল্পের মধ্যেও ছিল আরেকটি গল্প। এ গল্পে আলফা মানুষের জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটা মানবিক পরিচয় তুলে ধরে। পরিচালক তাকে মানবিক করে তোলেন। শিল্পীমাত্রেই যে মনটা বড় করতে হয় ছবির গল্পের ভেতরের গল্পে দেখানো হয়েছে। এটা আকর্ষণ ছবির।
ছবিতে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো আলফার অতীত মিনিংফুল ছিল। অরণ্যে হাঁটার সময় স্পেশাল অ্যাফেক্টে আলফাকে নিরীক্ষা করার শটগুলো জাস্ট অসাধারণ। এথনিক ভাষা, লুলাবি সঙ্গীতের ব্যবহার হয়েছে প্রসঙ্গক্রমে। হিজড়া সম্প্রদায়কে ছবিতে যে দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন পরিচালক নিঃসন্দেহে সাধুবাদের যোগ্য।
‘আলফা’ চরিত্রে আলমগীর কবির জাত অভিনেতার পরিচয় দিয়েছে। তার কম সংলাপ কিন্তু এক্সপ্রেশন ও সাইলেন্ট অ্যাকটিং অসাধারণ। চরিত্রটির জন্য পারফেক্ট চয়েজ ছিল ব্যক্তিত্বের দিক থেকে। দিলরুবা দোয়েল প্রধান নারী চরিত্রে মিশে গিয়েছে বস্তির জীবনের সাথে। ইমরান নামের ছেলেটি হিজড়ার অভিনয়ে প্রশংসনীয়। এটিএম শামসুজ্জামানকে অনেকদিন পরে খুব মানবিক চরিত্রে পাওয়া গেল এবং তাঁর অভিনয় অনবদ্য।
সব ছবিই বিনোদনধর্মী কিন্তু তফাত আছে। ‘আলফা’ চিন্তাকে উসকে দেয়া ছবি যেখানে হারানো ঐতিহ্যের জন্য আবেদন আছে বিশ্বায়নের বিপরীতে। নাসির উদ্দিন ইউসুফ তার সিগনেচার রাখতে পেরেছেন ছবিটিতে। তাঁর মাস্টওয়াচ ছবি হয়ে থাকবে।